কবি-বিষয়ক চৌকোণা টেবিল বৈঠক


দেশে দশ লাখ কবি। এটা আর এমন কী? কিন্তু বিশ্বব্যাংক বলে দিয়েছে একটা ছোট্ট দেশে এত কবির দরকার নাই। এত কবি থাকার দরুন দেশের অর্থনীতিতে বেমক্কা ধ্বাকা লাগছে। কারণ এরা বসে বসে কবিতা লেখে আর প্রেম করে। আর এ ধরনের প্রেম বাস্তবে নয়, প্রায়ই কল্পনা। তাই তাদের প্রেম কোনো ফল বহন করে আনে না। জনসংখ্যা বৃদ্ধিতেও কোনো ভূমিকা রাখে না। একতরফা প্রেম হলো নিষ্ফলা প্রেম। এতে প্রচুর জনশক্তির অপচয় হচ্ছে। এই আজাইরা বিপুল সংখ্যক মানুষের দেশকে খাওয়াতে হচ্ছে। দেশের মূল স্রোতে এদের (আসলে কাম-কাইজে লাগাতে না পারলে) আনতে না পারলে এরা লাই পেয়ে যাবে। বসে বসেই গিলবে। মুদ্রাস্ফীতি বাড়াবে।

একথা শুনে সরকার নড়েচড়ে বসে। আসলে ঘটনা তো সত্য। করণীয় সম্পর্কে একটা চৌকোণা-টেবিল (গোলটেবিল একটা ভুল শব্দ। মিটিংয়ের টেবিল সব সময় চৌকোণাই হয়) বৈঠক ডাকলো। এতে জাতীয় অর্থনৈতিক সমবায় সমিতি, নিখিল বঙ্গ বাবা অ্যাসোসিয়েশন (যেহেতু বেশিরভাগ কবি বাপের হোটেলে অবস্থান করে, বাবারাই কবিদের প্রথম ভিকটিম। কবি ছেলে বা মেয়ে পালন করা বাবাদের জন্য একটা মহা মুশকিল), বঙ্গবাজার পাবলিশার সমিতি এবং বাবুপুরা কাগজ ব্যবসায়ী সমিতির প্রতিনিধি এবং বিশ্বব্যাংকের আবাসিক প্রধান মি. উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ জুনিয়র। তিনি ড্যাফোডিলখ্যাত কবিতার কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের বংশধর। তিনিও কবিতা লেখেন।

মিটিং শুরু হওয়ার পর প্রথম নিখিল বঙ্গ বাবা অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে আইবুড়ি কবি সোহাগ খাতুনের বাবা মঈনউদ্দিন তার অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করলেন, দেখুন আমার মেয়ে কবিতা লেখে এতে আমার বলার কিছু নাই কিন্তু তাকে বিয়ে দিতে পারছি না। জামাই পাচ্ছি না সে আবার কবি জামাই ছাড়া বিয়ে করবে না। আমি প্রাণ থাকতে কবি জামাইয়ের সাথে মেয়ের বিয়ে দেবো না।
বিশ্বব্যাংকের আবাসিক প্রধান মি. উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ জুনিয়র এই পর্যায়ে হাত তুলে বলেন, অবজেকশন। আমার ডাডার ডাডাও কবি ছিলেন এবং তিনি বিয়ে করেছিলেন, তাদের ঘরে পাঁচ পাঁচ জন ফোলাপানও ছিল। আপনার মতো শ্বশুরের নিকুচি করি। কেন আপনি কবি জামাইয়ের কাছে বিয়ে ডিবেন না? বলুন…

বিষয়টা ব্যক্তিগত ঝগড়ার দিকে গড়াতে দেখে বঙ্গবাজার পাবলিশার সমিতির প্রেসিডেন্ট আতাউর ভাই ফ্লোর নিয়ে নেন, দেখুন মি. কবির নাতির ঘরের পুতি, আপনাদের দেশে কবি আর আমাদের দেশের কবির মধ্যে পার্থক্য আছে।
ওয়ার্ডসওয়ার্থ জুনিয়র রাগত স্বরে বলেন, কী পার্থক্য? বলুন মি. আঠাওর।

প্রথমত, আমার নাম আঠা ওর না। আঠা বই বাইন্ডারদের। আমার নাম আতাউর। মূল পার্থক্য হচ্ছে, আপনাদের দেশে কবি জামাই পাওয়া একটা দুরূহ ব্যাপার। কারণ কবির আকাল এবং কবি জামাই পাওয়া সম্মানেরও বটে। কিন্তু আমাদের দেশে কবি হলো লাখে লাখে। ঘরে বাইরে, আনাচে কানাচে, চায়ের দোকানে, সিগারেটের দোকানে, ফেসবুকে তো কবির বন্যা। এদের কাছে কেউ মেয়ে বিয়ে দিতে চাইবে কেন? কবিতা লেখা ছাড়া এরা আর কোনো কাজকাম করতে চায় না। আর এত পাত্রীই বা কোথায়? কবি বেশি পাত্রী কম। জনসংখ্যার বিরাট একটা অংশ কবি। এই কবিরা প্রচুর কবিতা লেখে। বড় বড় চুল রাখে। প্রচুর সিগারেট খায়। চা খায়। মাঝেমধ্যে অন্য কিছুও খায়…

এ পর্যায়ে ওয়ার্ডসওয়ার্থ জুনিয়র জানতে চায়, ভাট খায় না? মানে যেটা আপনাদের স্টেপল ফুড?
এবার আবার আইবুড়ি কবি সোহাগ খাতুনের বাবা হামলে পড়েন, হ্যাঁ ভাততো খায়ই। তিন বেলা গিলে। সে বেলায় কোনো না নাই!

আমরা যদি আমাদের কবিদের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি আনতে পারি তাহলে আমরা একচেটিয়া বিদেশে কবি রপ্তানি করতে পারবো।

কিন্তু এ কথার প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে এই চৌকোণা টেবিল বৈঠকের একমাত্র কবি প্রতিনিধি, কবি নর্মদা দাশ। উনি ত্রৈমাসিক হিসাবে গোছল করেন বলে ওনাকে পিছনে লোকজন বলে নর্দমার বাঁশ। কবি নর্দমার বাঁশ বলেন, দেখুন কবিরা তো দেশের মুদ্রাস্ফীতি বাড়ায় না। কারণ তাদের পকেটের অবস্থা প্রায়শই খারাপ বলে তারা তেমন কিছু কেনাকাটা করতে পারে না। মুদ্রা পাচারের সাথে জড়িত থাকে না, ওভার বা আন্ডার ইনভয়েসের কায়-কারবার করতে পারে না কিংবা বিনা শুল্কে বিদেশি গাড়িও আমদানি করে না। কবিরা সাধারণত সরকারেরটা খায় না। বাপের বা ভাইয়ের হোটেলে খায়। কেউ কেউ তো শুধু চা আর বিড়ি খেয়ে সারাদিন কাটায়। সেই দিক থেকে কবিরা সাশ্রয়ী এবং উপকারী।

ওয়ার্ডসওয়ার্থ জুনিয়র জানতে চান, রোজগারপাটি? কোনো কিছু করেন কি না?
এবার থতমত খান কবি নর্দমার বাঁশ, করবে কোন সময়? সব সময় তো কবি কবিতাই লেখেন।
-মানে ওনারা কি টয়লেটেও যান না? ওয়ার্ডসওয়ার্থ জুনিয়র জানতে আগ্রহ প্রকাশ করেন।
-তাতে কী? হাতে বদনা মাথায় কবিতা। কবি নর্মদা দাশ ব্যাখ্যা করেন।
-আশ্চর্য! ওয়ার্ডসওয়ার্থ জুনিয়র বিস্ময় প্রকাশ করেন। মাথা নাড়েন, না না এটো ভালো কঠা নয়। এজন্যই আপনাদের ডেশে এত ফ্যাঙ্গপালের মটো কবি।
-স্যার ফ্যাঙ্গপাল মানে? বাবুবাজার কাগজ বিক্রেতা সমিতির সাধারণ সম্পাদক বকর ভাই জানতে চান।
কবি নর্মদা দাশ বুঝিয়ে দেয়, আরে বুঝলেন না? ফ্যাঙ্গপাল মানে, পঙ্গপাল।

মি. ওয়াডসওয়ার্থের আন্ডার সেক্রেটারি মিস পামেলা ওয়াডসওয়ার্থকে বলে ওঠেন, ডিয়ার ওয়ার্ডু (মিস পামেলাকে ওয়াডসওয়ার্থের স্ত্রী দুচক্ষে দেখতে পারেন না এই মহিলার নেকুপনার জন্য। আহ্লাদি গলায় তোর অন্যের স্বামীর নাম বেঁকিয়ে বলার দরকারটা কী! ওয়ার্ডসওয়াথকে ওয়ার্ডু! ছিঃ অফিস ডেকোরাম বলে একটা কথা আছেতো! অফিসের নিয়মকানুন মানবি না? আর পুরুষরা তো এমনিই একটু ঢ্যামনা হয়। তাদের লাই দিবি কেন?) ডিয়ার তুমিও তো কবিতা লেখো, এখন কবিদের বিরুদ্ধে বলছ কেন?

মি. ওয়াডসওয়ার্থ জুনিয়র থতমত খান। সামলে মিস পামেলার কানের সামনে গিয়ে ফিসফিস করে বলেন, ডিয়ার পামেলা, টুমি এখন করো না ঝামেলা। আমি কবিটা লিখি টোমার জন্য। শুঢু টোমার জন্য। কিন্তু টোমাকে এদের সমস্যাটা বুঝটে হবে। এটো এটো কবি কোঠায় যাবে? সবাইকে তো আর পামেলা দেওয়া সম্ভব না। খাবার দেওয়া সম্ভব না। দেশ কী করবে এডের নিয়ে? একটা আনপ্রোডাক্টিটিভ জনগোষ্ঠী।

মিস পামেলা মাথা নাড়েন, ঠিক আছে। এবার মিস পামেলা গলা উঁচু করে বলেন, আমি আপনাদের একটা সাজেশন দিতে পারি। সেটা হলো, কবিদের ঘর থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে হবে। সংস্কার শুরু হোক নিজ ঘর থেকে। ম্যান ইজ মরটেল। পোয়েট অলসো মরটেল। মরুক গে।

মি. ওয়াডসওয়ার্থ মিস পামেলাকে কনুই দিয়ে ঠেলা দিয়ে আস্তে করে বলেন, কিসের মধ্যে কী বলছ! উল্টাপাল্টা কথা।
মিস পামেলা মি. ওয়াডসওয়ার্থের কনুইর স্পর্শে শিহরিত হ’ন, আঃ নটি! মিটিংয়ের মধ্যে ঠেলা দিচ্ছ কেন? পরেও তো ঠেলা দিতে পারতে। তুমি তো ঠেলাঠেলিতে ওস্তাদ!

এ পর্যায়ে নিখিল বঙ্গ বাবা অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধি মঈনউদ্দিন টেবিলে চাপড় দিয়ে মিস পামেলার কথা সমর্থন করেন, একদম ঠিক বলেছেন পামেলা মেম। এগুলিরে ঘর থেকে বাইর করে দিলে সোজা হবে।

জাতীয় অর্থনৈতিক সমবায় সমিতির ড. শুভঙ্কর মিত্র ফাঁকি বলেন, কিন্তু কবিতার অর্থমূল্য বের করতে হবে। যারা কবিতা লেখেন তাদের দ্বারা যে বই উৎপাদিত হয়। তার মূল্য কত? (ড. শুভঙ্কর মিত্র ফাঁকি এক সময় কবিতা লিখতেন। তাই কবিদের প্রতি তার এক ধরনের গোপন সহমর্মিতা আছে। কিন্তু সে কথা এ সভায়তো বলতে পারবেন না তাহলে পার্সিয়ালটি হয়ে যাবে। তিনি তরুণ বয়সে কবিতা লিখে পাশের বাড়ির সুলেখাকে পটিয়ে ফেলেছিলেন। সেটার ফলাফল তার এখন তিনটে ছেলেমেয়ে। কবিতার একটা ভাল আউটকাম এসেছে। তিনি চান সবার জীবনেই এরকমটা হোক।) এজন্য তিনি কবিতার ফল চান। হয় কবিতার আল্টিমেট পরিণতি বাচ্চাকাচ্চা নয় টাকা। এজন্যই তিনি কবিতার অর্থমূল্য, যেকোনোভাবে যেটাকে ইংরেজিতে ভ্যালু এডেড বলে, সেটা চান।

এবার একেবারে খেঁকিয়ে উঠলেন প্রশ্ন ফাঁস ব্যাচের যুগ্ম সচিব খয়ের খাঁ, (খয়ের খাঁ’র মাথা মোটা। তিনি আধুনিক কবিতা বোঝেন না। দাঁত বসাতে পারেন না। এজন্য তিনি আগে থেকেই কবিদের ওপর খাপ্পা ছিলেন) আপনাদের এত জটিল কথাবার্তা আমি বুঝি না। কবিতা লেখা নিষিদ্ধ করে আইন করার সুপারিশ করা হোক।

এবার বিশ্বব্যাংকের মিশন প্রধান মি. ওয়ার্ডসওয়াথ জুনিয়র রেগে কাঁই হয়ে উঠলেন, এই যে মি. প্রশ্ন ফাঁস আপনি মিটিং থেকে বের হয়ে যান। জাস্ট গেট আউট। কবিতা নিষিদ্ধ করবে! কত্তবড় সাহস! একদম টাকা-পয়সা সব বন্ধ করে দেবো।

বঙ্গবাজার প্রকাশক সমিতির প্রেসিডেন্ট মি. আতাউর বলেন, আমাদের ব্যবসা ধ্বংস হয়ে যাবে। কবিরা আছে বলেই আমরা করে কেটে খাচ্ছি। ধরুন ইদানিং প্রচুর মুরগি কবি পাচ্ছি। আসল ভালো বই কয় জনে পড়ে? বেস্ট সেলার হয় ঐ যে ‘মাথা খারাপ মনা পাগলা’ টাইপের বই। সেখানে আমাদের মুরগি কবি না হলে চলবে কী করে?

এখানে আবার মি. ওয়ার্ডসওয়াথ জুনিয়র কপাল চাপড়ে বলে ওঠেন, আপনাদের কথা শুনে, আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আমি এতদিন জানতাম মানুষেরাই গল্প কবিতা লেখে। আর এখন আপনারা বলছেন আপনাদের দেশে মুরগিরাও কবিতা লেখে! আশ্চর্য! এমন একটা দেশ যেখানে মুরগিরাও কবিতা লেখে! চিকেন পোয়েট! হাউ ইট পসিবল্? কী বিচিত্র এ দেশ মি. প্রশ্নফাঁস! স্যরি সেলুকাস!

নিখিল বঙ্গ বাবা সমিতির প্রতিনিধি মঈনউদ্দিন হাত উঁচিয়ে বলেন, আমি বলছি। আমার মেয়ে একজন মুরগি কবি। আমার কত টাকা যে বই ছাপিয়ে নষ্ট করেছে। আমাকে ফতুর করে দিয়েছে! আমি দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছি। মঈনউদ্দিন ভাবলেন, ‘দারিদ্র্য সীমা’ শব্দযুগল ব্যবহার করে যদি কিছু এইড টেইড বাগিয়ে নেওয়া যায় মুফতে। যেহেতু এখানে বিশ্বব্যাংকের মিশন প্রধান আছেন।

মি. ওয়ার্ডসওয়াথ জুনিয়র আশ্চর্য হন, কী বলেন এসব! মেয়েদের আপনারা মুরগি কবি বলেন? এ তো নারীদের অপমান।
মঈনউদ্দিন বলেন, না না ব্যাপারটা তা নয়…

মঈনউদ্দিনকে তাড়াতাড়ি বাধা দেন বঙ্গবাজার প্রকাশক সমিতির প্রেসিডেন্ট মি. আঠাওর ওরফে আতাউর, চুপ চুপ।
মি. আঠাওর ভাবেন, সর্বনাশ মুরগি লেখকের ব্যাপারটা যদি বিদেশিরা জানতে পারেন, তাহলে মান-ইজ্জত আর থাকবে না। এমনিতেই আমাদের ‘সুনাম’ চারদিকে।

জাতীয় অর্থনৈতিক সমবায় সমিতির ড. শুভঙ্কর মিত্র ফাঁকি দেখলেন অবস্থা বেগতিক। তিনি সামাল দেওয়ার জন্য বলেন, মুরগি কবির বিষয়টা আমাদের আলোচনার এজেন্ডায় ছিল না। সেটা আরেক দিন আলোচনা হবে। আমি যেটা বলতে চাই, একটা পথ বের করতে পারি। এতে কবিদের কল্যাণ হবে। সেটা হলো, আমরা যদি আমাদের কবিদের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি আনতে পারি তাহলে আমরা একচেটিয়া বিদেশে কবি রপ্তানি করতে পারবো।

এটা বলার পর সভা কিছুক্ষণ স্তব্দ হয়ে রইলো। তারপর তুমুল হাততালিতে ফেটে পড়লো। যথার্থ প্রস্তাব। যথার্থ প্রস্তাব।
কিন্তু প্রশ্ন ফাঁস ব্যাচের যুগ্মসচিব মনে মনে খুবই গোস্‌সা হলেন। কবিদের এতবড় স্বীকৃতি দেওয়াটা তিনি মানতে পারেন না। যাক প্রস্তাবটা পাঠাক না মন্ত্রণালয়ে। তার কাছেই তো ফাইল যাবে। তিনি ফাইলে পুট্টুশ করে প্রশ্ন ফাঁস ব্যাচের নামটা ঢুকিয়ে দেবেন। তারপর নিজেরাও রপ্তানি হওয়ার সুযোগটা নেবেন। দুই নম্বরি তো জীবনে আর কম করেননি।