পুরুষ ঔপন্যাসিকদের মতো নারীরা বড় ক্যানভাস ব্যবহার করতে পারে না


‘প্যারিস রিভিউ’-এর ২৪৯তম সংখ্যায় প্রকাশিত নিচের সাক্ষাৎকারটি ২০১৯ সনালের শুরুর দিকে গ্রহণ করেন হাসান আলতাফ। সেই সাক্ষাৎকারটি চিন্তাসূত্রের পাঠকদের জন্য বাংলায় ভাষান্তর করেছেন মনোজিৎকুমার দাস। এখানে সাক্ষাৎকারটি হুবহু তুলে ধরা হলো।

হাসান আলতাফ: আপনার পড়ার অভ্যাস সম্পর্কে কিছুটা বলতে পারেন?
অরুন্ধতী রায়: আমি কেরালায় বেড়ে উঠি। ইংরেজিতে ঋদ্ধ হওয়ার জন্য সেখানে মালায়ালাম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত হই। সেখানে প্রচুর সংখ্যক শেক্সপিয়ার ও কিপলিং-এর বই ছিল। আমি অবশ্যই তাদের লেখার দ্বারা প্রভাবিত হই। আমি পরে জেমস বাল্ডউইন, টনি মরিসন, মায়া অ্যাঞ্জেলো, জন বার্গার, জয়েস, নবোকভের লেখা বই আত্মস্থ করে জ্ঞানভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করি। আমি মহান লেখকদের কাছ থেকে শেখা পাঠের জন্য কৃতজ্ঞ। সাম্রাজ্যবাদী, যৌনতাবাদী, বন্ধুবান্ধব, প্রেমিক, অত্যাচারী, বিপ্লবী—প্রত্যেকের কাছ থেকে অনেক কিছু জানতে পারি। প্রত্যেক লেখকের লেখা থেকে শেখার কিছু না কিছু আছে। জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন ও আসামের দুই মিলিয়ন লোককে হঠাৎ করে ভারতীয় নাগরিক হওয়া বন্ধ করে দেওয়া সম্পর্কিত মিসেস ডাল্লোয়ের একটি প্রতিবেদন আমার মনে রেখাপাত করে।

একটি উপন্যাস আমাকে অভিভূত করেছিল। উপন্যাসটি হলো ভ্যাসিলি গ্রোসম্যানের জীবন ও ভাগ্য, যা ছিল অবিশ্বাস্য—ধৃষ্টতাপূর্ণ। চরিত্র ও পরিস্থিতিগুলো সীমাহীন ভয়াবহতায় ভরা। ওটা শুরু হয় ভোলগা নদীতে ভাসমান গ্যাসোলিন জ্বলতে থাকা ও জলের ওপরে ভাসমান পেট্রলে আগুন ধরানোর কথা দিয়ে। জ্বলন্ত নদীর কথা তুলে ধরায় স্ট্যালিনগ্রাদ যেন ক্রোধের আগুন জ্বলে ওঠে। তার পাণ্ডুলিপিটি সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ বাজয়াপ্ত করে। আরেকটি ছিল জর্জিও বাসানির লেখা ‘গার্ডেন অব ফিনজি-কন্টিনিস’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক আগের সময়টার কথা, ইতালির অনেকেই ইহুদি ফ্যাসিস্ট পার্টির সদস্য ছিল। ফিনজি-কন্টিনিস হলো একটি অভিজাত ইহুদি পরিবার। তাদের টেনিস কোর্টসহ প্রকাণ্ড ময়দান ছিল। বড়সড়ো একটি ম্যানশনে তারা বসবাস করত। বইটিতে হলোকাস্ট বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফিনজি-কন্টিনিসের কন্যা সঙ্গে তাদের পরিমণ্ডলের বাইরের একজনর মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠার কথা ব্যক্ত হয়। তাদের সম্পর্ক স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে ফিনজি-কন্টিনিস। ফলে এই বিষয়ে খারাপ পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে। ফিনজি-কন্টিনিসের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এ ঘটনার পরিসমাপ্তি হয়। স্টালিনবাদী রাশিয়ায় যা ঘটেছিল, তা বিবেচনা করে বলা যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপে কী, তা ঘটেছিল? আমি অবাক হই স্ট্যালিনের গুলি চালানো স্কোয়াডের দ্বারা গুলিবিদ্ধ হওয়া কয়েকজন কিভাবে ‘দীর্ঘজীবী হউন স্টালিন!’ বলে চিৎকার করে মারা যাওয়ার কথা জেনে। গুলাগা শিবিরে শ্রমদান করা শ্রমিকরা মারা যাওয়ার সময় কেঁদেছিল। সাধারণ জার্মানরা কখনোই হিটলারের বিরুদ্ধে কথা বলেনি, এমনকি যখন তিনি যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন, তাদের শহরগুলোকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিলেন, তখনো না। ভার্লাম শালামভের আন্না আখমাতোভা ও কলিমা টেলিসের কবিতা ও গল্পে আমি ইয়ান কারশারের লেখা হিটলারের জীবনীবৃত্তান্ত এবং ন্যাডহদা ম্যান্ডেলস্টামের স্ত্রীর মৃত্যু মাঝে মানব সাইকোলজির সন্ধান খুঁজছি। তার স্ত্রীর মৃত্যু স্ট্যালিনের বাহিনীর হাতে হয় বলে শোনা যায়।

হাসান আলতাফ:  প্রচুর রাশিয়ান।
অরুন্ধতী রায় :  (হেসে) তখন অনেক রাশিয়ান ছিল, হ্যাঁ। তারা বড় বড় আখ্যানগুলোকে উপলব্ধি করতে পারে। সেগুলো খুবই সরস। চেখভ সেগুলোকে আণুবীক্ষণিক উপাযে উপস্থাপন করেছেন তার গল্পগুলোতে। এখন ট্র্যাফিকের নিয়মনীতিগুলো আরও কঠোর হয়ে উঠছে। লেনগুলো আরও সংকুচিত হয়ে উঠছে এবং আরও সংকুচিত হবে। প্রতিটি দিক, ওপরে, নিচে এবং পাশের রাস্তাগুলো নিয়ন্ত্রিত। ভারতে, সাংস্কৃতিক সেন্সরশিপটি আক্ষরিক অর্থে আছে। আমরা মনে করি, তা এক ধরনের বৌদ্ধিক গ্রিডে পৌঁছেছে।

হাসান আলতাফ : আপনি আপনার লেখাকে কখনো মাইক্রোস্কোপিক ছোটগল্পের ছাঁচে লিখতে প্রলুব্ধ হয়নি। আপনার উপন্যাসটি আপনার বাস্তব অভিজ্ঞাপ্রসূত বলে মনে হয়।
অরুন্ধতী রায়:  আমি বছরের পর বছর ধরে একটি উপন্যাস রচনায় নিজেকে নিমগ্ন করতে পছন্দ করেছিলাম। আমি বেশি দিন বেঁচে থাকি এমন নাও হতে পারে, কিছু লেখক এই ভয়ভীতিতে ভোগেন, তবে আমি এই ভাবনাকে উপভোগ করি। সেই মহাবিশ্বে থাকা, সেই অসম্পূর্ণ মহাবিশ্ব, প্রার্থনা করার মতো—এটি পণ্য বা শেষ থেকে বা সাফল্যের থেকে বা পণ্যটির সার্থকতা থেকে পৃথক। উপন্যাস—পণ্যের জন্য কী ভয়াবহ শব্দ। আমায় ক্ষমা করবেন।

হাসান আলতাফ:  সেই পণ্যটি কী? কোনো উপন্যাসের কথা বলছেন?
অরুন্ধতী রায় : আমি মনে করি উপন্যাস অত্যাধিক প্রবহমান ও ঘরোয়া হওয়ায় বিপদ থাকে। আপনি যখন ভ্যাসিলি গ্রোসম্যান বা বড় বড় রাশিয়ান উপন্যাসগুলো পড়েন, সেগুলো জংলা এবং অযৌক্তিক বলে মনে হতে পারে। তবে এমন একটি উপায় আছে, যাতে সাহিত্যের উপাদান তৈরি হয়। তা কি রোমাঞ্চকর, ব্যবসায়িক ও সাহিত্যমূলক? আমাদের কি এতে অবাক হওয়া উচিত? এখন আমাদের উপন্যাস প্রায়শই সুন্দরভাবে লিখিত পণ্য হতে পারে। কোনো রুক্ষ প্রান্তর নেই। চরিত্রের সংখ্যা, অধ্যায়গুলোর দৈর্ঘ্যসহ সবই দক্ষতার সঙ্গে অর্কেস্টেড। আমি বলবো, পুরুষ উপন্যাসিকদের সহজেই বড় ক্যানভাসের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে একজন নারীর ক্ষেত্রে তা কিন্তু নয়। দেখতে হবে, বইতে কয়টি চরিত্র আছ? এটা কি খুব বেশি রাজনৈতিক নয়? আমি তাদের জিজ্ঞাসা করবো, ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অব সলিউডেট বা ওয়ার অ্যান্ড পিস বা অন্য কোনো বইয়ে কয়টি চরিত্র আছে? আমি মাঝে মাঝে অনুভব করি, জারের আমলে কলা ও সাহিত্যের স্বাদ নিয়ন্ত্রিত ছিল। আমাদের মধ্যে আশা করা যায় যে, এমনটা লিখতে হবে যাতে এক ধরনের ডিফল্ট ওয়ার্ল্ডভিউ থাকে। যাতে অগ্রগতি, আলোকিতকরণ এবং সভ্যতার গঠনের ধারণাগুলো মানসম্মত হয়। তবে আমি মনে করি এটি এখন পরিবর্তিত হচ্ছে। এটি তরুণ লেখক এবং কবিরা চ্যালেঞ্জ করে চলেছেন, তারা সারা বিশ্বের বিভিন্ন দিক থেকে চ্যালেঞ্জ করেছেন।

হাসান আলতাফ: আপনাকে ধন্যবাদ।
অরুন্ধতী রায়:  আপনাকেও ধন্যবাদ।