বাংলা কাব্যভূমে জামসেদ ওয়াজেদ


জামসেদ ওয়াজেদ কাব্যভূমে এখন আর নব্য আগন্তুক নয়। আমাদের সাম্প্রতিক কবিতায় এক প্রাগৈতিক কথাকোবিদ। জামসেদ এই শিল্পের ঘরানার বনেদি এবং ক্লাসিক ধারার স্ফূর্ত পরিব্রাজক। সনাতন এবং আবহমান রীতির একটি দায়বদ্ধতা তার কবিতায় উঠে আসে। মাতৃভাষা, মাতৃভূমি, মৃত্তিকা ও মা তার কবিতার প্রধান অনুষঙ্গ। এখানেই তার অকৃত্রিম নিখাদ ভালোবাসা। পৃথিবী ও প্রকৃতির সব মহৎ কবিরই এই ভালোবাসা এক জীবনবেদ্য বিষয়।

এ থেকে জামসেদ ওয়াজেদেরও কোনো ভিন্নতা নেই। তার মসৃণ মৃত্তিকাজ্ঞান এবং সংবিৎ কাব্য-প্রকর্ষের ভিত তৈরি করে। যার হৃদয়ে মৃত্তিকা নেই, মাতৃভূমি নেই, পিতৃভূমি নেই, মা নেই_ সে তো এক উদ্দেশ্যবিহীন গন্তব্যবিহীন নিঃস্ব উদ্বাস্তু মাত্র। জামসেদ ওয়াজেদ জীবন যাত্রায়ও সংগ্রামে নিবিষ্ট গন্তব্যপ্রবণ কবি। শিল্পের হিরণ্ময় দুয়ারের দিকেই তার যাত্রা। তার ‘আমার কবিতা’ থেকে অধীত আত্দার সন্ধান পেতে পারি।

আমার কবিতা তুমি হেঁটে চল আপন গতিতে
পৃথিবীর প্রান্ত ছুঁয়ে অন্য কোন গ্রহে যেতে পারো
যাও নিতো ফিরে আসো বরাবর প্রাচীন অতীতে
কালনেত্র দৃষ্টি মেলে এঁকে যাও ইতিহাস আরও

কবিতার চাষ করে পৃথিবীতে ফসল ফলাই
যে ফসলে ভরে ওঠে সভ্যতার নিটোল কাহিনী
এ কোন দানব এসে সব করে দলাই মলাই
আমার এ জনপদে কারা এই নতুন বাহিনী
সাহসী বীরের জন্য আজো কাঁদে পৃথিবী প্রবীণ
অন্ধকার মুছে যাক শুধু চাই আলোকিত দিন
[আমার কবিতা, নির্বাচিত সনেট, পৃষ্ঠা-১১]

জামসেদ ওয়াজেদ তার কবিতার শিরদাঁড়া শীর্ষস্থানে স্থাপন করতে প্রয়াসী। প্রাচীন অতীতের পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে তার কালনেত্র নবতর ইতিহাসের ওপর মেলে ধরতে চান। পৃথিবীতে ফলাতে চান নতুন বীজ কণার সজীবন্ত শস্য। যে ফসলে ভরে উঠবে প্রগতির সোনালি উঠোন। দানবের উল্লম্ফন প্রতিহত করে পৃথিবীর প্রত্যুষ মুহূর্তে মানবিক পতাকা উড্ডীন করতে নিজেকে প্রস্তুত করছেন নিরন্তর, এ কবি। এই প্রবীণ পৃথিবী এই কবির জন্য সহিষ্ণু প্রতীক্ষায় উজ্জীবিত। অাঁধার হনন শেষে আলোর প্রত্যাশা শুধু।

জামসেদ ওয়াজেদ স্বতোৎসারিত অনুভবে নতুন নতুন শব্দবন্ধ রচনা করেন। নির্মাণ করেন চৈতন্যের এক নতুন কাব্যিক দিগন্ত। নগর জীবনের বিপন্ন বিষাদ, ক্লান্তি, অবসাদ, নৈরাজ্য ও আত্দিক অবক্ষয়ের পাশ ঠেলে জামসেদ ওয়াজেদ আশাবাদের রূপকল্প সৃষ্টি করেন যেখানে মানুষের বিশ্বাস ও অস্তিত্ব বাঙ্ময় হয়ে ওঠে। ‘জননী আমার’ কবিতার উদ্ধৃতি পেশ করে তার মাতৃপ্রতিম মানচিত্রের কথা উল্লেখ করা যায় :

জননী আমার তুমি এর চেয়ে বড় সত্য আর কিছু নয়
তুমিতো মৃত্তিকা মাগো যে বলয়ে গড়ে ওঠা আমার শরীর
হাজার অতীত স্মৃতি কষ্ট জড়ো কাঁটাশূল বেদনার তীর
তুমি সত্য তুমি আলো আকাশ উদার যার নেই পরাজয়

জননী আমার তুমি যার কাছে এই দেশ মানচিত্র ঋণী
একটি বুলেট শুধু মৃদু শব্দে খুলে ফেলে যে নাকের ফুল
তুমিতো সঠিক মাগো বাদ বাকি পৃথিবীর সব স্মৃতি ভুল
অমূল্য সম্পদ এক যা হয় না কোনদিনো হাটে বিকিকিনি
[জননী আমার, নির্বাচিত সনেট, পৃষ্ঠা-১২]

আমরা স্তবক ভেঙে ভেঙে লক্ষ্য করব সব মানুষেরই স্বদেশমৃত্তিকা মাতৃসমা এই সত্যকে মহীয়ান করতে চেয়েছেন জামসেদ। এই মৃত্তিকা তার দেহের প্রতিকাঠামোকে রূপদান করেছেন। এই মাতৃকা ও দেশমৃত্তিকা পৃথিবীর সবচেয়ে বিস্তীর্ণ দৃশ্যপট। এখানে কবি আপন সংবিতে সমৃদ্ধ। নিজস্ব চেতনায় সমৃদ্ধ। ‘শেকল জড়ানো দিন আঁধার  অন্তিম রাত পার করে শেষে’ কবি বিশাল সমুদ্র বুকে ধারণ করে একটি সবুজ দ্বীপের মতো সহাস্যে জেগে উঠতে চান। প্রিয় স্বভূমি ও স্বদেশ, আশা আর প্রত্যাশায় প্রাণবন্ত হবে এটাই কবির বিশ্বাস।

আমাদের সম্ভাবনা বিশুদ্ধ চিন্তার চাষ মন ও মননে
তবুও আকাশ হতে তারকারা চুরি হয় অচিহ্নিত রাতে
সমবায়ী সব দিন হয়ে ওঠে আলোহীন ভোরের আঁতাতে
স্বাধীনতা স্বাধীনতা প্রিয় ধ্বনি বেজে উঠে পাখির স্বননে
[অনিশ্চিত এই অন্ধকার, নির্বাচিত সনেট, পৃষ্ঠা-১৫]

এই পঙক্তিপুঞ্জের স্তবকে কবি মানবিক সম্ভাবনার বাস্তবতা চিহ্নিত করতে সংকল্পবদ্ধ। অরণ্যে-অরণ্যে, দিগন্তে- দিগন্তে পাখির স্বননে স্বাধীনতার শব্দধ্বনি শুনতে পান তিনি। এ যেন মুক্তির, শান্তির ললিতবাণী।

ইংরেজি নববর্ষের প্রথম সপ্তাহে জামসেদ ওয়াজেদকে স্বপ্রীতি শুভেচ্ছা জানিয়েছিলাম। ওর নতুন বইয়ের খোঁজ করেছিলাম। বইটি পেলে প্রীত হব জানিয়েছিলাম। প্রতিশ্রুতি মতো নির্বাচিত সনেট আমার হাতে অনার্য মুর্শিদ বায়তুল মোকাররম আল আকসা বিপণি পেঁৗছে দিল। ঝকঝকে তকতকে সৌকর্যমণ্ডিত জামসেদ ওয়াজেদের ‘নির্বাচিত সনেট’ আনন্দের আতিশয্যে মনটি ভরে উঠল। ১৬০ পৃষ্ঠা সম্বলিত দেড়শটি সনেট সংকলিত হয়েছে এই গ্রন্থে। জামসেদ ওয়াজেদ এই গ্রন্থের সনেট নির্মাণে তার নিপুণতা ও বৈশিষ্ট্য বিধৃত করেছেন।