বাক্‌-স্বাধীনতার সীমারেখা: একটি পাঠ প্রতিক্রিয়া


সাহিত্যের মানে তো কেবলই কবিতা, গল্প, উপন্যাস নয়; আরও কিছু। এরই একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা প্রবন্ধ। যে-কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গল্প-কবিতা-উপন্যাস-নাটক যেমন রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক নানা কারণে মাঝে মাঝে খানিকটা ইঙ্গিতবহ হয়, প্রবন্ধে বরং সে-সব বলা যায় অনেক তীক্ষ্ণভাবে। সরাসরি। অন্তত দীর্ঘদিন বই, ম্যাগাজিন, সংবাদপত্রসহ মুদ্রিত নানা মাধ্যমে তারই প্রচলন ছিল। কিন্তু সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে যেন প্রবন্ধ সাহিত্যের ধাঁচও পাল্টাতে শুরু করেছে। আজও বিভিন্ন পত্রিকায় কিছু প্রবন্ধ ছাপা হয়, কিন্তু তাতে সমাজ বাস্তবতা, অসঙ্গতি, সমালোচনার প্রখরতার ছাপ পাওয়া যায় না। অপ্রতুল সুপরামর্শের সামর্থ্যও।

বর্তমানে বহু সম্ভাবনাময় গল্পকার, উপন্যাসিক, কবি বেরিয়ে আসছেন। কিন্তু আফসোসের বিষয়, আবুল ফজল, কাজী আবদুল ওয়াদুদ, কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল হুসেন, মোতাহার হোসেন চৌধুরী, মোহিতলাল মজুমদার, বুদ্ধদেব বসু, আবু সয়ীদ আইয়ুব, আহমদ শরীফ, হাসান হাফিজুর রহমান, সৈয়দ আলী আহসান, আহমদ ছফা, বদরুদ্দীন উমর, আবু জাফর শামসুদ্দীন, সৈয়দ আকরম হোসেন, আবদুল মান্নান সৈয়দ, আবিদ আজাদ, হুমায়ূন আজাদের মতো লেখার গুণে লগ্নজয়ী সুপ্রাবন্ধিক বেরিয়ে আসছে না। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, প্রবন্ধ লেখার জন্যে ভাষা, শব্দ, বিবেচনা আর বিশ্লেষণবোধের যে সমন্বয় দরকার, তা এই প্রজন্মের বহু লেখকের মধ্যেই নেই। তাই তারা কবিতা কিংবা ফিকশন লেখেন ঠিকঠাক, কিন্তু প্রবন্ধে হাত দিতে ভয় পান। সেদিক থেকে মোহাম্মদ নূরুল হক ব্যতিক্রম। তার কবিতা ও গদ্য-গল্প সুখপাঠ্য। কিন্তু মনে হয় তিনি সবচেয়ে বেশি উপভোগ করেন নিজের প্রাবন্ধিক পরিচয়। কারণ কবিতা বা গল্পের চেয়ে তাকে বেশি মনোযোগী হতে দেখি প্রবন্ধেই।

‘বুদ্ধিজীবীর সংকট ও ভাঁড়ের দৌরাত্ম’, ‘কথা বলার সময়-অসময়’, ‘শাড়ির আড়ালে নারীকে অসম্মান!’ বা ‘মানুষ কেন আত্মহত্যা করে’ শীর্ষক প্রবন্ধগুলোয় জরুরি বিভিন্ন প্রশ্ন তুলেছেন। এসব প্রবন্ধে তিনি যে যুক্তিগুলো দিয়েছেন, তার প্রায় সত্তর শতাংশের সঙ্গে আমি একমত।

এবারের বই মেলায় আমার হাতে এসেছে ‘প্রতিকথা’ প্রকাশনী থেকে মোহাম্মদ নূরুল হকের ‘বাক্-স্বাধীনতার সীমারেখা’ শীর্ষক প্রবন্ধের বইটি। আমরা বর্তমানে এমন এক অস্থির সময়ে বাস করছি যেখানে প্রতিনিয়ত চারদিকে বাক্ স্বাধীনতা, মানবাধিকার, গণতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, রাজনীতির মতো শব্দগুলোর অতি গ্যাঁজানো ব্যবহার মন-প্রাণ-চিন্তা বিষিয়ে তুলছে। জনৈক বখতিয়ার আহমেদের একটি লেখা পড়ছিলাম। তিনি সেখানে বলেছেন, বাক্ স্বাধীনতা মানে মানুষের লিখিত বা উচ্চারিত কোনো বাক্যের বিরুদ্ধে বাক্য ছাড়া ভিন্ন আর কোনো পাল্টাস্ত্র ব্যবহার করা যাবে না। বাক্যের বিরুদ্ধে যদি পাল্টা যুক্তি ছাড়া অন্য অস্ত্র তাক হয়, তবে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সেটার নামই হওয়া উচিত ফ্যাসিবাদ। সুতরাং এই তুমুল সময়ে দাঁড়িয়ে নামের জন্য মোহাম্মদ নূরুল হকের বইটি উৎসুক পিপাসু পাঠকের দৃষ্টি তো কাড়বেই। মাত্র ৮০ পৃষ্ঠার ক্ষীণকায় বইটিতে স্থান পাওয়া প্রবন্ধের সংখ্যা ১৩। যার প্রতিটির বিষয় রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে জরুরি একইসঙ্গে জনগুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং যাচাইকারী পাঠকদের জন্য বইটিকে দরকারি বলে ঘোষণা করাই যায়।

কিন্তু কথা হচ্ছে, যে প্রবন্ধগুলো এসেছে, সেগুলো আসলে কতটুকু প্রভাব ফেলতে পারছে বা পাঠক মনে পাল্টা প্রশ্ন তৈরি করতে পারছে? বইয়ের প্রথম প্রবন্ধই ‘বাক্-স্বাধীনতার সীমারেখা’। লেখক এখানে চলমান রাষ্ট্র পরিস্থিতিতে কার কতটুকু কথা বলার স্বাধীনতা থাকা উচিত বা উচিত নয়, সেটি বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছেন। এছাড়া ‘বুদ্ধিজীবীর সংকট ও ভাঁড়ের দৌরাত্ম’, ‘কথা বলার সময়-অসময়’, ‘শাড়ির আড়ালে নারীকে অসম্মান!’ বা ‘মানুষ কেন আত্মহত্যা করে’ শীর্ষক প্রবন্ধগুলোয় জরুরি বিভিন্ন প্রশ্ন তুলেছেন। এসব প্রবন্ধে তিনি যে যুক্তিগুলো দিয়েছেন, তার প্রায় সত্তর শতাংশের সঙ্গে আমি একমত। বাকি ত্রিশ শতাংশ না হয় মুখোমুখি তর্কের জন্য তোলা থাক। যেহেতু এটা পাঠ-প্রতিক্রিয়া, তাই বইটি নিয়েই কথা বলি। এর কিছু কিছু বাক্য ও শব্দ আমি একেবারেই নিতে পারিনি। দ্বিতীয় প্রবন্ধে তিনি ‘ভাঁড়’ শব্দ জুড়ে দিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রকে যেভাবে খেলো করে উপস্থাপন করেছেন, তা আপত্তিকর। এখানে যাদের বা যে অর্থে তিনি ভাঁড় বলেছেন, তাদের শব্দচয়ন অন্য কিছু হতে পারতো।

মনে রাখতে হবে, ভাঁড় বা জোকারের কর্মকাণ্ড শুধু উদ্ভট সাজ আর অঙ্গভঙ্গি দিয়ে লোক হাসানো নয়। বরং ভাঁড়েরা যে রসাত্মক কথা বা কাজের আড়ালে বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন, তার প্রচুর উদাহরণ আছে। আপাত দৃষ্টিতে সিনেমায় চার্লি চ্যাপলিনের নানা কর্মকাণ্ড হাস্যরসের জন্য দেয় ঠিক, কিন্তু তার আড়ালে ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’, ‘মডার্ন টাইমস’-এর মতো চলচ্চিত্রগুলো সে সময়কার ইউরোপের সমাজ ব্যবস্থার যেন একেকটি সচিত্র প্রতিবেদন। আমাদের গোপাল ভাঁড় বা গোলাম হোসেন কিংবা নাসিরুদ্দিন হোজ্জাকেও নিছক ভাঁড় মনে করা হলে সত্যি ভুল বোঝা হবে। লেখক প্রাজ্ঞ বুদ্ধিজীবীর বিপরীতে যাদের ভাঁড় বলেছেন, তারা আসলে অন্যরকম বিচিত্র কুৎসিত কিছু।

তারপর না হয় আপনি লেখক মোহাম্মদ নূরুল হকের সঙ্গে সহমত হবেন, আমি দ্বিমত। নয়তো আমি সহমত হবো, আপনি দ্বিমত। তবেই না বাক্যের পিঠে বাক্য, যুক্তির পিঠে পাল্টা যুক্তি দিয়ে ‘বাক্ স্বাধীনতার’ লড়াই জমে উঠবে।

এছাড়া ‘কথা বলার সময়-অসময়’ লেখাটিতেও শুরুর দিকে যেসব উদাহরণ বারবার টেনে এনেছেন, সেগুলো বড্ড কাঁচা এবং মেলোড্রামাটিক লাগে। মূল প্রসঙ্গে আসতে নানারকম হেয়ালির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে, যা পঠনযাত্রাকে ব্যাহত (খানিকটা বিরক্তও) করে। অন্য প্রবন্ধগুলোর জন্যও থেকে গেছে এমন কিছু উদাহরণ। এছাড়া প্রতিটি প্রবন্ধেই উদাহরণগুলো কখনো অতি কথায় দুষ্ট, কখনো বা অপ্রয়োজনীয় আলাপে। সে তুলনায় যুক্তির সপক্ষে উল্লেখযোগ্য রেফারেন্স নেই বললেই চলে। যা এই বইয়ের প্রধান দুর্বলতাগুলোরও একটি। এছাড়া প্রবন্ধগুলো কবে লেখা তা শেষে উল্লেখ করলে ভালো হতো। কারণ ‘শাড়ির আড়ালে নারীকে অসম্মান!’ বা ‘বিএনপির জামায়াতপ্রীতি বনাম জনভীতি’-এর মতো প্রবন্ধগুলোর প্রসঙ্গ সময়ের কারণে বহুল আলোচিত হয়ে এসে একটু পুরনো বা মীমাংসিত বলে মনে হয়। সেইসঙ্গে বইটিতে প্রুফ বা সম্পাদনাগত কিছু দুর্বলতা থেকে গেছে। বানান ভুলের সঙ্গে আছে বাক্যে গরমিলও। যদিও তার সংখ্যা খুব বেশি নয়।

‘সাহিত্যে নিরীক্ষা: আশীর্বাদ বনাম অভিশাপ’ প্রবন্ধেও উল্লিখিত নানা শব্দ একইসঙ্গে মনোভাব নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। সাহিত্যে নিরীক্ষা কেন এক চোরাবালির নাম তা নানাভাবে লেখক বোঝাতে চেষ্টা করেছেন। তিনি মনে করেন, পূর্বসূরিদের পুরোপুরি না জেনে না শুনে, কালজয়ী সাহিত্যগুলো না পড়ে, শব্দ প্রয়োগ সূত্র না বুঝে, মাত্রাজ্ঞান না শিখে, বানানে দক্ষ না হয়ে নতুনদের নিরীক্ষা করা ঠিক নয়। অর্থাৎ নতুনরা কেউ লিখতে চাইলে পূর্বসূরিদের আপাতত অনুসরণ করো, পরে বাবা দিক্ষা শেষে এসে ভিন্ন কিছু ট্রাই করবে। কিন্তু লেখকের এই মনোভাবের সঙ্গে আমি স্পষ্টত দ্বিমত পোষণ করি। হ্যাঁ, অবশ্যই কেউ যদি সত্যিকারের সাহিত্য করতে আসে তাহলে তার পূর্বজদের ভালোভাবে জানা-পড়া উচিত। সেইসঙ্গে বিশ্ব সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রচনাগুলো পড়ে উচিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করা। কিন্তু তার আগে কোনো লেখক নিজের লেখা নিয়ে নীরিক্ষা করলে তা ভুল পথে পা বাড়ানো হবে, সেটা বলতে আমি রাজি নই। নিরীক্ষা জিনিসটাই যেহেতু প্রতিনিয়ত নতুনত্ব দাবি করে, সুতরাং আমার মতে নতুনরাই বরং তার চাহিদা মেটাতে পারে ভালো। একজন নতুন সাহিত্য ইচ্ছুকের জন্য লেখায় যতি চিহ্ন, প্রতীকের ব্যবহার, বানানের শুদ্ধতা, বাক্যে পরিমিতি বোধসহ নানা বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে। মনে রাখতে হবে, সেটা তার সমালোচনাযোগ্য অদক্ষতা, নিরীক্ষামূলক নতুন ধরনের আখ্যান বর্ণনায় অযোগ্যতা নয়। লেখকের নিজস্ব নিরীক্ষা সম্পূর্ণ প্রস্তুতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা যাবে না, এতটা লিটারেচার পুলিশিং বোধয় ঠিক নয়।

প্রবন্ধগুলো নিয়ে আমার এই সমালোচনার উদ্দেশ্য এটা নয় যে, মোহাম্মদ নূরুল হক খারাপ কিছু লিখেছেন। বরং আমি এটা বোঝাতে চাইছি যে, তার লেখা আমার মধ্যে দ্বিমত তৈরি করেছে। আমি তার ছুড়ে দেওয়া প্রশ্নের প্রতি উত্তর ভাবতে বাধ্য হয়েছি। আর সেটাই বইটির সব প্রসঙ্গকে সফল করে তুলছে। নিছক ফিকশনের বাইরে প্রবন্ধ পড়তে যারা ভালোবাসেন, আমি তাদের বলবো ‘বাক্-স্বাধীনতার সীমারেখা’ বইটি পড়ে দেখুন। তারপর না হয় আপনি লেখক মোহাম্মদ নূরুল হকের সঙ্গে সহমত হবেন, আমি দ্বিমত। নয়তো আমি সহমত হবো, আপনি দ্বিমত। তবেই না বাক্যের পিঠে বাক্য, যুক্তির পিঠে পাল্টা যুক্তি দিয়ে ‘বাক্ স্বাধীনতার’ লড়াই জমে উঠবে।

বাক্-স্বাধীনতার সীমারেখা
লেখক: মোহাম্মদ নূরুল হক
প্রকাশক: প্রতিকথা
মূল্য: ২৫০ টাকা।