মাজিভাই
ক তো মাজি ভাই, ক তো ক্যাম্বা—কোথায় আছিস
কতদিন কুনো কথা হয় না তেমন
পোটনিতে তোর সাথে রাতবিরাত কবিতা নিয়ে
কথাও হয় না আর—তখন যে চালশূন্য ভাতের হাঁড়িটা।
কবিতারা একদিন ক্যাম্বা জীবনের খরস্রোতা নদী
হয়ে বয়ে বয়ে যেতো নগর-বন্দর!
মাজি ভাই,
কচুরিফুল তুলতে পাল্লা দিয়ে সাঁতারের খেলা
পুকুরের পচা পানিÑকী সুন্দর ফুল
কবিতার শরীরের মতো জড়িয়ে জড়িয়ে
যেতো রাতের জোস্নায়
আহা! যেন লাউডগা অষ্টাদশী কোনো রূপবতী!
রবিঠাকুরের শ্যামা নায়িকার গল্প
করতে করতে তোর সাথে কতদিন
হাঁটি না শিলিদা।
মাজিভাই, তোর কথা খুব মনে হয়
কুশোরের রসে টিনভর্তি রাতজাগা ঘুমচোখ
সেই রসে ঢেউ খেলতো আগুন—
আহা! গুড় জন্মানোর টগবগে আগুনের ঢেউ!
শামুক খেলায় মেতে ওঠা
বিস্তীর্ণ মাঠের পর মাঠ
সদরপুরের বিলে কতদিন যে সাপ গলায় জড়িয়েছি
মনে আছে তোর ওই সব?
এখন ক্যাম্বা আছিস তুই—মাজি ভাই?
মাজিভাই, তোর ভাঙা চেয়ার টেবিল
মা’র গা’র গন্ধমাখা খাট
ওসব কোথায় মিশে গেছে
তোর গলায় জড়ানো তেলচিটচিটে গামছাটা
খুব মনে আছে মাজি ভাই,
তুই কী যে যত্ন করে ছোট ভাইবোনদের রোদে ঘামানো গা
মুছে দিতি-তারপর কোলের ভেতর
নিয়ে কাঁচা তুলতুলে ফুলের মতোন…
বাতাসে ওসব গন্ধ এখন কি তোকে খোঁজে মাজি ভাই?
মাজি ভাই, তুই আজ শূন্যে বসে কী সুন্দর হেসে
হাঁটিস পথের পরে পথ—নিজের ভেতর নিজেকে লুকিয়ে
কী সুন্দর তুই সুখী একতারা হয়ে ভেসে যাস
নদীপথ আলপথ কত পথ ঘুরে ঘুরে আপন মনের সুরে,
তুই একদিন আমাকে কবি তো মাজি ভাই
শিশিরভেজা দুবলাঘাস
কেমন আপন করে ভালোবেসে পা জড়িয়ে ধরে ভোরের আলোয়
কেমন দরদ করে আঁচলভরা আকুতি করে বুকে ধরে রাখে প্রেম!
তুই কি এখনো কষ্ট পাস পাখির ছানার মৃত্যু দেখে!
এখনো কি তুই কাঁদিস নিশুতি মধ্যরাতে
এখনো কি তোর চোখে ভাসে অপমানে বাবার রোদন
এখনো কি তোর চোখে ভাসে অপমানে মায়ের রোদন
এখনো কি তোর চোখে ভাসে অপমানে পিতামহের রোদন!
আহারে সেই যে বাতাস এখনো কী ভীষণ আতর্নাদে ভেঙে পড়ে
নদীর বিশাল পাড় ভাঙার বিকট শব্দে তোর বুকে বাজে!
মাজি ভাই কোনো কথা কয় না—কিছুই তো কয় না,
মাজি ভাইয়ের চোখে কোনো আলো থাকে না—শুধুই আঁধার
মাজি ভাইয়ের বুকে কোনো ব্যথা থাকে না—অবস সমুদ্র,
মৃত মানুষ এবং মাজি ভায়ের ভেতর কোনো পার্থক্য থাকে না।
বাতাসে ব্যাকুল একতারা কেঁদে যায়
একতারা সুর এখন নিজেও মরে মরে ভেসে যায়
মাজিভাই ভেসে যায়
. ভেসে যায়
. ভেসে যায়
অথই নদীর বুকভাঙা জীবনঢেউয়ে কূল-কিনারা ঠিকানাহীন।
সন্ধ্যার কাসিদা
কুসুম দুপুরে তোমার কণ্ঠ বাজে।
বেজে ওঠে ওই দূরের জানালা পথে।
বুকের ভেতর ভিষণ আর্তনাদ।
দুমড়ে মুচড়ে ভেসে যায় ভেসে যায়।
বাতাসে বাতাসে করুণ শরীর নাচে।
কোকিল-দোয়েল তোমার কণ্ঠে গায়।
কে যেন সেদিন ডুবে ছিল বেদনায়।
দু’চোখের পানি নিয়েছিল শুষে শুষে।
ঠোঁটের রোয়ায়, চৈত্রের পিপাসায়।
যার কম্পিত বুকে মুখ ঢেকে রেখে—
দূরের দোয়েল ভেজা ডানা ঝাপটায়।
সেও ভালোবেসে রমণী তোমাকে খোঁজে—
শরীরের ঘ্রাণে খোঁজে ভোরে সন্ধ্যায়।
তাঁতের লাল শাড়িটা বুকে নিয়ে ফিরে যাচ্ছি
কেমন আছিস বোন? তোকে একদিন
তাঁতের একটা লাল শাড়ি কিনে দেবো
উঠোনের মাটি ছুঁয়ে কথা দিয়েছিলাম
উঠতি যৌবনে
তুই তার পর থেকে দিন গুনেছিস অপেক্ষার
কতদিন চলে গেছে কালের গহ্বরে
কত নদী কত দিকে নিলো বাঁক সাপের মতোন
কত পথ কত দিকে গেলো চলে এঁকেবেঁকে
কত কত ভালোবাসা জন্মালো–মরলো
শাড়িটা যখন কাছে নিয়ে দাঁড়ালাম
সকালের পুরো কাঁচা রোদ মুখে মেখে
নদীর সোনালি ঢেউ বুকে মেখে নিয়ে
দেখলি না তুই আর তাঁতের শাড়িটা
তুই এখন অনেক বড় হয়ে গেলি
ধনে-মানে-সসম্মানে…
তাঁতের লাল শাড়িটা তাই বুকে নিয়ে ফিরে যাচ্ছি।