আজও মনে পড়ে আমার কাব্যমানস গড়ার সেই প্রারম্ভিককালের কথা। আমরা ছিলাম ভাটি অঞ্চলের অধিবাসী। প্রায় বছরজুড়েই গ্রামের চারপাশ জলমগ্ন থাকতো। ৩/৪ ফুট গভীর জলের ওপর আমন ধানের সগৌরব উপস্থিতি বিস্ময়ের ঘোরে নিমজ্জিত করতো আমাকে। ভরা বর্ষায় সে ধানক্ষেতের মধ্য দিয়ে ছোট ছোট ডিঙি বেয়ে ছুটতে গিয়ে আলতো স্পর্শে আমন ধানের অস্তিত্ব পরীক্ষা করতাম প্রতিবার। আশ্চর্য এক বোধে মোহিত হতাম আমি, যা বর্ণনায় নিয়ে আসা যথেষ্ট দুরূহ।
ঢাকা চট্টগ্রাম রেল মহাসড়কের পাশেই ছিল আমাদের গ্রাম। অনতিদূরে এশিয়ান হাইওয়ে। আমাদের বাড়ির দেয়ালের এখানে-সেখানে ম্যাজিক পেন দিয়ে লেখা কৈশোরকালীন কবিতাগুলো খুঁজলে এখনো পাওয়া যাবে সেই কাব্যের ফসিল। ১৯৭৪ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষা পাস করে উচ্চশিক্ষার নিমিত্তে স্থানান্তরিত হই পার্বত্য চট্টগ্রামের কাপ্তাই নামক অনন্য নৈসর্গিক এক পরিমণ্ডলে। একে আমি স্থানান্তর বলতে চাই না। এ যেন ছিল কাব্যিক জগৎ থেকে মহাকাব্যিক পরিবেশে আমার অভিষেক। প্রকৃতির নয়নহরা রূপ আমার মনকে অশান্ত করে তোলে। প্রকৃতির মাঝে নিজেকে সঁপে দিয়ে দিন কাটে আমার। ঠিক এসময় দেখা দেয় দেশজুড়ে আকাল। প্রকট খাদ্যাভাব আর স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে চরম নৈরাজ্য নিন্দিত উত্তপ্ত আবহ। অনেকটাই দিশেহারা মানুষজন অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখি। এমন নাজুক অবস্থায় একটি রেশন দোকানে কয়েকমাস কেরানির কাজ করে অবশেষে সুইডিশ ইনস্টিটিউটে ভর্তি হই। বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের পরিচালক জনাব শহিদুল আলম এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনে ইত্যাদিখ্যাত নন্দিত তারকা হানিফ সংকেত আমার জুনিয়র সহপাঠীদের অন্যতম ছিলেন। সুইডিশ ইনস্টিটিউটে অধ্যয়নকালীন দশম ব্যাচের বন্ধুদের মধ্যে অন্যতম ছিল ফিরোজ, মোবারক, ঝন্টু, গাফ্ফার, নজরুলসহ অনেকেই। আমার সদ্য প্রকাশিত ‘পাহাড়ি কন্যার উপাখ্যান’ উপন্যাসে কাপ্তাইয়ের সেসব স্মৃতি চিত্রিত করা হয়েছে।
এভাবেই আমাদের জীবন কিংবা কাব্যিক মহাজীবন ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে হিম-শীতল মৃত্যুর দিকে ক্রমশ অগ্রসর হওয়ার জন্য।
সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই কাপ্তাই। পাহাড়, নদী ও লেকবেষ্টিত একটি বৈচিত্র্যময় জনপদ, যার অদূরে কি নাতিদূরে চাকমা, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, ত্রিপুরা, মুরং, বোম, খুমি, খেয়াং, চাক্, পাংখোয়া, লুসাই, সুজে সাওতাল, রাখাইন সর্বোপরি বাঙালিসহ ১৪টি জনগোষ্ঠির বসবাস। ভৌগলিক বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্য এবং বিভিন্ন ধর্মবর্ণ, ভাষা, সংস্কৃতির সম্মিলনযোগ করেছে এক ভিন্ন মাত্রা। কাপ্তাইজুড়ে যেন সৌন্দর্যের ছড়াছড়ি আর বহুমাত্রিকতা। যেন নিমিষেই খুলে গেলো হৃদয়ের অর্গল। আর সেই খোলা বাতায়ন দিয়ে নতুনভাবে উপলব্ধি করতে শুরু করলাম জীবনকে। বহু বর্ণের বহু ভাষাভাষী মানুষের সংস্পর্শে এসে আমার চরিত্রে যোগ হলো অন্য রকম এক অস্থির বৈচিত্র্যময়তা। কাপ্তাইয়ের লেখাপড়ার পাঠ শেষ করে ১৯৮০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিবন্ধিত ব্রিনেল করপোরেশন নামক জলবিদ্যুৎ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের কনিষ্ঠ প্রকৌশলী হিসেবে কাজে যোগ দেওয়ার কয়েকমাসের মধ্যেই বেকার জীবনের সূত্রপাত। তৎকালীন সৌদি আরবসহ মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে আমেরিকার একপ্রকার টানাপড়েন শুরু হলে প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর আমি স্থিত হলাম চট্টগ্রামে। ওই সময়েই প্রথম কবিতা ছাপা হলো চট্টগ্রামের প্রথম সারির দৈনিক আজাদীতে ‘বৈরুত তুমি কেমন আছো’ শিরোনামে।
নানা ঘাত, প্রতিঘাত, সংকট ও প্রতিকূলতা প্রতিহত করে জীবনকে টেনে নিয়ে এসেছি এই অবধি। এসময়ের ভেতর নদীতে জল গড়িয়েছে অনেক, ঝরে গেছে জীবন নামক বৃক্ষ থেকে অনেকগুলো পাতা। অত্যন্ত পরিতাপের সঙ্গেই বলতে হয় ২০০৪ সালের আগ পর্যন্ত লেখা কোনো কবিতাই যথাযথভাবে সংরক্ষণ না করার কারণে সেগুলোর অস্তিত্ব আজ আর নেই। ২০০৫ সালে চট্টগ্রামের বলাকা প্রকাশনের স্বত্বাধিকারী শরীফা বুলবুল ও জামাল উদ্দিনের সক্রিয় সহযোগিতায় প্রথম তিনটি কাব্যগ্রন্থ অমর একুশে বইমেলায় আলোর মুখ দেখে। কবি জাহিদুল হক, কবি নির্মলেন্দু গুন এবং আমার একমাত্র কন্যা আফরোজা ইয়াসমিন টুম্পাকে উৎসর্গ করা কাব্যগ্রন্থগুলো ওই সময়ে পাঠকমহলে বেশ সমাদৃত হয়েছিল।
আমার চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ ‘কাঁদে পর্বত ঝরে বৃষ্টি’ মূলত আদিবাসীদের সুখ-দুঃখ, হতাশা আর বিরহের চিত্রগুলো পঙক্তিবদ্ধ করে চিত্রিত করার এক দুঃসাহসী প্রয়াস ছিল। আগেই বলেছি আমার কৈশোর আর যৌবনের একটা সময় পাহাড়ি জনপদে অতিবাহিত করেছি লেখাপড়ার তাগিদে। তখন থেকেই তাদের হাসিকান্নার প্রত্যক্ষ সাক্ষী হিসেবে বড় হয়ে কিছু করার চিন্তা আমার মাথায় গোপনে গোপনে কাজ করতো। সেই গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত কবিতাগুলো নিছক দায় এড়ানোর মতো ছিল না। কবিতাগুলো ছিল আদিবাসী জনগণের জন্য প্রেরণার উৎসমূল।
আমার বন্ধু এবং সেই সময়কার সেনাকল্যাণ সংস্থার উপ-মহাব্যবস্থাপক সফিকুল ইসলাম গ্রন্থটি প্রণয়নের ব্যাপারে যথেষ্ট উৎসাহ দিয়ে আমাকে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছিলেন। সে ভালোবাসা অমর আর অম্লান হয়ে আজও টিকে আছে অকৃত্রিম। কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, কবি আল মুজাহিদী এবং প্রখ্যাত আদিবাসী নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে বইটি যৌথভাবে উৎসর্গ করেছিলাম। বন্ধু ও স্কাইল্যান্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহিউদ্দীন আহমদের সক্রিয় সহযোগিতায় তার নরসিংদীর শিল্পপ্রতিষ্ঠানসহ আশপাশের অনেক প্রতিষ্ঠানে সে সময়ে অজস্র আদিবাসী ছেলেমেয়েকে পুনর্বাসনে আমার ব্যক্তিগত উদ্যোগ ছিল লক্ষ করার মতো। আমার অনেক কবিতা সেই প্রতিষ্ঠানে অবস্থানকালীন সময়ে রচিত।
ইতোমধ্যে কবিতা আমার ধ্যান জ্ঞান হয়ে রক্তে মাংসে আর শরীরের সমূদয় স্নায়ুতন্ত্রে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। কবিতার মোহে কবিতার টানে প্রায়শই ঢাকায় আসি। অতপর যথারীতি আড্ডা শেষ করে চট্টগ্রামে ফিরে যাই। এ প্রসঙ্গে কয়েকজন আলোকিত মুখের কথা না বললে আমার সাহিত্যজীবন বহুলাংশে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। প্রথম দিকটায় কবি জাকির আবু জাফর বলতে গেলে একাই আমাকে আগলে রেখেছিলেন। আমি স্থায়ীভাবে ঢাকায় চলে আসার জন্য কবি জাকির আবু জাফরের ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। আমার রচিত ‘ছিন্নভিন্ন পঙ্ক্তিমালা’ কাব্যগ্রন্থ কবি জাকির আবু জাফরকেই উৎসর্গ করেছিলাম।
আর ফজল শাহবুদ্দীনের কথা কী লিখবো কাগজে। তিনি ছিলেন হৃদয়ের মণিকোঠায় অবিনশ্বর। আমাদের মাথার মুকুট কবি ফজল শাহবুদ্দীন। ফজল ভাই তখন পুরানা পল্টন হারুন এন্টারপ্রাইজের অফিসে বসতেন। প্রায় একযুগ আমরা চারজনের যেকোনো দু’জনকে ছাড়া বিশেষ কোনো ব্যতিক্রম ব্যতিরেকে ফজল ভাই মধ্যাহ্ন ভোজেও বসতেন না। আমি, বন্ধু কবি শাহীন রেজা, সতীর্থ কবি জাকির আবু জাফর, কবি জামসেদ ওয়াজেদ। আমার কবি হয়ে ওঠা কিংবা সম্পাদকের ছবক নেওয়া থেকে শুরু করে অত্যাবশ্যকীয় অনেক কিছুই আমি শিখেছি ফজল ভাইয়ের কাছে। একবার আমি চট্টগ্রামে বসে ফজল ভাইকে নিয়ে একটি সনেট লিখে কবি শাহীন রেজাকে টেলিফোন করে শুনানোর পর শাহীন ভাই পরামর্শ দিলেন ঢাকায় এসে এ সনেট নিয়ে আলোচনা করতে। যথারীতি আমি ঢাকায় এসে ফজল ভাইয়ের অফিসে আড্ডায় বসলাম। বেশ কয়েকবার ফজল ভাই সনেটটি পড়ার পর আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। ফজল ভাইকে নিয়ে উপর্যুপরি অনেকগুলো সনেট ওই সময়ে লিখেছিলাম। মাঝেমধ্যে আমার কেমন যেন মনে হচ্ছিল ফজল ভাই আর বেশি দিন আমাদের মধ্যে নেই। আমি একটি বেসরকারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব নিয়ে ত্রিশাল চলে গেলেও সপ্তাহে দু’একবার ফজল ভাইয়ের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ হতো। একদিন আমি অনুরূপ একটি সনেট ফজল ভাইয়ের সামনেই তার অফিসে বসে লিখে ফেললাম। সনেটটি পড়ে ফজল ভাইয়ের অশ্রুজল অবলোকন করে আমিও কেঁদেছিলাম অঝোরে। কবিতাটি ফজল ভাই তার বাসায় নিয়ে যান। সেখানেও কান্নার রোল পড়ে যায়।
ফজল ভাইয়ের মৃত্যুর কিছু দিন পূর্বে অনন্যা থেকে প্রকাশিত হয় তার কবিতা সমগ্র। কবিতা সমগ্র প্রকাশের সময় আমি আর কবি জাকির আবু জাফরের অক্লান্ত শ্রমের কথা অনন্যার মনির ভাই খুব ভালোই জানেন। এভাবেই আমাদের জীবন কিংবা কাব্যিক মহাজীবন ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে হিম-শীতল মৃত্যুর দিকে ক্রমশ অগ্রসর হওয়ার জন্য।
আজ জীবনের অপরাহ্নবেলায় দাঁড়িয়ে পিছনের দিকে তাকিয়ে অকুতোভয় সৈনিকের মতো দৃপ্তকণ্ঠে উচ্চকিত হয়ে বলতে চাই, হে কবিতা। তোমার জন্য অনেক স্বাদ আহলাদ পরিত্যাগ করেছি। উৎসর্গ করেছি একটি পুরো জীবন আপসহীন।
কবি প্রাকৃতজ শামিম রুমি টিটন, আমার বন্ধু এবং কেবলই বন্ধু। বন্ধুত্ব যেন এক বহতা নদী। অজস্র জল বুকে ধরে প্রবাহিত হয় নৈস্বরী শব্দে সমুদ্র অভিসারে। সেই বাল্যকালের পড়া আজো মনে যায়। নদী কভু নাহি করে পান নিজ নিজ জল। নদী এবং জল। জল এবং নদী। বহতা জল বয়ে যায় নদীর বুক চিরে চিরে সমুদ্র অবগাহনে অনন্তর। নদী চিরযৌবনা লাস্যময়ী নারীর মতো নান্দনিকতার মূর্তিময়ী অবয়ব। বন্ধুত্বের মতো নদীতে বন্ধ্যাত্ব এলে নদীর দুঃখের আর সীমা থাকে না। নদীর বুক দখল করে নেয় শেওলা জাতীয় বিশেষ অপাঙ্ক্তেয় গুল্ম। মানুষের জীবন যেন প্রবহমান সেই নদী। বুকে ভালোবাসা ধরে তর তর করে এগিয়ে যায় জীবনের পরিসমাপ্তির দিকে। থেকে যায় তার রোপিত সেই বৃক্ষ। সেই বৃক্ষের সুশীতল ছায়া আর সৌরভে ভাস্বর শোভা। জীবনের মহত্তম গুণগুলোকে প্রতিনিয়ত পরিচর্যা করে যেতে হয়। আর তা না হলে সেই স্রোতরুদ্ধ হওয়া নদীর মতো একসময় থেমে যেতে হয় জীবন চলার পথ। আর কল্যাণকামী এ জীবন সুন্দর সার্থক এবং উপভোগ্য করার জন্য দরকার বুদ্ধিমত্তায় শক্তিমান কিছু পরোপকারী বন্ধু। শামিম রুমি টিটন সে রকমই একজন বন্ধু আমার।
যাপিত এই ক্ষুদ্র জীবনে অনেকের কাছেই আমি ঋণী। মানিকগঞ্জের সুদীর্ঘ কালের মেয়র এবং উপমহাদেশের প্রখ্যাত শিক্ষানুরাগী আমার বন্ধু রমজান আলীর কথা এখানে উল্লেখ করতেই হয়। বাংলাদেশ চলচিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের পরিচালক, বন্ধু আবুল কালাম মোহাম্মদ শামসুদ্দিন এবং বন্ধু জাকির হোসেন চৌধুরীর কাছে আমার অনেক ঋণ। প্রখ্যাত রেখাবিদ জনাব হামিদুল ইসলাম, কবি আলমগীর রেজা চৌধুরী, গোয়েন্দা লেখক, কবি রহমান শেলী, কবি জামসেদ ওয়াজেদ, কবি আবু হেনা আবদুল আউয়াল প্রমুখ কবিদের নাম আমি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি। আবদুল মোনেম লি. চট্টগ্রামের প্রাক্তন আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক বোরহান উদ্দীন আহমেদ, যার কথা না বললেই নয়। বোরহান এবং তার প্রতিষ্ঠানের হারুন কবিতা সৃজনের প্রারম্ভিককালে একপ্রকার আমাকে বাধ্য করতেন কবিতা সৃজনে। আর সে সময়ে তারাই ছিলেন আমার কবিতার একনিষ্ঠ পাঠক ও সুহৃদ।
প্রতিষ্ঠিত বিমা ব্যক্তিত্ব আমার বন্ধু জামাল আবু নাসের, ছায়েদুল হক করোনা মহামারীর শিকার হয়ে আমাদের ছেড়ে এ নশ্বর এ পৃথিবী ছেড়ে পরলোকে পাড়ি জমান। বেসরকারি কর্মকর্তা হাশিম ভূঁইয়া, গীতিকার মহিউদ্দীন আহমেদ রুবেল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাংবাদিক আবু নছর, প্রকৌশলী ইউচুপ চৌধুরীসহ অনেকেই ছিলেন আমার সহপাঠী। আমার বন্ধু সৈয়দ আহমেদ খান। পরম হিতৈষী এ বন্ধু রওশন গার্ডেনের রূপকার। বিপদে আপদে ইদানীংকালে তিনি থাকেন আমার ছায়াসঙ্গি হয়ে।
জন্ম আমার কুমিল্লা হলেও চট্টগ্রামের নিকট আমি বহুলাংশে ঋণী। জীবনের অধিকাংশ সময় চট্টগ্রামেই অতিবাহিত করছি। এখানেও আমি কিছু অকৃত্রিম বন্ধুর সহচার্য লাভ করেছি। কবি ওমর কায়সার, কবি নাজিম উদ্দিন শ্যামল, আন্দরকিল্লা সম্পাদক নুরুল আফসার অন্যতম।
মানুষের ইতিহাস খুব প্রাচীন হলেও এ পৃথিবীতে প্রকৃত মানুষের সংখ্যা খুবই কম। প্রকৃত মানুষেরাই নিজের শ্রমে ঘামে মেধার সমন্বয়ে ইতিহাস গড়ে এক পর্যায়ে নিজেই হয়ে যান ইতিহাস কিংবা কিংবদন্তি। আলোকিত অন্য সব মানুষেরা সেই ইতিহাস লিখে রাখে কালের পাতায়, লিখে রাখে তাদের নাম। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে দেখা মেলে এসব সুবর্ণ মানুষের প্রীতিময় প্রসন্নমুখ । তারা নিজের জীবনকে নির্মাণ করেন, তিলে তিলে গড়ে তোলেন নিজস্বতায়। ইতিহাসখ্যাত এসব মানুষই একটি সমাজের, একটি দেশের এবং বিশ্বের বুকে এঁকে রাখেন নিজের পদচিহ্ন। দিয়ে যান নতুন কিছু, নতুন নতুন ভালোবাসা। নতুন কিছু মানেই নতুন আনন্দ, নতুন স্বপ্ন, নতুন কল্পনার আকাশ। পুরনো এ পৃথিবীতে নতুন এই অবদান মানুষকে ফিরে দেখতে বাধ্য করে। মানুষ দেখে, স্মরণ করে, ভাবে । ভাবতে ভাবতে তারাও পেয়ে যান নতুনের সন্ধান । এভাবে নতুনের ভেতর দিয়ে পৃথিবীর অগ্রযাত্রা বহমান। সময় আসে, সময় যায়। মানুষ আসে মানুষও যায়। কিছু কিছু মানুষ সময়ের বুকে রেখে যান তাদের উজ্জ্বল চিহ্ন। মহাকাল তাদের রেখে দেয় নিজের বুকের ভেতর। এমন কালান্তরের যাত্রী, যাকে নিয়ে আমাদের এ কর্মযজ্ঞ তিনি আমাদের পরম বন্ধু মোঃ আবু সাইদ। জীবনের এ পড়ন্ত বেলায় আবু সাইদ যেন এক নিয়ামক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পাসপোর্ট ও বহিরাগমন অধিদপ্তরের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে নয়, আমি তাকে চিনি একজন মানবিক কর্মকর্তা হিসেবে। বন্ধুত্বের ঋণ কখনো শোধ করা যায় না। আমি তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে একখানা সংকলন সম্পাদনা করে ঋণের বোঝা হালকা করার চেষ্টা করেছি।
কিছু কিছু মহিয়সী নারীর অনুপ্রেরণার কথা সশ্রদ্ধ চিত্তে উল্লেখ করা বাঞ্চনীয়। কেউ কেউ তাদের নাম এখানে মুদ্রণ না করার জন্য সবিশেষ অনুরোধ করেছিলেন। মিরপুর প্রিপারেটরি গ্রামার স্কুলের স্বনামধন্য শিক্ষক মাহবুবা বেগম, শিখা চৌধুরী, ঘনিষ্টতম বন্ধু কবি মালেকা ফেরদৌস তাদের মধ্যে অন্যতম। এদের কারও কারও সঙ্গে আমার সম্পর্ক যতটুকু ভালোবাসাবাসির, তার থেকে ঢের ভুল বোঝাবুঝির। সবকিছু ছাপিয়ে এরা বন্ধু হিসেবেই সুপ্রতিষ্ঠিত এবং আমাকে অবিরাম দিয়ে যাচ্ছে অবিমল ছায়া সংবলিত প্রেরণা। কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক জয়া সূত্রধরের কথা এখানে অল্প পরিসরে বর্ণনা সম্ভবপর নয়। কিছু কিছু মনুষ্য হৃদয় জীবনের শেষ অবধি নিজকে অবারিত করে দেয় অপরের কল্যাণে। এদের আমি কোন অভিধায় অভিহিত করবো! আমার কবিতা যাপনের অমসৃণ সড়কে কবিতার অরক্ষিত অরণ্যে এরা প্রকৃত অর্থেই আমার রক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে আমাকে আলোকিত করে যাচ্ছেন অবলীলায়। এ বন্ধুগণ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মহান পাঠদানে নিবিষ্ট। আমার বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থ তাদের উৎসর্গ করে ঋণের বোঝা হ্রাস করতে চেয়েছি বটে বস্তুত তাদের ঋণ প্রকৃত অর্থেই অপরিশোধযোগ্য।
নিজের ব্যক্তি জীবনের কথা লিখার প্রাক্কালে আজ আরও অনেক কথাই মানসপটে ভেসে উঠছে। কবিতা লিখতে গিয়ে জীবন থেকে গত হয়েছে অনেক সময়। আমার পরিবার কখনোই আমি কবি হয়ে ওঠার স্বপক্ষে ছিলেন না। এরা সবসময়ই আমাকে কবিতা লিখতে নিরুৎসাহিত করতেন। আজ জীবনের অপরাহ্নবেলায় দাঁড়িয়ে পিছনের দিকে তাকিয়ে অকুতোভয় সৈনিকের মতো দৃপ্তকণ্ঠে উচ্চকিত হয়ে বলতে চাই, হে কবিতা। তোমার জন্য অনেক স্বাদ আহলাদ পরিত্যাগ করেছি। উৎসর্গ করেছি একটি পুরো জীবন আপসহীন।