খারাপ লেখক বেশি দিন টিকে থাকতে পারে না : তপন বাগচী


তপন বাগচী। কবি, প্রাবন্ধিক, ফোকলোরবিদ। জন্ম ১৯৬৮ সালের ২৩ অক্টোবর। মাদারীপুর। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : কবিতা: নির্বাচিত ১০০ কবিতা (২০১০), সকল নদীর নাম গঙ্গা ছিল (২০০৭), অন্তহীন ক্ষতের গভীরে (২০০৫), শ্মশানেই শুনি শঙ্খধ্বনি (১৯৯৬), কেতকীর প্রতি পক্ষপাত (১৯৯৬); ছড়াগ্রন্থ: ছন্দোবদ্ধ ভাবের পদ্য (২০১২), সকালবেলা স্মৃতির ভেলা (২০১১), সমকালে তমকালে (২০১০), খাচ্ছে ছুটি লুটোপুটি (২০০৯), মঙ্গা আসে ঘরের পাশে (২০০৮),স্বপ্নেবোনা তূণীরসোনা (২০০৭), চরকাবুড়ি ওড়ায় ঘুড়ি (১৯৯৫), রুখে দাঁড়াই বর্গী তাড়াই (১৯৯৪); কিশোরগল্প : সাতদিনের সাতকাহন (২০১১), শুভর শখের গোয়েন্দাগিরি (১৯৯৩); প্রবন্ধ: সাহিত্যের এদিক-সেদিক (২০১৩), সাহিত্যের কাছে-দূরে (২০১৩), রবীন্দ্রনাথ ও বৌদ্ধ আখ্যান (২০১২), লালন মতুয়া লোকসংগীত সন্ধান (২০১২), সংবাদের ভাষা ও সাময়িকপত্র পর্যালোচনা (২০১২), সাহিত্যের মধ্যমাঠ থেকে (২০১২), রবীন্দ্রসাহিত্যে নতুন প্রেক্ষণ (২০১২), কিছু স্মৃতি কিছু ধৃতি (২০১১), সাহিত্যেও সঙ্গ ও অনুষঙ্গ (২০১১), চলচ্চিত্রের গানে ডক্টর মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান (২০১০), লোকসংস্কৃতির কতিপয় পাঠ (২০০৮), বাংলাদেশের যাত্রাগান: জনমাধ্যম ও সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত (২০০৭), মুক্তিযুদ্ধে গোপালগঞ্জ (২০০৭), রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ: চন্দ্রাহত অভিমান (২০০২); সাহিত্যের সাম্প্রতিক পাঠ (২০০১), নির্বাচন সাংবাদিকতা (২০০১), নজরুলের কবিতায় শব্দালঙ্কার (২০০০), তৃণমূল সাংবাদিকতার উন্মেষ ও বিকাশ (১৯৯৯); জীবনী: বিপ্লব দাশ (২০০১), রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ (১৯৯৮)। সম্পাদনা : আনন্দনাথ রায়ের ফরিদপুরের ইতিহাস (২০০৮), অম্বিকাচরণ ঘোষের বিক্রমপুরের ইতিহাস (২০০৮)।

সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় অবদানের জন্য পেয়েছেন সাংস্কৃতিক খবর পদক (কলকাতা, ২০১৩), অনুভব সাহিত্য পদক (২০১৩), মহাকবি মাইকেল মধুসূদন পদক (২০১২), নতুন গতি সাহিত্য পুরস্কার (কলকাতা, ২০১১), বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ ফেলো, ঢাকা (২০১০), সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সাহিত্য পুরস্কার (২০০৯), কবি বাবু ফরিদী সাহিত্য পুরস্কার (২০০৯), ফরিদপুর সাহিত্য পরিষদ সম্মাননা (২০০৯), মহাদিগন্ত সাহিত্য পুরস্কার (২০০৮ কলকাতা), এম নূরুল কাদের শিশুসাহিত্য পুরস্কার (২০০৮), জেমকন সাহিত্য পুরস্কার (২০০৮), অমলেন্দু বিশ্বাস স্মৃতি পদক (২০০৮), পাক্ষিক মুকসুদপুর সংবাদ সংবর্ধনা, গোপালগঞ্জ (২০০৭), জসীমউদ্দীন গবেষণা পুরস্কার (১৯৯৬), মুনীর চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯১)। এবার লোকসাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য পেয়েছেন বগুড়া লেখক চক্র-২০২১ পুরস্কার। লেখালেখি ও পুরস্কারপ্রাপ্তি নিয়ে চিন্তাসূত্রের সঙ্গে কথা বলেছেন এই লেখক।

চিন্তাসূত্র: লোকসাহিত্যে পাচ্ছেন ‘বগুড়া লেখক চক্র-২০২১’ পুরস্কার। কেমন লাগছে আপনার? সাহিত্য পুরস্কার কি লেখককে যথার্থভাবে মূল্যায়ন করে?
তপন বাগচী: পুরস্কার মানেই ভালোবাসা। আমি ভালোবাসা দিতে জানি। ভালোবাসা নিতে তাই কার্পণ্য করি না। বগুড়া লেখক চক্র একটি ঐতিহ্যবাহী সংগঠন। মহাদেব সাহা, আতাউর রহমান, ফারুক সিদ্দিকী, কাজী রব, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মাকিদ হায়দার, মঞ্জু সরকার, হোসেনউদ্দিন হোসেন, রফিকুর রশীদ, গোলাম কিবরিয়া পিনু, আসলাম সানী, আহমেদ স্বপন মাহমুদ, শামীম রেজা, মোহাম্মদ নূরুল হক প্রমুখ খ্যাতিমান সাহিত্যিক যে পুরস্কার পেয়েছেন, তা এবার আমার হাতে উঠবে জেনে গৌরব বোধ করছি। পুরস্কার সব সময়েই আপেক্ষিক বিবেচনা। তাই কোনো পুরস্কারেরই যথার্থভাবে মূল্যায়নের সুযোগ নেই। পুরস্কার একটি সাময়িক স্বীকৃতি। জনসমক্ষে শনাক্ত করার এক উপায়। চিরকালীন স্বীকৃতি হলো পাঠাকের ভালোবাসা। সেটিই প্রকৃত পুরস্কার।

চিন্তাসূত্র: বাংলা একাডেমির সাহিত্য পুরস্কার নিয়ে সম্প্রতি সাহিত্যপ্রেমীদের মধ্যে নেতিবাচক ধারণার জন্ম হয়েছে। এজন্য আপনি কাকে দায়ী করবেন?
তপন বাগচী: কোনো পুরস্কারই সমালোচনার ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। নোবেল পুরস্কার নিয়েও কথা ওঠে। এতে ওই পুরস্কারের গ্রহণযোগ্যতাই প্রমাণিত হয়। ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার নিয়ে সম্প্রতি সাহিত্যপ্রেমীদের মধ্যে নেতিবাচক ধারণার জন্ম হয়েছে’ বলে আপনার ঢালাও মন্তব্য আমি মানতে পারছি না। বাংলা একাডেমি কেবল আমার কর্মক্ষেত্রই নয়, আমি সাহিত্যের একজন সেবক হিসেবে ছাত্রজীবন থেকেই এর গতিবিধি লক্ষ করেছি। কারও পছন্দের লেখক পুরস্কার না পেলে, একটু তো নেতিবাচক ধারণা তার হবেই। কিংবা নিজে না পেলে প্রচার করে যে তাকে না দিয়ে অন্যকে দেওয়া হয়েছে। পুরস্কার যাকেই দেওয়া হোক কিছু লোক তার বিরুদ্ধে বলবেই। পরের বছর যদি সেই লেখক পুরস্কার পেয়ে যান, তখন তারাই আবার একাডেমির গুণকীর্তন করে। আপনার ঢালাও মন্তব্যে যে নেতিবাচকতার কথা বলেছেন, তা যদি গুটিকয় সাহিত্যপ্রেমীর মধ্যে যদি জন্ম নিয়ে থাকে, তবে তা বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারের প্রতি তাদের গভীর আগ্রহকেই নির্দেশ করে। এর জন্য দায়ী যদি আপনি কাউকে করতেই চান, তা হচ্ছে এই পুরস্কারের গ্রহণযোগ্যতা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই পুরস্কারটিই সবেধন নীলমণি, তা যেকোনো সাহিত্যিকেরই প্রার্থিত। তাই নিজে না পেলে কাউকে দায়ী করে বিকৃত আনন্দ লাভ করেন। তাতে প্রতিষ্ঠানের কিছু যায়-আসে বলে মনে করি না।

চিন্তাসূত্র : আপনি দীর্ঘদিন ধরে লিখছেন। লিখতে গিয়ে অনেকের লেখাই পড়েছেন। একটি সার্থক লেখার বৈশিষ্ট্য কী হওয়া উচিত বলে মনে করেন?
তপন বাগচী: হ্যাঁ, আমি গ্রোগ্রাসে পাঠ করি। সাধারণের কাছে যা পাঠ্য নয়, আমিও সমান মনোযোগে পাঠ করি। পেশাগত প্রয়োজনে অনেক বই প্রকাশের আগেই আমার পড়তে হয়। সে-ই লেখাই সার্থক বিবেচনা করি, যা পাঠের পরেও রেশ থেকে যায়। মস্তিষ্কে অনুরণন তুলতে পারে যে লেখা, সে লেখাকেই আমি সার্থক মনে করি। এই বৈশিষ্ট্য এমন যে, সাধারণ পাঠকও তা উপলব্ধি করতে পারেন।

চিন্তাসূত্র: আপনি সাহিত্যের অনেক শাখায় কাজ করছেন। তাই সমকালীন কবিতা, গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ সম্পর্কে আপনার অভিমত জানতে চাই।
তপন বাগচী: সমকালীন কবিতার ভাষা দুর্বোধ্য হয়ে উঠেছে। কবিরা বোঝাতে চান যে তিনি, সময়ের থেকে এগিয়ে। কিন্তু প্রকারান্তরে তিনি পাঠক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছেন, এই খেয়াল তার নেই। কবিতার যে হাজার বছরের ঐতিহ্য, ছন্দ-অলঙ্কার, তা অনায়ত্ত করেই অনেকে কবি হতে চাইছেন। কবিতার জন্য তা ক্ষতিকর হয়ে উঠেছে। গল্পের মধ্যে আমি গল্প পাই না। গল্পহীনতাই নাকি এখনকার সময়ের গল্প। আমি এই গল্পের ভেতরে ঢোকার আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। উপন্যাসের ক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্নতর। সিরিয়াস উপন্যাস কিছু পাচ্ছি আমরা। প্রবন্ধ তো মৌলিকতা হারিয়েছে অনেক আগেই। প্রবন্ধের নামে যা ছাপা হচ্ছে, তা তো পর্যালোচনা আর দুর্বল গবেষণার সংক্ষিপ্ত বিবরণ। এই মন্তব্য থেকে আমার যেটুকু অযোগ্যতা প্রকাশিত হয়েছে, ওইটুকুই আমার অর্জন।

চিন্তাসূত্র: এই সময়ের কবিদের মতে, সমকালীন সমালোচনা সাহিত্য অনেকটাই দুর্বল, বেশিরভাগই লেখকের গুণগান আর সম্পর্কের চর্চা। এ সম্পর্কে আপনি কী বলবেন?
তপন বাগচী: এই সময়ের কবিরা এই মত কোথায় প্রকাশ করেছে? এটি আসলে প্রশ্নকর্তার বিবেচনা, যা কবিদের বরাতে প্রকাশিত। তো, সমস্যা নেই তাতে। প্রশ্নটি চমৎকার। সমকালীন সমালোচনাসাহিত্য অনেকটাই দুর্বল যদি কেউ মনে করে, তবে কি সে আগের সমালোচনাসাহিত্যকে সবল মনে করে? তারও আগে আমার প্রশ্ন, এই সময়ের কবিরা কি সমালোচনা সহ্য করতে পারে? আমি কবিতাও লিখি, সমালোচনাও করি—তাই দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্নটি করছি। আমার পরের দশকের এক কবি ফেসবুকে একটি কবিতা পোস্ট করলেন। সবাই দেখছি প্রশংসার বন্যায় ভাসিয়ে দিচ্ছে। আমি দেখলাম দুটি চরণে ছন্দ মার খেয়েছে। খুব বিনয়ী বচনে তা মন্তব্যের ঘরে লিখে দিলাম যে ওই দুটি চরণ ঠিক করা হলে ওটি একটি অসাধারণ কবিতা। কবি জবাব দিলেন, ‘আমি তো ছন্দে লিখিনি’। তার মানে সে ছন্দ জানে এবং ছন্দ মেনে লিখলে তার ভুল হতো না, এমন একটি ভাব। গতকালই পাঞ্জেরী প্রকাশনীর একটি বই হাতে এলো। ওই কবিরই লেখা ছড়ার বই। দেখলাম, ছন্দে ভুল আছে, অন্ত্যমিলেও ভুল আছে। তার মানে সেই কবি ছন্দই জানে না। অথচ বড়াই করতে জানে। এখন আমি তার ওই ছড়ার বই নিয়ে লিখলে তো সে সহ্য করতে পারবে না। কবিসমাজে তার ভাবমূর্তি নষ্ট হবে বলে আমি তা লিখব না। তাকে আমি ভালোবাসি।

কিছু দিন আগে প্রথম দশকের এক কবি একটি পুরস্কার প্রদানের অনুষ্ঠানের কার্ড পোস্ট করেছে ফেসবুকে। দেখলাম প্রথম বাক্যটি ভুল। আমি ভালবেসে কমেন্ট করেছি, ‘প্রথম বাক্যটি আবার দেখো, কবি’। কিছুক্ষণ পরেই ফোন করে আমাকে বলে, ‘আপনি কি বানান দেখার ইজারা নিছেন নাকি? আপনি তো অষ্টম গ্রেডের লেখক। আপনি আমার সমালোচনা করেন কোন সাহসে?’ আমি জবাবে শুধু বললাম, ‘তুমি যে মাসে টাকা ধারা নিয়েছে, সেটি ফেরত না-দেওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত করছ?’ ওই কবি অনেকের কাছ থেকেই টাকা ধার করে চলে। টাকা ফেরত দেওয়ার ভয়ে এরকম অপমানসূচক কথা বলে সম্পর্ক নষ্ট করে। এরা আবার কবি হয় কী করে? একলাইনের সমালোচনা সহ্য করার ক্ষমতা নেই এই সময়ের কবিদের অনেকেরই। বিনয় মজুমদারের ভাষায় বলতে হয়,

ভালোবাসা দিতে পারি, তোমরা কি গ্রহণে সক্ষম?
লীলাময়ী করপুটে তোমাদের সবই ঝ’রে যায়–
হাসি, জ্যোৎস্না, ব্যথা, স্মৃতি, অবশিষ্ট কিছুই থাকে না।
এ আমার অভিজ্ঞতা। পারাবতগুলি জ্যোৎস্নায়
কখনো ওড়ে না; তবু ভালোবাসা দিতে পারি।

‘বেশিরভাগই লেখকের গুণগান আর সম্পর্কের চর্চা’ সম্পর্কে আমার ধারণা হলো—এ ছাড়া উপায় কী? দোষ বের করলে যখন সহ্য করত পারে না, তখন গুণগান করাই শ্রেয়। তাহলে এর জন্য দায়ী তো ওই কবিই। সে তো সমালোচনা পছন্দ করে না, অথচ প্রচার চায়। ‘সম্পর্কের চর্চা’ দোষের কিছু? অসম্পর্কের কাউকে কি আমরা ঘরে ঠাঁই দেই? তাই সম্পর্ক থাকাটা দোষের নয়। দোষের হলো, আত্মীয়-বন্ধু বলে একটি খারাপ বইকেও ভালো হিসেবে প্রতিপন্ন করা। সেই দোষ অবশ্যই সমালোচকের। কিন্তু আমাদের দেশে সমালোচনার ধারা-ই তো তৈরি হয়নি, লেখকদের অসহিষ্ণুতা এবং সম্পাদকদের অনাগ্রহের কারণে। এখন ভালো সমালোচকও অন্তর্হিত হয়ে গেছেন।

চিন্তাসূত্র: বর্তমান ফেসবুক ও অনলাইন পোর্টালের কল্যাণে সাহিত্যচর্চা যেমন বেড়েছে; তেমন সাহিত্যের চৌর্যবৃত্তিও বেড়েছে। এর থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় আছে?
তপন বাগচী: হ্যাঁ চর্চা বেড়েছে। যা লেখা হোক, তা প্রকাশের সুযোগ বেড়েছে। কিন্তু এই সুযোগে আবর্জনাসৃষ্টি ও চৌর্যবৃত্তিও বেড়েছে। এখন শতশত পোর্টালের মধ্যে যোগ্য সম্পাদক আছেন বড়জোর ৫ জন। ভালো সম্পাদকের অভাবে এই আবর্জনা ও চুরি করা মাল প্রকাশের আধিক্য দেখা যাচ্ছে। এর থেকে পরিত্রাণের একটিই উপায় হলো ‘অপেক্ষা করা’। খারাপ লেখক বেশি দিন টিকে থাকতে পারে না। দুর্বল লেখা দ্রুতই অপসৃত হয়। ভালো লেখাই টিকে থাকে।

চিন্তাসূত্র: আপনি কি সাহিত্যে দশক বিভাজনে বিশ্বাস করেন? সাহিত্যে দশক বিভাজন কি খুবই গুরুত্বপূর্ণ? যদি বিশ্বাস করেন, তবে নিজেকে কোন দশকের বলে দাবি করেন?
তপন বাগচী: আমি যখন কবিতা লিখি তখন দশকের কথা মাথায় থাকে না। যখন আলোচনা বা বিশ্লেষণ করতে যাই তখন দশক বিভাজনের কথা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করি। মনে করা হয়, দশক বা দশবছর এখানে আলোচনা বা শ্রেণীকরণের একটি পরিমাপক মাত্র। সেটি কেবল সাহিত্য নয়, ক্রীড়া কিংবা রাজনীতির ক্ষেত্রেও এই দশকের প্রসঙ্গ আসে। আলোচনার জন্য সময়-নির্দেশক এই ‘দশক’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ধরুন আমি নির্মলেন্দু গুণের কবিতা নিয়ে আলোচনা করতে চাই। তখন তার সময় অর্থাৎ ষাটের দশক এবং সমকালীন কবিদের কথাও তো আসবে। এখন যারা এই দশকবিভাজনকে কটাক্ষ করে কথা বলে, তাদের মননের দারিদ্র্য আছে বলে ভ্রম হয়।

আমার দাবির ওপর তো আমার দশক নির্ভর করে না। খোন্দকার আশরাফ হোসেনের সহপাঠীরা সকলে ষাটের দশকের। কিন্তু তিনি নিজে ঘোষণা দিলেন আশির দশকের কবি হবেন। তার সময়ের তিনি বড় কবি হলেন। কিন্তু আলোচনায়-স্বীকৃতিতে-পদকে-পুরস্কারে পিছিয়ে রইলেন। এই জন্য আক্ষেপও ছিল তার। আবার আশির দশকের কয়েকজন কবিকে জানি, পাত্তা না পেয়ে এখন নব্বইয়ের দশকে ভিড়েছেন। আমার সচেতনা সাহিত্যপ্রবেশ নব্বইয়ের দশকের শুরুতে।

চিন্তাসূত্র: সাহিত্যচর্চা করতে গিয়ে কখনো কারও দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন? যাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন, তারা কারা? কিংবা সেই প্রভাবের ধরনটি কেমন হতে পারে?
তপন বাগচী: আমার পিতার প্রভাবকে সর্বাগ্রে স্বীকার করি। পিতা তুষ্টচরণ বাগচী কবিতা লিখতেন, গান লিখতেন। তিনি আমাকে লেখার বিষয়ে উৎসাহ দিতেন। এরপর স্কুলের শিক্ষক অনিলকৃষ্ণ দত্ত আমাকে উৎসাহ জোগাতেন। তবে পুরদস্তুর লিখতে আসার পরে, সুকান্ত ভট্টাচার্য, জসীমউদ্‌দীন ও জীবনানন্দ দাশের অলৌকিক অবিমিশ্র প্রভাব আমার ভেতরে অনুভব করি।

চিন্তাসূত্র: কী নিয়ে এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন?
তপন বাগচী: গান লিখছি, কবিতা লিখছি। সময় তো পার করতে পারছি না। সময় এখন থমকে আছে।

চিন্তাসূত্র: বাংলা সাহিত্যের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনার অভিমত জানতে চাইবো। সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে আমরা কি সঠিক পথে রয়েছি বলে মনে করেন?
তপন বাগচী: বর্তমানের কথা কিছু বলতে পারি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে ধার করে। আজকে যে পথ সঠিক মনে করছি, কালকে তা ভুল বলে প্রমাণিত হতে পারে। তাই ভবিষ্যৎ বলার ঝুঁকি একমাত্র জ্যোতিষেরাই গ্রহণ করে। আমি তো জ্যোতিষ নই, সাহিত্যের সেবক মাত্র। লিখছি মনের মতো করে। কখনো বা সম্পাদকের আহ্বানেও সাড়া দিচ্ছি। তবে মনে হচ্ছে আমরা পিছিয়ে পড়ছি। যারা সাহিত্যচর্চা করছি, তার দামি কাগজে বই প্রকাশ করে তা বিলি করেই তৃপ্ত হচ্ছি। নিজেরা পড়ছি না। প্রচুর বই প্রকাশিত হচ্ছে, অথচ আমরা পরিণত হচ্ছি এক পাঠবিমুখ জাতি হিসেবে। সতের কোটি মানুষের দেশে তিনশত কবি বই বিক্রি হয় না। একজন লেখক হিসেবে এই লজ্জা আমিও বহন করি। তাহলে কী করে বলবো আমরা সঠিক পথে আছি?