পর্ব-দুই
চন্দনা আসার পরে জাদুর কাঠির মতো যেন গোটা পরিবারের ছবি পরিবর্তন হয়ে যায়। রাহেলা বেগমকে সে কখনো খালি পায়ে হাঁটতে দেয় না। প্রথম বেতন পেয়েই রাহেলা বেগমের জন্য নতুন শাড়ি ব্লাউজ কিনে দেয়। অলি মাহমুদের জন্য পাজামা পাঞ্জাবি কেনে। পিনুর জন্য জিন্সের প্যান্ট, টিশাট কেনে। সবার জন্য সেন্ডেল কেনে। ঘরবাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখে। উঠোনের এক কোণে ফুলের বাগান করে। সময় পেলেই নিজে রান্না করতে বসে যায়। এর ভেতর দিয়েই নিজে পড়ালেখা করে। যাতে ভবিষ্যতে কলেজের চাকরি পাওয়া একটু হলেও সহজ হয়। যদিও সে জানে টাকা ছাড়া হবে না। তারপরও লিখিত পরীক্ষা ও ভাইভা তো দিতে হবে; এসব চিন্তা করে পড়াটা ধরে রাখে। গল্প-উপন্যাস পড়ার ঝোঁকটা এখনো আছে।
বাড়িতে একটা ছোট লাইব্রেরি করার প্ল্যান করে। কোথাও আর চাকরি না হলে এ চাকরিটাই তো করতে হবে, এখানেই তো থেকে যেতে হবে। সেসব ভেবেই এসব ভাবনা তার। পরিবারটাকে আপন করে নেয়। আরও ভালোভাবে কী করে স্কুলে পড়ানো যায়, সেসব পরিকল্পনা করে। পিনুকেও সে নিজের মতো তৈরি করতে চেষ্টা করে। একদিন সে অনেক বড় হবে। বড় চাকরি করবে। অনেক সম্মান পাবে। আমি বড় বোনের সম্মানটুকু তো পাবো। আমি একজনকে হলেও নিজের মতো গড়ে তুলতে পেরেছি, সেই শান্তি ও সান্ত্বনাটুকু তো নিজের মনের কাছে পাবো।
হঠাৎ একদিন পিনুর প্রচণ্ড জ্বর আসে। তার মাথায় পানি দেয়, গা মোছানো, ওষুধ খাওয়ানোসহ সব সেবা-যত্ন চন্দনা করে। এরপর থেকে জহাঙ্গীর চন্দনার অনুগত হয়ে ওঠে। সমীহ করে চলে। কথা মান্য করে। ওর মিষ্টি চেহারা চন্দনাকে খুব টানে। আদর আদর একটা ঘ্রাণ মেখে থাকে।
সেই বিকাল থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। রাত শেষ হতে বসেছে অথচ বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণ নেই। মেঘের পেটে কত যে পেস্রাব! ভারী রাগ হলো চন্দনার। কিছুতেই ঘুম আসছে না। উপন্যাস পড়ার চেষ্টা করলো। কয়েক পৃষ্ঠা পড়ার পর ওটাও বন্ধ করে রেখে দেয়। কোনো কিছুতেই মন বসছে না। ভাবে, পিনু জেগে থাকলে ওর সঙ্গে গল্প করে বৃষ্টির রাতটাকে সুন্দর করে তোলা যেতো। চন্দনা অনেকক্ষণ তাকিয়ে দেখে ওকে। কী যে মিষ্টি চেহারা। হালকা গোঁফের রেখা যেন মেঘ ফেটে রৌদ্র বের হওয়ার মতো। পিনুর কৈশোর পেরুনো কাঁচা যৌবনের রেখা। চিকন ঠোঁটে দুটোতে টোকা দিলে যেন রক্ত ছুটে বেরুবে।
চন্দনা কী যেন ভাবে। ভুল করছি না তো! এ তো ভুলই। এ তো অন্যায়! এ সব কেন আমার মাথার ভেতর ঘুণপোকার মতো বাসা বাঁধছে! ওকে তো আমি ছোট ভাইয়ের মতো স্নেহ করি। সব কিছু নষ্টচিন্তার ভেতর ডুবে যাচ্ছে কেন! নিজের সঙ্গে নিজের মনে যুদ্ধ চলে। ঘুমন্ত পিনুকে ভীষণ আকর্ষণীয় লাগে চন্দনার। ডিম লাইটের আলো আর বাইরে বৃষ্টির ভারী শব্দ কেমন যেন আবেগী করে তোলে চন্দনাকে। নিজেকে বোঝাতে চায় এটা ঠিক নয়, এটা অন্যায়; এটা অপরাধ; এটা পাপ; এটা অসম সম্পর্ক; পরিবার-সমাজ-ধর্ম এটাকে মানে না। তারপরও চন্দনার ভেতর থেকে অন্য আর এক চন্দনা যেন জেগে ওঠে। না, এসব ঠিক নয়। ক্ষণিকের মোহ। সবই তো ছিল আমার। কপালে টেকেনি। নতুন করে আবার এসব কেন চিন্তা করি! তাও আবার নিজেরই আপন খালাত ছোট ভাইকে নিয়ে এসব কী ভাবি! লোকে যা-তা বলবে। চন্দনা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে।
চন্দনার মনের এলামেলো কথাগুলো কোথায় ভেসে গেলো কে জানে। সবকিছুই যেন তার কাছে অন্ধকার হয়ে ওঠে। শুধু নিজের শরীরের ভেতর; মনের ভেতর অন্যরকম অচেনা একটা আগুন অনুভব করে। যে আগুনে নিজে নিজেই পুড়তে থাকে।
নিজেও বুঝতে পারে না। কিন্তু এই স্পর্শে পিনু তো মুহূর্তে আমার পুরুষ হয়ে উঠেছে, তা প্রকাশ কার না-করি, এই সত্য তো নিজের সাথে নিজে অস্বীকার করতেও পারবো না। এই রাত তো আমি জীবন থেকে কখনো মুছে ফেলতে পারবো না।
ফারুকের কথা মনে হয় চন্দনার। কোথায় সে হারিয়ে গেলো। লোকজনের কী এমন ক্ষতি করেছিল, তাকে দিন দুপুরে এমন নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করলো! এরার জন্য এই রাজনীতি করতে গিয়েছিল সে! তার এই মরণে দেশের কী উপকার হলো! এলাকার কী উপকার হলো! এই মৃত্যু তো জলে ভাসা খড়কুটোর মতো। কোনো মূল্য নেই। যা ক্ষতি যা সর্বনাশ; সবই তো হলো আমার। একসময় ভেবেছিলাম নিজেকে আমৃত্যু ফারুকের হয়েই থাকবো। ওর স্মৃতি নিয়ে বাঁচবো। অন্য আর কোনো পুরুষের কাছে নিজেকে বিলাবো না। কিন্তু পিনু নীরবে কেমন যেন আমাকে টানছে। আমি নিজেই কেমন যেন তার দিকে ঝুঁকে যাচ্ছি। নিজেকে কতোটা ধরে রাখতে পারবো, কতদিন ধরে রাখতে পারবো, জানি না। রানু ভাই তো আমাকে এরকম করে টানতে পারে না। আমিও তো তার প্রতি কোনো আবেগ অনুভব করি না। খালুজান মাঝেমধ্যেই আমার বিয়ের সম্বন্ধ আনে। তাতে আমার একটুও মন চায় না। একবাক্যে না করে দিই। পিনু আমাকে কেমন আচ্ছন্ন করে রাখে। ও তো আমাকে কখনো কিছু বলেওনি। ওর বয়সটাও তো আমার জন্য কাঁচা। অসম। সমাজেও অসম সম্পর্ক নিয়ে যাচ্ছেতাই ভাব আছে। তাই বলে অসম সম্পর্ক হয় না, তা তো নয়। হয় তো। ওর সঙ্গে আমার সম্পর্ক গড়ালে সবাই আমাকে যা-তা বলবে। পিনুই কি তা বুঝতে পারবে! এসব তো আমার নিজের ভাবনা, একতরফা ভাবনা। তবু সত্যটা এরকমই হবে। কেউ ভালো বলবে না। কিন্তু প্রেমের অবাধ্য স্রোত কার মানা মানে! কার ধার ধারে! ওর প্রতি দিন দিনই মোহটা বাড়ছেই। আসলে মন তো বয়স, আইন কানুন, সমাজ ধর্ম ওসবের কিছুই মানে না, ওসবের কোনো হিসাব বোঝে না।
আপন উদাসী ভাবনায় হারিয়ে যায় চন্দনা। পিনুর মাথায় হাত দেয়। চুলগুলো একটু একটু করে নাড়ে। আপু, তুমি এখনো ঘুমাওনি?
না। ঘুম আসছে না। উপন্যাস পড়ার চেষ্টা করলাম। তাও পারলাম না। তোমার কাছে বসে আছি। রাত ভর বৃষ্টি হচ্ছে। কিছুই ভালো লাগছে না। তোমার গা-ভর্তি জ্বর। তোমার জন্য খারাপ লাগছে।
জ্বর ঠিক হয়ে যাবিনি। তুমি রুমে গিয়ে ঘুমাও গে।
চন্দনা নিজের রুমে না গিয়ে আরও কিছুক্ষণ বসে থাকে। ওর চুল নাড়ে। হাতের আঙুল নাড়ে। কপাল টেপে। তারপর একসময় সংকোচের পাপড়ি ছিঁড়ে মনের সুঘাণে সওয়ার হয়ে পিনুর পাশেই শোয়।
বৃষ্টির ঝাপটা বাড়তেই থাকে। যেন বৃষ্টির মাথা খারাপ হয়ে গেছে। সেই কখন থেকে শুরু হয়েছে। থামার কোনো লক্ষণ নেই। বাড়ছে তো বাড়ছেই। প্রচণ্ড বৃষ্টির দাপটে অন্ধকার আরও ঘন অন্ধকার হয়ে যায়। পিনুর কপালে হাতটা রেখেই একসময় ঘুমের কোলে ডুবে যায় চন্দনা। সকাল অনেক আগেই পার হয়ে গেলেও মুষলধারা বৃষ্টির কারণে সকাল আর সকাল হয়ে ওঠে না। প্রবল বৃষ্টিতে অন্ধকারে সকাল ডুবে আছে। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ কমছে না। ঝড় ঝাপটায় কখনো কখনো আরও বাড়ছে। বৃষ্টির শব্দে চন্দনা ঘুম ভেঙে অবাক হয়ে দেখে পিনু এক হাতে তাকে জড়িয়ে, আর এক হাতে তার বুক শক্ত করে ধরে কী সুন্দর ঘুমোচ্ছে। চন্দনা তাকে শরীর থেকে সরায় না। ঘুমের মতো করে অমনি শুয়ে থাকে। শরীরটা জাগাতে ইচ্ছে করে। পিনুকেও জাগাতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কিছুই করে না। গভীর এক ভালোলাগায় নিজেকে ছেড়ে দিয়ে অমনি শুয়ে থাকে। ফারুকের মৃত্যুর পরে এই প্রথম তার নিজের ভেতর-বাহির জাগিয়ে তুলতে ইচ্ছে করলো। এই প্রথম সে মুগ্ধ হয়ে কোনো পুরুষের কাছে এমন নিবিড় হয়ে আছে। মুগ্ধতার অতলে ডুবে নিজেই নিজের উঠে যাওয়ার শক্তি যেন হারিয়ে ফেলেছে। পিনুর চোখ মুখ ঠোঁট খুঁটে খুঁটে দেখে। কামরাঙার মতো কী সুন্দর!
কী মনে করে চন্দনা আবার ভাবে, পিনু কি ঘুমের ভেতর এমন করে আছে, না কি ঘুমের ভান করে এমনটি করছে। নিজেও বুঝতে পারে না। কিন্তু এই স্পর্শে পিনু তো মুহূর্তে আমার পুরুষ হয়ে উঠেছে, তা প্রকাশ কার না-করি, এই সত্য তো নিজের সাথে নিজে অস্বীকার করতেও পারবো না। এই রাত তো আমি জীবন থেকে কখনো মুছে ফেলতে পারবো না। এরকম ভাবনার ভেতর দিয়ে একদিকে সে ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে, আর এক দিকে পিনুর প্রতি তার আবেগ ও মোহ বাড়তে থাকে।
চলবে…