কদম ও অন্যান্য


কদম
ঋতুটি শরৎ এখন পঞ্জিকার পাতায়।
বর্ষার আমেজ কাটেনি বুঝি, সারাটি আকাশ
কালো করে নামে বৃষ্টি।
একটানা ভিজে শালবন, মহুয়ার কিশলয়। সতেজ হয়
লতানো পুঁইয়ের ডগা।

এ বর্ষণ দেখার সৌভাগ্য আমার নেই। দূর পরবাসে
বসে আমি ভাবি, আহ, কি সহজেই ভুলে গেলাম, ভুলে গেলাম
প্রিয় ফুল কদমের কথা!
পড়ার টেবিলে দুটো কদম, আষাঢ় শ্রাবণে তরতাজা দুটো কদম
জিইয়ে রেখেছি কত
কাচের বোতলে। ভেজা বাতাসে কদমের হালকা সুবাস।
তিনটে বছর, মাত্র তিনটে বছর
ভুলিয়ে দিলো চব্বিশ বছরের বর্ষার স্মৃতি, যেন চব্বিশ বছর
পরাজিত তিন বছরের পাল্লায়।

পরিজন ফোন করে খবর নিতে, ‘কি পাঠাবো বল?
কাঠালের বিচি ভাজা, চিনে বাদাম, ঝুনা নারকেল
নাকি আমের আচার?’ ওদের তালিকায়
আমার পছন্দ অনুপস্থিত।

সাহেবদের বিলেতি ফুলের ভিড়ে
ঠাঁই নেই কদমের
যেমন আছে কাঁদা মাটির সোঁদাগন্ধ ভরা বাংলায়।
ক্যালেন্ডারের পাতায় দেখি
ফুটফুটে কদমের শ্বেত রেণু বিনিময়, আর অন্তরে অনুভবে
রূপ-রস-গন্ধ।

চাকরি সমাচার
চাকরি চাই। পিয়ন হবার জন্য পনেরো লাখ।
ঘুষে হোক, তবু সরকারি চাকরি। একবার জুটে গেলে
ফাঁকিতে ঝাপিতে জীবন পার।

আমি জানি, সরকারি চাকরি মানে একজন স্ত্রীর একটাই স্বামী।
মাস ফুরালে বেতন, সঙ্গম শেষে যেমন
আদর আদর আর আদর।
আমি জানি, বেসরকারি চাকরি মানে একজন বেশ্যার
অনেকগুলো নাগর; রাতভর বলাৎকারের পর গায়ে মুখে
ছুড়ে মারবে কয়টি টাকার নোট।
আমি জানি, আত্মকর্মসংস্থান মানে ধনাঢ্য সমাজপতির
আদুরে কন্যা। যাকে বাটে ফেলতে লোকেরা তেল মেখে
দাঁড় করিয়ে রেখেছে গোপনাঙ্গ; নিষ্ফল আশায়।

‘কী করো তুমি?’ ‘সফ্টওয়ার বিজনেস!’ ‘ওহ! তুমি বুঝি
চাকরি পাওনি?’
‘কী পেশা তোমার?’ ‘ফ্রিলেন্স ওয়ার্ক!’ ‘একটা চাকরি
জুটিয়ে নিলে ভালো হতো।’
‘তুমি নাকি সিনেমা বানাও? তোমার নাকি
গরু মোটা-তাজাকরণ প্রজেক্ট? হাস-মুরগির খামার?
এসব ফেলে চাকরি খোঁজো বেটা। না হলে কেউ
মেয়ে দেবে না।’ এই আমাদের সমাজ।

বনরাজ সিংহের মুক্তজীবন নয়, এ জাতি পনেরো লাখের বিনিময়ে
সোনার শিকল কিনে পোষা কুকুরের মতো গলাতে ঝোলাবে
আর অনুগ্রহের আশায় মালিকের মুখে তাকাবে।
ধনী বাপের আদুরে কন্যা না হয়ে
পুরুষের একমাত্র বউ হওয়াতেই যেন সব আগ্রহ।
হায় রে হুজুগে মাতাল জাতি, হায় রে আরামপ্রিয় ফাঁকিবাজ।

মানুষ কি নেই নিরুপায় ক্ষণে
এখানে মানুষ এমন ছিল না কখনো
এখানে পরিবেশ ছিল না এমন বৈরী, আমার
চিরচেনা মাতৃভূমিতে। এখানে ছিল না প্রতিযোগিতা
অন্যকে টপকে যাওয়ার, অপরের মনে
প্রতিহিংসার বীজ বুনে দেওয়া চাতুরি এখানে ছিল না, ছিল না
অধপতনের গতি বেগতিক।

এখানে এখন মানবন্তরে বিস্তৃত
কালকূট, মানুষের মুখ আকাশচুম্বী দানবীয়
রূপ ধরে করেছে আড়াল আমাদের সোনালি আকাশ।
অবিশ্বাসের ঘুণ আর স্বপ্নভঙ্গের অভিশাপ
এসেছে নেমে আমাদের সবার ওপর
দুরারোগ্য ব্যাধির মতো সঙ্গোপনে, গড়েছে
আশ্রম নিচ্ছিদ্র নিরাপদ।

এমন একটি মানুষ কি নেই, বুক ফুলিয়ে
যে পারে বলতে, ‘আমি সত্যের সন্ধানী-
মিথ্যার মুখে মারি লাত্থি, অধপতনের
টেনে ধরি লাগাম আর সভ্যতার নামে অসভ্যের আচরণ
দেখেও না দেখার ভান ধরে থাকি না পড়ে।’
এমন একটি মানুষ কি নেই, নিরুপায় ক্ষণে যাকে ডেকে
বলা যায়, ‘জ্বলে ওঠো আপন শক্তিতে-
আমরা তোমার বিপ্লবী অগ্নিস্ফুলিঙ্গ
নেবো ধার, ফিরিয়ে দেবো হাজার দীপালী।’