আবু নুওয়াসের কবিতা ।। অনুবাদ: এনামূল হক পলাশ


[আবু নুওয়াস (৭৫৬-৮১৪)। আবু নুওয়াস আল-হাসান ইবনে হানি আল-হাকামি ছিলেন একজন ধ্রুপদী আরবি কবি এবং আধুনিক (মুহাদাত) কবিতার প্রধান প্রতিনিধি যেটি আব্বাসিদের প্রথম বছরগুলিতে বিকাশ লাভ করেছিল। আবু নুওয়াসের একটি ভাস্কর্যকে বাগদাদের একটি পার্কের উপরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। আরব বিশ্বে আবু নুওয়াসের খ্যাতি তার মদের পূজা এবং প্রেমের কবি হিসাবে নির্মিত। তিনি আধুনিক ইরানের আহভাজে জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্ম তারিখ অনিশ্চিত। তিনি ৭৫৬ এবং ৭৫৮ সালের মধ্যে কোন এক সময়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার পিতা হানি ছিলেন একজন সিরিয়ান যিনি শেষ উমাইয়া খলিফা দ্বিতীয় মারওয়ান এর সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। আবু নুওয়াসের বয়স যখন ১০ বছর তখন তার বাবা মারা যান। তৎকালীন পরাক্রমশালী আব্বাসীয় খিলাফতের আমলে তিনি অল্প বয়সে ইরাকে চলে যান।

তার কবিতাগুলি বাগদাদে তার মহাজাগতিক জীবনের অভিজ্ঞতাকে প্রতিফলিত করে যেখানে সরাইখানা, লাইব্রেরি, বাজার, মসজিদ এবং বাথ হাউসের জয় জয়কার ছিল।

তার লেখাগুলো স্বতঃস্ফূর্ত এবং তীক্ষ্ণ খোঁচায় পূর্ণ। তিনি আনন্দ, মদ, সঙ্গীত এবং ভাল সঙ্গ উদযাপন করেছেন। যুদ্ধ এবং তলোয়ারের সংঘর্ষকে তিনি ঘৃণা করতেন। আবু নুওয়াস খলিফা আল-মামুনের দলবলের কাছাকাছি ছিলেন। তাকে এবং তার অনুসারীদের রসিকতা, উপাখ্যান এবং লাম্পট্যের কবিতা দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। আবু নুওয়াস একাধিক ধারায় কবিতা লিখেছেন। তিনি সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত ছিলেন তার ওয়াইন কবিতা আর শিকারের কবিতায়। আব্বাসীয়দের রাজবংশের পরিবর্তনের পর ওয়াইন কবিতায় নতুন যুগের চেতনা প্রতিফলিত হয়েছিল। ওয়াইন কবিতার বিকাশে আবু নুওয়াসের একটি বড় প্রভাব ছিল। তাঁর কবিতা সম্ভবত বাগদাদের অভিজাতদের মনোরঞ্জনের জন্য লেখা হয়েছিল। ওয়াইন কবিতার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ওয়াইনের প্রাণবন্ত বর্ণনা, এর স্বাদ, চেহারা, গন্ধ এবং শরীর ও মনের প্রভাবের উচ্চতর বর্ণনা। আবু নুওয়াস তার কবিতায় অনেক দার্শনিক ধারণা এবং চিত্র আঁকেন যা পারসিকদের মহিমান্বিত করে এবং আরব ক্লাসিকবাদকে উপহাস করে। ইসলামি বিশ্বে আব্বাসিদের প্রাসঙ্গিকতার থিম প্রতিধ্বনিত করার জন্য তিনি ওয়াইন কবিতাকে একটি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছেন।

আবু নুওয়াসের কবিতায় কাব্যিক এবং রাজনৈতিক উভয় সুর ছিল বলে জানা যায়। তিনি ওয়াইনকে একটি অজুহাত এবং মুক্তিদাতা হিসাবে ব্যবহার করেছেন। তার কবিতার একটি নির্দিষ্ট লাইন ধর্মের সাথে তার সম্ভ্রান্ত সম্পর্কের উদাহরণ দেয়; এই লাইনটি মদের ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞাকে ঈশ্বরের ক্ষমার সাথে তুলনা করে। নুওয়াস তার সাহিত্য এমনভাবে লিখেছেন যেন তার পাপ একটি ধর্মীয় কাঠামোর মধ্যে প্রমাণিত হয়। আবু নুওয়াসের কবিতায় মদ ও যৌনতার প্রতি তার ভালোবাসা প্রতিফলিত হয়েছে। কবিতাগুলি মদ পান করার শারীরিক এবং আধিভৌতিক উভয় অভিজ্ঞতা উদযাপন করার জন্য লেখা হয়েছিল যা ইসলামী বিশ্বের কবিতার নিয়মের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

আব্বাসীয় গৃহযুদ্ধের সময় ৮১৪ থেকে ৮১৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তিনি মারা যান। তার মৃত্যুর কারণ বিতর্কিত। বিভিন্ন বিবরণে তার মৃত্যুর চারটি ভিন্ন ভিন্ন কারণ বর্ণনা করা হয়। সেগুলো হচ্ছে, ১) নওবখত পরিবার দ্বারা তাকে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল, যাদের ব্যঙ্গ করে একটি কবিতা নির্মাণ করেছিলেন; ২) তিনি তার মৃত্যু পর্যন্ত একটি সরাইখানায় মদ্যপানে মারা যান; ৩) তাকে মিথ্যাভাবে আরোপিত ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের জন্য নবওখত দ্বারা মারধর করা হয়েছিল; ৪) তিনি কারাগারে মারা যান।

অন্যান্য আব্বাসীয় কবিদের সাথে আবু নুওয়াস তার উন্মুক্ত মদ পান এবং ধর্মকে অবজ্ঞা করার জন্য প্রায়শ্চিত্ত করেন। মৃত্যুশয্যায় তিনি তার পাপের জন্য অনুতপ্ত হন এবং একজন মুসলিম হিসেবে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পর নুওয়াসকে বাগদাদের শুনিজি কবরস্থানে দাফন করা হয়।]

 গোপন প্রেম
আমি মরে যাচ্ছি নিখাদ ভালোবাসার ভারে,
হারিয়ে যাচ্ছি বায়ুসঙ্গীতের শব্দসম্ভারে।

আমি তার উজ্জ্বল শরীরের দিকে তাকিয়েই আছি,
আশ্চর্য হইনা, বরং তার সৌন্দর্য্য দেখেই বাঁচি।

কচি চারার কোমর নিয়ে চাঁদের মতো মুখ,
গোলাপী আভার গাল প্রেমের সুবাসিত সুখ।

গোপন প্রেমে আমি তোমার জন্য মরি,
আমাদের প্রেম যেন এক অবিচ্ছেদ্য দড়ি।

তোমাকে সৃষ্টি করতে কতটুকু সময় লেগেছে হে ফেরেশতা?
তাতে কিছুই যায় আসেনা, আমি গাইবো তোমার প্রশংসাগাঁথা।

আমি দুইবার মাতাল হই
প্রেমিকার জন্য কেঁদো না,
হরিণীর জন্য বকবক করো না।
কিন্তু অনেক গোলাপের মাঝে
পান করো গোলাপী লাল শরাব।

মদ্যপের গলা থেকে বের হওয়া খিস্তি
লাল হওয়া চোখ যেন গালের উপর বেদনা।

শরাব একটি রুবি, পেয়ালা একটি মুক্তা,
যদি তা পরিবেশন করে অভিজ্ঞ
ছিমছাম শরীরের মেয়ের পাতলা আঙ্গুল।

যার হাত তোমাকে পরিবেশন করবে শরাব,
আর তার মুখ থেকেও নির্গত হবে শরাব –
নিশ্চিতভাবে দুইবার মাতাল হবে তুমি।

এইভাবে আমি দুইবার মাতাল হই,
আমার বন্ধুরা হয় একবার;
এই বিশেষ অনুভূতি একান্তই আমার।

কারখিয়া
শরাবের প্রশংসা করো তার উদারতার জন্য
আর তার একটি সেরা নাম দাও
তাকে পানির অধীনে নিয়ে যেও না
বরং পানিকে যেন সে অধীনে নিয়ে আসে।

একটি কারখিয়া* যে বহু বছরের বৃদ্ধ
যতক্ষণ না এর অধিকাংশই ফুরিয়ে যায়
ততক্ষণ মদ্যপরা পান করে আসছে
জীবনের শেষ প্রান্ত উপভোগ করার জন্য।

তবুও এটি বৃত্তাকারে আসে
আর নিখুঁত ভাবে পুনরুজ্জীবিত করে
ব্যাকুল প্রেমিকদের আত্মা।

বারে বারে শরাব পান করা হয়
তার দ্বারা পর্যাপ্ত উপরে না উঠা পর্যন্ত।

[*কারখিয়া ছিল বাগদাদের একটি স্থান যেখানে উত্তম মদ তৈরি করা হতো]

মুসলিম
হে আল্লাহ, যতই সীমা ছাড়াক পাপ আমার
জানি, তার চেয়েও বড় ক্ষমা তোমার।

যখন আমি প্রার্থনায় হবো নত
তখন তুমি ফিরিয়ে নিলে হাত
কে হবে তাহলে আমার প্রতি সদয়?

তোমার দরজা যদি ভালো মানুষের জন্যই খোলা থাকবে
তবে অপরাধী পাপী বান্দাদের পথ কে ঘুরিয়ে দিবে?

একমাত্র তোমাকে পাওয়ার রাস্তায় আমি আশায় বিলীন,
আর তোমার অসীম ক্ষমায় আমি একজন মুসলিম।