যে জ্যাম লেগেছে-ইহজিন্দেগিতে ছুটবে বলে মনে হয় না। প্রতিদিন জ্যাম বেড়েই চলেছে। ঢাকা শহরে কোটিপতি, অর্ধ-কোটিপতি বাড়ছে-পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গাড়ির সংখ্যাও। ঠাঁটবাট দেখানোর জন্য গাড়ি হয়ে উঠেছে অনিবার্য অনুষঙ্গ। ব্যাংকগুলোও গাড়ি কিননেওয়ালাদের পাশে-দিচ্ছে কার লোন। প্রান্তিক কৃষকের জন্য কৃষিঋণ দূরে থাক, ব্যাংকের চৌহদ্দিও দূরে সরে যাচ্ছে। চারদিকে নব্য কোটিপতিদের মচ্ছব, নিত্যনতুন গাড়ি কেনা তো হবেই। সে গাড়ি রাস্তায় বাড়িয়ে তুলছে যানজট, জনজট।
সব দেখে-শুনে বিরক্ত হয় ইলিয়াস। খারাপ একটা গালি উচ্চারণ করতে গিয়ে নিজেকে সামলালো। সহযাত্রী কোনো পুরুষ হলে হয়তো মনের ঝাল মিটিয়ে গালিটা দিতে পারতো। কষ্টে নিজেকে নিবৃত্ত করে সে ফিরলো সহযাত্রী মণিকার দিকে-‘তুমি কি জানো ঢাকা শহরে কোটিপতির সংখ্যা কত?’
‘হঠাৎ এ প্রশ্ন?’ মণিকার কণ্ঠ থেকে বিস্ময় ঝরে পড়ে।
‘জানো কিনা বলো।’
‘না।’
‘কয়েক হাজার। আগামী কয়েক বছরে কোটিপতি হবে আরো অনেকেই। বৈধ নাকি অবৈধভাবে কোটিপতি হয়েছে এবং হবে সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। মোদ্দা হিসাব, কোটিপতিদের স্ট্যাটাস বাড়বে সেই সাথে রাস্তার উপর ধকল বাড়বে।’
‘এটাই তো স্বাভাবিক!’
‘স্বাভাবিক! কীভাবে?’
‘কোটিপতি হলে আপনিও কি গাড়ি কিনবেন না?’
মণিকার প্রশ্নে থতমত খায় ইলিয়াস-‘মনে হয় না!’
‘তখন আপনিও গাড়ি কিনবেন, যানজট বাড়াবেন। এখন সরকার ও কোটিপতিদের গালি দিচ্ছেন তখন শুধু সরকারের বিরুদ্ধে অযোগ্যতার অভিযোগ তুলবেন, অসভ্য দেশ বলে নিজের দেশকে গালি দেবেন। নোংরা কোটিপতিরাই হবে আপনার বান্ধব।’
মণিকার কথায় ইলিয়াস কেমন যেন বিভ্রান্তিতে পড়ে। পাল্টা যুক্তি খুঁজে পায় না। উপলব্ধি করে, তার ক্ষেপে যাওয়া অক্ষমের মনোজ্বালা প্রশমন ছাড়া কিছুই নয়। ব্যর্থ মানুষের আঙুর ফল টক-জাতীয় ব্যাপার।
প্রথমদিকে সংকোচ, পাপবোধ, লৌকিকতা ইত্যাদি মনে খচখচ করলেও বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। তদ্দিনে পেয়ে গেছে জীবনের রংধনু-স্বাদ।
সামনের গাড়িগুলো কিছুটা নড়ে ওঠে। নড়ে ওঠা অনুসরণ করে ইলিয়াসদের লাক্সারি কোচের ড্রাইভারও। কিন্তু হাত দুয়েক গিয়ে আবার থেমে যায়। থেমে যাওয়া গাড়িগুলো থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ইলিয়াস এবার মণিকার দিকে তাকাতে চেষ্টা করে। পাশাপাশি বসার বড় অসুবিধা, পরস্পরকে ভালোভাবে দেখা যায় না। স্বাস্থ্যবান এবং মোটামুটি স্বাস্থ্যবতী পাশাপাশি বসায় অসুবিধাটুকু আরো বাড়ে। তবু ইলিয়াস মণিকার সুন্দর মুখের দিকে সরাসরি তাকানোর চেষ্টা করে। বামদিকে একটু সরে চেষ্টা করায় তা অনেকাংশেই সফল হয়। ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটিয়ে তোলে ইলিয়াস-‘তোমার কথায় দ্বিমত করার সুযোগ নেই। তবু কথা থেকে যায়। তুমি কি ভেবে দেখেছো এসব গাড়ির যাত্রী মোটামুটি একজনই? একাধিক কমই হয়। ফি-দিন সকালবেলা আমরা যখন তথাকথিত সিটিং সার্ভিস বাসগুলোর কাউন্টারের সামনে এতিম শিশুর মতো বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকি-এ প্রাইভেট কারগুলোই চোখের সামনে দিয়ে হুশহাশ করে চলে যায়। অনেক ক্ষেত্রেই জ্যাম বাধিয়ে দিতে ভূমিকা রাখে। আরোহীদের ডানে-বামে তাকানোর ফুরসত নেই যেন। কোনো গাড়িঅলা কি আজ পর্যন্ত কোনো অপেক্ষমাণ যাত্রীকে লিফট দিয়েছেন? তুমি হয়তো নিরাপত্তার কথা বলবে। কিন্তু এমন কি হয় না, অপেক্ষমাণ যাত্রীদের মধ্যে এদের আত্মীয়স্বজন কিংবা দুই-একজন পাড়াপ্রতিবেশী বা মুখচেনা মানুষও থাকে? অবশ্যই থাকবে, গাড়িঅলা মানুষগুলো তো আর আকাশ ফুঁড়ে নামেনি। গাড়ি নাই এমন কারো সাথে কথা বলাই হয়তো লজ্জার ব্যাপার! প্রেস্টিজ ইস্যু। চেনা-অচেনা, পরিচয়-অপরিচয়ের গ-ির সীমারেখার কথা চিন্তা করা বাতুলতা মাত্র।’
‘ইন্টারমিডিয়েট ফাইনালের সময় আমাকে একজন লিফট দিয়েছিলো। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরও যখন গাড়ি পাচ্ছিলাম না…।’
‘সেটা হয়তো তুমি মেয়ে বলেই পেয়েছো। তোমার স্থলে আমি হলে কি লিফট পেতাম?’
মণিকা চুপসে যায়। হয়তো কোনো স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। ইলিয়াস আবার সরব হয়-‘তুমি কি জানো, এমনও ফ্যামিলি আছে প্রত্যেক সদস্যের একটা করে গাড়ি।’
মণিকা উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না। কথা বলতে তার ভালো লাগে না। ইলিয়াসও চুপসে যায়। এক সময় মণিকার ঘাড়ের কাছটায় হাত রেখে কাছে টানে।
কক্সবাজার যাচ্ছে ওরা। মোটামুটি সপ্তাহের ট্যুর। অনেকদিন থেকেই ইলিয়াসের লক্ষ্য-লম্বা একটা ট্যুর দেওয়ার। এদ্দিন সময় ও সুযোগ হচ্ছিলো না। দীর্ঘদিন পর মিলে গেলো মওকা। এ ভ্রমণ সোনায় সোহাগা। উপরি হিসেবে পাওয়া গেছে মণিকার মতো যৌবনবতী ভ্রমণসঙ্গী। বীরভোগ্যা বসুন্ধরা-সাহসীদের সুন্দরীভাগ্য। সেটাই ফলেছে। সংকোচ ঝেড়ে একটু সাহসী হতে হয়েছে ইলিয়াসকে।
মণিকা হচ্ছে বিশেষ শ্রেণির মেয়ে। ঢাকা শহরে এসে ‘সুযোগ’ পেয়ে অনেকেই বিলাসী জীবনযাপনে গা ভাসিয়ে দেয়। বিনিময়ে যদি একটু ‘স্যাক্রিফাইস’ করতে হয় তাতেও পিছু হটে না। রাখঢাকের তোয়াক্কা না করে ভোগবিলাসে মত্ত হয়ে ওঠা মেয়েরা রাজধানীতে আসে পড়াশোনা বা চাকরির সুবাদে। মণিকা এসেছিলো পড়াশোনা করতে। তার বাড়ি থেকে পর্যাপ্ত টাকা যোগান দিতে পারতো না। টিউশনি করে নিজের খরচ জোগাতে হতো। আটপৌরে জীবনে টানাপোড়েনের কমতি নেই। জীবনের নানা বাঁক পেরিয়ে সে যখন বুঝলো এক-আধটু ছলাকলা, অভিনয় কিংবা প্রয়োজনীয় মুহূর্তে কাপড় খসাতে পারলে ভালো পরিমাণের টাকা পাওয়া যায়-নমনীয় হতে শুরু করলো। প্রথমদিকে সংকোচ, পাপবোধ, লৌকিকতা ইত্যাদি মনে খচখচ করলেও বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। তদ্দিনে পেয়ে গেছে জীবনের রংধনু-স্বাদ।
মণিকার সাথে ইলিয়াসের বন্ধু সুমনের হট রিলেশন। সে সুবাদে এসব ইলিয়াসের জানা। আড্ডায়ও কখনো-সখনো সুমনের সাথে আসতো মণিকা। হাই হ্যালো বাই পর্যন্ত ছিলো সম্পর্কের পরিধি। কখনো গায়ে পড়ে আলাপ করেনি ইলিয়াস, সুমন কী মনে করে ভেবে! এবার যাত্রারম্ভের কয়েকদিন আগে মণিকার সাথে দেখা বসুন্ধরা সিটিতে। চোখে চোখ পড়ায় প্রথমে ইলিয়াস ভেবেছিলো, এড়িয়ে যাবে। পরক্ষণে কী মনে করে বললো-‘কেমন আছো?’
‘এই তো ভালো। আপনি?’
‘ভালোই। শপিং করতে এসেছো বুঝি?’
‘হ্যাঁ। কিছু অন্তর্বাস কেনার ছিলো।’
ইলিয়াস ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে কী যেন বলে। শুনে মণিকা বঙ্কিম গ্রীবায় কটাক্ষ হানে, ‘আপনি না খুব অসভ্য!’
এ উত্তরটাই ইলিয়াসকে প্রস্তাব রাখার সুযোগ করে দেয়। বলে ‘চলো আমার সাথে, কফি খাবে।’
কফি খেতে খেতেই ইলিয়াস বলে-‘আগামী সপ্তাহয় আমি কক্সবাজার যাচ্ছি বেড়াতে। তুমি যাবে আমার সাথে?’
‘আর কে যাবে?’
‘আমি একাই। তুমি গেলে দুজন হবো।’
‘আচ্ছা, দেখি।’
‘দেখি বললে তো হবে না। তুমি শিওর করলে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেবো।’
‘কী পদক্ষেপ?’
‘বাসের টিকিট, হোটেল বুকিং এসব।’
‘আমার রেট জানা আছে তো আপনার?’
‘না। তবে বিল নিয়ে সমস্যা হবে না। পারফরমেন্স ভালো হলেই হলো।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি যাবো আপনার সাথে।’
ইলিয়াস ভাবেনি মণিকা এত সহজে রাজি হয়ে যাবে। সুমন জানলে আবার মাইন্ড করবে না তো! করলে করুক, ওর কেনা জিনিস তো না। মুক্তবাজার অর্থনীতির বিশ্বে লেনদেনটাই বড় কথা। কার সাথে হলো, কীভাবে হলো সেটা বড় কথা না।
কক্সবাজারের উদ্দেশে বাস ছাড়ার প্রায় আধঘণ্টা আগে কাউন্টারে পৌঁছালো ইলিয়াস, ওর পনেরো মিনিট পরেই মণিকা। আঁটোসাটো জিন্স প্যান্টের সাথে স্কিন টাইট টি শার্ট, গলায় প্যাঁচানো ওড়না। ওড়নার এক প্রান্ত মিঠুন চক্রবর্তীর গামছা পরা স্টাইলের মতো ঝুলছে বুকের বাম পাশে। ডান দিক অনেকটাই উন্মুক্ত। বেশবাসের অবস্থা দেখে ঢোক গিললো ইলিয়াস। মণিকা এগিয়ে হাত বাড়ালো-‘হাই ইলিয়াস ভাই!’
উষ্ণ হাতের মধুর স্পর্শ নিতে নিতে ইলিয়াস বললো-‘তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে!’
তারপর তো যাত্রা শুরু হতে না হতেই জ্যাম। এমন নজরকাড়া সুন্দরীর সাথে পাশাপাশি সিটে বসে কোথায় একটু পুলকবোধ করবে তা না চারদিকের অবস্থা দেখে ব্রহ্মতালু জ্বলে যাচ্ছে। মণিকা ইচ্ছা করেই বেশ কয়েকবার ইলিয়াসের গায়ে-হাতে স্তনের স্পর্শ দিয়েছে কিন্তু তাতে এতটুকু উদ্দীপ্ত হয়নি ইলিয়াস। মেজাজ খিঁচড়ে আছে, এখন স্বয়ং বিপাশা বসু এসেও যদি দিগম্বরনৃত্য করে মনোযোগ পাবে না।
দুঃসহ সময় গড়িয়ে যায়, পাথর সময় স্থির হয়ে থাকে…।
জ্যামে আটকাবস্থায় তিল তিল করে বাস এগোয়। তিন ঘণ্টা পর পৌঁছায় কাচপুর ব্রিজে। তারপর পালে লাগে ভিন্ন হাওয়া। তুফানগতিতে এগিয়ে চলে। জানালা দিয়ে বয়ে আসা বাতাস ধাক্কা মারে। চুল এলোমেলো করা সে বাতাস মনে বুলিয়ে দেয় প্রশান্তির ছোঁয়া। জানালার পাশে বসেছে মণিকা। তার দৃষ্টি বাইরে নিমগ্ন। কখনো দূর আকাশে, সবুজ ধানখেতে, কখনো বা অসীম নীলিমায়। হঠাৎ কী মনে করে বাইরে থেকে মন ফেরায়। মুখটা বাম দিকে কাত করে। ডান হাতটা রাখে ইলিয়াসের হাতের উপর-‘কিছু বলছেন না যে!’
‘কী বলবো!’
‘বারে, কতকিছুই তো বলা যায়। আপনি কী বলবেন সেটা কি আমি জানি!’
‘আমি দেখছি।’
‘কী?’
‘তোমাকে।’
‘আমাকে আবার দেখার কী আছে?’
‘তুমি খুব সুন্দর এবং…।’
‘এবং কী?’
‘টসটসে রসগোল্লা।’
মণিকা লজ্জা পাওয়ার ভান করে-‘যাহ!’
‘সত্যি বলছি।’
মণিকা আরো ঘনিষ্ঠ হয় ইলিয়াসের দিকে। হাতের উপর রাখা মণিকার পেলব হাতটা নাড়াচাড়া করতে থাকে ইলিয়াস।
নিঃসীম নৈঃশব্দ্য হানা দেয় আবার। ইলিয়াস ভেবে পায় না, কথারা আজ কোথায় হারালো। এই প্রথম কোনো আগুনসুন্দরীকে নিয়ে দূরপাল্লার প্রমোদভ্রমণে যাচ্ছে, এখন চাঙ্গাই থাকার কথা। সুন্দরী মেয়েদের সাথে নাকি কথা বলার বিষয়ের অভাব হয় না। এর কারণ আলাপগুলো চটুল। মেয়েরা গভীর করে কোনো কিছু ভাবে না-গৃহস্থালির টুকিটাকি, রূপচর্চা, পরচর্চার মধ্যেই জগৎ সীমিত। কোনো সিনেমা তারকা নিয়েও দীর্ঘক্ষণ আলাপচারিতা চালিয়ে যাওয়া যায়। একটু ন্যাকা ন্যাকা, সস্তা মনোভাব নিয়ে বলতে হয়-এই যা। সবচেয়ে ভালো হয় এভাবে আলাপ শুরু করলে-‘তুমি দিন দিন সুন্দরীতমা হয়ে উঠছো। এ সৌন্দর্যের গোপন রহস্য কী? …এটা কোন ব্র্যান্ডের লিপস্টিক, কোন কোম্পানির পারফিউম?’
বাস থামে কুমিল্লা বিশ্বরোডের হোটেলের সামনে। বিশ মিনিটের যাত্রা বিরতি। মণিকার হাতে হাত রেখে ইলিয়াস হোটেলের দিকে এগোয়।
দুই.
বিকালে কক্সবাজারে বাস পৌঁছালে, ঘড়ির কাঁটা পাঁচের ঘরে যাওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা করছে। সৈকত এলাকা উপচে পড়ছে পর্যটকে। নানান কিসিমের মানুষ। দেশের সব মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েছে যেন কক্সবাজারে। এত বেশি গাড়ি এসেছে, পার্কিং প্লেসে জায়গা পাচ্ছে না। অবশিষ্ট গাড়িগুলো সারিবদ্ধভাবে রাস্তার উপর দাঁড় করানো। চারদিক গিজগিজ করছে পর্যটকে।
কালো মানুষ।
ফর্সা মানুষ।
শ্যামলা মানুষ।
শিশু কিশোর তরুণ বৃদ্ধ।
কেউ সপরিবারে, কেউবা সবান্ধবে।
প্রেমিক-প্রেমিকা।
নবদম্পতি।
স্বদেশি-বিদেশি।
রঙের মানুষ।
ঢঙের মানুষ।
শুধু মানুষ আর মানুষ।
অবস্থা দেখে ইলিয়াস ঘাবড়ে যায়। হোটেলে রুম পাওয়া যাবে তো? আগাম বুকিং না দিয়ে ভুলই হয়েছে। এখন সিট পাওয়া না গেলে মহাবিপদ। এমনিতে ভিতরে ভিতরে তেতে আছে সে, মাথার ভেতর পাক খাচ্ছে মণিকাসুন্দরী।
কপাল ভালো, প্রথমবার খোঁজাতেই রুম পেয়ে গেলো। ডাবল বেড, সিঙ্গেল রুম। রিসেপশনে নাম লেখালো স্বামী-স্ত্রী হিসেবে। রুমে ঢুকেই তর সয় না ইলিয়াসের। মণিকার কাপড় পাল্টানোর মাঝখানে বয়ে গেলো প্রত্যাশিত ঝড়।
ঝটপট রেডি হয়ে নেয় ইলিয়াস। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। সৈকতে যেতে হবে। সূর্যাস্তের বেশি বাকি নেই। যদিও সৈকতে যাওয়ার কিংবা সূর্যাস্ত উপভোগের কোনো তাড়া তেমন তাড়া অনুভব করছে না সে। অবচেতন মন বলছে, আরেকবার হয়ে যেতে পারে। টসটসে একটি নারীদেহ-বস্ত্রোন্মোচন এবং রহস্যোন্মোচন… সবটুকুর জবরদখল বুঝে নেওয়া চাই বারবার। মণিকার কটাক্ষে শেষমেষ আর আগ বাড়ে না ইলিয়াস।
মণিকাকে বগলদাবা করে সৈকতের উদ্দেশে রওনা হয়। এত লোক, স্বস্তিতে হাঁটাও যায় না। থেমে-থেমে চলতে হয়। এ জনারণ্যেই মণিকার ঠোঁটে গাঢ় করে চুমু খায় ইলিয়াস।
মণিকা নাকিসুরে বলে-‘ওহ্ ই-লি-য়া-স ভা-ই, আপনি যে একটা কী! এখনো তিয়াস মেটেনি?’
ইলিয়াস হাসে-‘না। আমার এক সমুদ্র জল চাই!’
‘আরো আগে চাইলেই পারতেন! আপনার সাথে পরিচয়ের পর কম সময় তো গড়ালো না।’
‘দেরিতেই যখন শুরু হয়েছে, সুদাসলে সব উশুল করে নিতে চাই।’
‘শখ কত! এখন চলেন সমুদ্রে নামি।’
‘এই অবেলায়!’
‘হ্যাঁ, জলতৃষ্ণার কথা বললেন না? আপনার সব পিপাসা মিটিয়ে দেবো আমি।’
‘তবে তাই হোক।’
সূর্যাস্তের লালাভ আভা আকাশজুড়ে। ইলিয়াস জলবিহারে নামে, মণিকাকে জড়িয়ে। উত্তাল সমুদ্রে ভরাযৌবনা নারীশরীর-অদ্ভুত এক মাদকতা এনে দেয়। দুয়ের মিলনেই যেন পরিপূর্ণ একটি ধারা তৈরি হয়।
ইলিয়াস-মণিকা জলকেলি করে। ডুবসাঁতার কাটে। জলকেলির ছলে ইলিয়াস ছুঁয়ে দেয় মণিকার ওষ্ঠ, কপাল, চুল, বুকসহ নানা গলি উপগলি। সাগরে ঢেউয়ের দাপাদাপি। কামকলার মধ্য দিয়েও মণিকা উচ্ছল হয়ে ওঠে।
অন্ধকার ধেয়ে এলে উঠে আসে ওরা। বেশি দাপাদাপির জন্যই কিনা কে জানে, মণিকা কেমন যেন নেতিয়ে পড়েছে। সে মাথা এলিয়ে দিয়েছে ইলিয়াসের ঘাড়ে। হাঁটছে ঠিকই, শরীরের অধিকাংশ ভার ইলিয়াস বহন করছে। মণিকার প্রতি ইলিয়াসের মন কোমল ভালোবাসায় ভরে যায়। কী অসহায় আত্মসমর্পণ। কী পরম নির্ভরশীলতা স্বল্প পরিচিত একজনের প্রতি। হোটেলে ফিরে ফ্রেশ একটা গোসল দেয়। মণিকার মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে এসেছে। নৈশভোজের উদ্দেশ্যে বেরোয় ওরা। ভালোই ক্ষুধা পেয়েছে।
মণিকা তেমন কিছুই খায় না। প্লেটে ভাত-তরকারি মিশিয়ে নাড়াচাড়া করে। ইলিয়াস প্রশ্ন করে-‘কোনো সমস্যা?’
মণিকা না-সূচক মাথা নাড়ে।
‘খাচ্ছো না যে?’
‘ইচ্ছে করছে না।’
‘আমি খাইয়ে দিচ্ছি।’
ইলিয়াস নলা ধরে খাইয়ে দেয়। মণিকাও কোনো আপত্তি ছাড়াই লক্ষ্মী মেয়ের মতো খেয়ে চলে। পাশের টেবিলের দুই একজন মজা পায়। হয়তো ধরে নিয়েছে-নবদম্পতি। মধুচন্দ্রিমায় এলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এমনটা ঘটে।
হোটেল থেকে বেরিয়ে মণিকা বায়না ধরে-‘ইলিয়াস ভাই, চলুন বার্মিজ মার্কেটে যাই।’
‘কাল যাবো। আজ চলো, রেস্ট নিই।’
‘চলুন না, আমি রূপচর্চার জন্য কিছু চন্দনমাটি আর আলতা কিনবো।’
‘বললাম তো কাল হবে।’
‘ওহ্ ইলিয়াস ভাই…।’
ইলিয়াসের হাত ধরে টানতে থাকে মণিকা। অবুঝ কিশোরী যেন, আবদার না মেটালে অভিমানে গাল ফুলিয়ে থাকবে।
শেষমেষ ইলিয়াস বিরক্ত হয়ে বলে-‘আমার ভালো লাগছে না। এখন ঘুম দেবো। তোমারও তো কম জার্নি হয়নি।’
এ কথায় মণিকার উৎসাহ নিভে যায়। নিঃশব্দে অনুসরণ করে ইলিয়াসকে।
রুমে ঢুকে পোশাক ছাড়ে ইলিয়াস। যুগপৎ বিছানা ও মণিকা টানছে তাকে। এমনো হতে পারে, মণিকাই টানছে, বিছানা উপলক্ষ মাত্র। মণিকাও পোশাক ছাড়ে। উন্মোচিত হয় তার রত্নরাজি। স্বল্পবসনা মণিকার দিকে বুভুক্ষু চোখে তাকিয়ে থাকে ইলিয়াস। লক্ষ করে মণিকা বলে-‘কী দেখছেন অমন করে?’
‘তোমাকে।’
‘আবারো সেই পুরোনো সংলাপ?’
‘আসলে তুমি খুব… তুমি খুব… থাক, বলবো না!’
মণিকা বসে ইলিয়াসের পাশে। মৃদু ঝাঁকুনি দেয়-‘বলেন না ইলিয়াস ভাই?’
ইলিয়াস ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে কী যেন বলে। শুনে মণিকা বঙ্কিম গ্রীবায় কটাক্ষ হানে-‘আপনি না খুব অসভ্য!’
‘অসভ্যতার কতটুকু দেখেছো তুমি?’
‘অনেকখানিই দেখেছি এবং শুনেছি।’
পালাতে হবে জানাজানি হওয়ার আগেই। থানা পুলিশ হলে মহাকেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।
ইলিয়াসের যেন আর তর সয় না। চুমু খায় মণিকার ঠোঁটে গালে কপালে পীনোন্নত পয়োধরে। অবশিষ্ট বস্ত্র হরণ করতে তৎপর হয় ওর হাত। মণিকা সুড়–ৎ করে সরে যায়-‘ইলিয়াস ভাই, এখন না।’
‘কখন?’
‘সময় হলে বলবো!’
মণিকার ঠোঁটে উর্বশী মেনকার ঝলমলে হাসি। রহস্য এবং হেঁয়ালিতে ভরা।
‘ছিনালি করো না তো!’
ইলিয়াস মণিকার হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দেয়। নিজেকে সামলাতে না পেরে মণিকা আছড়ে পড়ে ইলিয়াসের বুকে। শুরু হয় ইলিয়াসের দক্ষ হাতের নিপুণ কাজ। মণিকাও বাধা দেয় না। নিজেকে একপ্রকার সমর্পণই করে।
তিন.
পরদিন ইলিয়াসের ঘুম ভাঙে সকাল এগারোটায়। পাশের সিটটা খালি। মণিকা নেই। প্রথমে ভাবে, বাথরুমে গেছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আবিষ্কার করে বাথরুমও খালি। হয়তো ইলিয়াসের উঠতে দেরি দেখে মণিকা একাই সৈকতে চলে গেছে। ঘুম জোরালো হবে না-ই বা কেন, রাতে ব্যস্ততা তো কম যায়নি! মোট কতবার উপগত হয়েছে-দুইবার তিনবার চারবার…? সঠিক হিসাব খুঁজে পায় না ইলিয়াস। উন্মত্ত মানুষের পক্ষে হিসাবনিকাশ রাখা কঠিন। রাতের কথা স্মরণ করে ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে।
ক্ষুধা পেয়েছে, মণিকাকে ছাড়া কীভাবে খায়। শেষমেষ রওনা হয় সৈকতমুখো। হাঁটতে হাঁটতে হয়তো মণিকার দেখা পেয়ে যাবে। রিসেপশনেও তথ্য দিয়ে যায়।
সৈকতে পা রেখেই একটু থমকায় ইলিয়াস। এক জায়গায় অনেক মানুষের জটলা। যদিও কালকের মতো অতটা মানুষজন নেই। সৈকত এখন অনেকটা ফাঁকা। জটলাটা কীসের? সে এগিয়ে যায়। ভীড় ঠেলে ঠেলে এগিয়ে দেখে একটা মৃতদেহ পড়ে আছে।
কোনো এক হতভাগিনীর। আরেকটু এগিয়ে যায় ইলিয়াস। আরো একটু। মৃতদেহের কাছাকাছি।
সে চমকায়। এবং চমকায়। ক্রমশ চমকিত হতে থাকে।
মণিকা!
মণিকার লাশ পড়ে আছে! কিন্তু এ কী করে সম্ভব?
ওই তো ওর পরনে রাতের পোশাকটাই।
গোলাপিরঙা থ্রি পিস।
গলার কাছটা কালচে হয়ে ফুলে আছে। ইঞ্চি দুয়েক জায়গাজুড়ে ফুলে ওঠা দাগ। সম্ভবত পরিকল্পিতভাবে কেউ ওকে খুন করেছে। ওড়না কিংবা মাফলার-জাতীয় কিছু গলায় পেঁচিয়ে। কিন্তু কে মণিকাকে খুন করবে, কার সাথে ওর শত্রুতা, কেন শত্রুতা?
ভাবতে পারে না ইলিয়াস। সবকিছু যুক্তির বাইরে চলে যাচ্ছে। ওর ভেতর থেকে কেউ একজন সতর্কবাণী দেয়-পালাও! বাঁচতে চাইলে পালাও। পালাতে হবে জানাজানি হওয়ার আগেই। থানা পুলিশ হলে মহাকেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।
রুদ্ধশ্বাসে বাসস্ট্যান্ডমুখো ছোটে ইলিয়াস। যুক্তি তর্ক নিরীক্ষা আর চিন্তাভাবনার সময় অনেক পাওয়া যাবে, গা বাঁচানোর সময় এখনই!