রানীকন্যা


-ছেলে!
-না মেয়ে।
-না ছেলে।
-না মেয়ে।
– আচ্ছা মেয়ে।

সবকিছুতেই দ্বিমত। তারপরও কেমন করে দুজনের মন এক হয়েছিল ভাবতে বসলে চিন্তায় যে কারো মাথার চুল পেকে যেতে পারে। নীতাও ভাবে-সত্যিই তো তাই! কী করে যে…। আবার শাহেদও ভাবে কী করে যে তাদের দুজনের মনের এতো মিল হয়েছিল? সেসব দিনের কথা ভাবলে মন ঝুনঝুনির মতো ঝনঝন করে উঠে! প্রেম-রোমান্স-অন্যরকম রিনরিনে শিহরণ মনের কোঠরে কারই বা কম ছিল? না নীতার, না শাহেদের।

ভাবতে বসে শাহেদ, প্রায়ই পার্টি অফিসে চিরকুমার নির্মল সেন বলতেন-‘মুসলমানদের আত্মীয়ের মধ্যে বিয়ের প্রবণতা একটু বেশি। কেন জানিস?’ না সূচক মাথা নেড়ে শাহেদ ভাবত-কেন? উত্তর না পেলেও একসময় নিজেই জড়িয়ে পড়ে এমনই এক সম্পর্কে। ফুফাতো বোন নীতার সব কাজে নাক গলাতে গিয়ে; পড়ালেখায় মাস্টারি ফলাতে গিয়ে একসময় বুঝতে পারে-আর কারো কথায় যখন কাজ হয়না; তখন নীতার কাছে শাহেদই ভরসা। বাড়িতে একটু মান-অভিমান হয়েছে কী; সাথে সাথে ফুপু ডেকে পাঠিয়েছে শাহেদকে। দুদিন না খেয়ে থাকা কিংবা সপ্তাহ ধরে স্কুলে না যাওয়া নীতার মান ভাঙাতে যেন শাহেদের জুড়ি নেই। এভাবেই চলছিল। মনের অজান্তে কখন নীতার প্রতি শাহেদ আকৃষ্ট হয়েছে তা যখন বুঝতে পেরেছে তখন পদ্মার বুকে আর পানি নেই-ধুধু বালুচর।

ঢাকা কলেজে বাংলায় অনার্স পড়ার ফাঁকে ছুটি পেলেই গাবতলী, সাভার, মনিকগঞ্জ, গোয়ালন্দ, রাজবাড়ি, গড়াই পেরিয়ে এসবি বাসে চেপে কুষ্টিয়া শহরে পৌঁছেও দম পেতো না প্রাণে! আঁইঢাই আইঢাই করতো শাহেদের মনের মধ্যে; কখন ফুপু বাড়ি যাবে সে জন্য। তারপর বাড়িতে মা-বাবা, ভাইবোনকে পুরোদস্তর সময় দিয়ে ঢাকা ফেরার পথে পদ্মার ধুধু বালুচর পায়ে মাড়িয়ে, ডিঙি নৌকায় ২ টাকা ভাড়া দিয়ে ওপারে আবার ধু-ধু বালুচর, বাদাম ক্ষেত, কাশবন-জংলা পেরিয়ে সকাল গড়িয়ে দুপুর-বিকেল; তারপর সেই সন্ধ্যামালতী ফুলের ঘ্রাণমেখে জোনাকির আলোয় ভর করে ফুপু বাড়ি। এরপর শাহেদের সময়টা খুব দ্রুত কেটে যেত-ছোটোখাটো খুনসুটি আর মান-অভিমানের পালা ভাঙতেই, কখনো উঠোনে পাটি বিছিয়ে গোল হয়ে বসে নীতা, তার বড় মিতা, সব ছোট রীতাকে নিয়ে গল্পের আসরও জমাতো। দলবেঁধে পদ্মার ঠাণ্ডা পানিতে গোসলেও গেছে কোনো কোনো দুপুরে-তারপর ফিরতে ফিরতে বেলা চলে যেত পদ্মার ওপারে রাজশাহীর কিনারে। নীতা একটু জেদি, একরোখা-বুদ্ধিমতী-স্কুল ফাঁকি দিলেও সেবার ক্লাস এইটে বৃত্তি পেলে শাহেদের আনন্দ ঢাকা কলেজ চত্বর পর্যন্ত চলে আসে!

অফিস থেকে নীতার কাছে ফোন করে দিনে শাহেদ অন্তত ৫/৬বার জানতে চায়, ‘আমাদের রানীকন্যা কেমন আছে?’

এরপর সময়টা খুব দ্রুতই কেটে যায়। রোদ-বৃষ্টি-ঝড়, শীত-জাড়-কাঁপুনি-কুয়াশার আসা-যাওয়ার ভিড়ে শাহেদ হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করে নীতাকে ছাড়া তার চলবে না। ততদিনে একটা মার্কেট রিসার্চ কোম্পানির এক্সিকিউটিভ পদে চাকরিও পেয়েছে। কিন্তু বাড়ীতে যোগ্য ছেলের যোগ্য পাত্রী খোঁজা শুরু হয়ে গেছে। বাবা-মা বিষয়টি জানলেও কেমন যেন আলগোছে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয় ঘটনাপ্রবাহ। দু-একটি মেয়েকে দেখানোও হয় কৌশলে, শাহেদ সরাসরি অপছন্দের কথা জানালেও: জানাতে পারেনা নীতার কথা ( যে-কথা সবাই জানে তা নতুন করে জানাতে বিব্রত-বিমর্ষ বোধ করে শাহেদ)। শাহেদের পৈত্রিক অবস্থাসম্পন্নতার দোহায় দিয়ে নীতা বরাবরই অমত করেছে জোরালোভাবে। আর ওর অমতেই যেন শাহেদ আরও বেশি আকৃষ্ট হয়েছে; কেন জানি ওকে জয় করার একটা যুদ্ধ মনে মনে ফেদে ফেলে শাহেদ। ওই একবারই যুদ্ধে পুরোপুরি জিতে যায় শাহেদ। তখন আর তাকে কে পায়? মনের মাঝে সবসময় একটাই ভাব-আমি কী হনু রে! দু-পরিবারের মন জয় করে শেষপর্যন্ত বিয়ে হয় শাহেদ-নীতার। সে আরেক যুদ্ধ যেখানে পুরো সাফল্য আসেনি; অনেকেই সরাসরি না হলেও মনে মনে বিপক্ষে দাঁড়িয়েছে ওদের।

বিয়ের পর কিংবা তারও আগে থেকেই দুজন আরেকটা বিষয়ে একমত হয়েছিল-এত দুঃখের পৃথিবীতে নতুন করে আর কাউকে আনা যাবে না। বাবা-মা যেমন তাদেরকে নিয়ে সুখী হতে পারেননি শতভাগ। ওরা আশপাশের অন্য বন্ধুদেরও দেখেছে-পরিবার দেখেছে; সবাই কেমন করে যেন যৌথ পরিবার ছাড়ছে; বাবা-মার দুঃখ-কষ্ট বাড়ছেই…। ছেলেমেয়েকে ‘মানুষ’ করতে বাবা-মার কষ্টের সীমা থাকেনা-আর সেই ছেলেমেয়েই বড় হয়ে দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়ায় সবচেয়ে বেশি…। শাহেদ সেই হাইস্কুলে পড়ার সময়ই নিজবাড়িতে দেখেছে সামান্য তুচ্ছ ঘটনায় ক্ষিপ্ত ছোটো চাচা দাদিকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছে। ওই ছোটোচাচা জুয়া খেলার টাকা না দেয়ায় দাদার সঙ্গে শুধু খারাপ ব্যবহারই করেননি, একদিন সারাদিন দাদাকে ঘরে আটকে দরজায় তালা দিয়ে বাইরে বটি হাতে বসেছিল-দাদীও ভয়ে দরজা খুলতে যাননি।

এবার দুজনেই হারলো, যাকে বলে গো-হারা। নীতা-শাহেদের প্রথম বিবাহবার্ষিকীর ঠিক ৫০ দিন আগে ও পৃথিবীতে এলো। কিন্তু তার আগেই শাহেদ আরেকবার হারল। কেননা সন্তান হচ্ছে নিশ্চিত হবার পর নীতা এবরশনের পক্ষে মত দিলেও দু-মাসের ভ্রুণ নষ্টে শারীরিক সমস্যা হতে পারে এমন ডাক্তারি পরামর্শের পর শাহেদ ভবিষ্যৎবাণী করল-আমাদের ছেলে হবে। আর নীতা যেন বিরোধিতা করতে হয় তাই করল; না, মেয়ে হবে। এই প্রথম নীতার কোনো ভবিষ্যৎবাণী সত্যি হল। শাহেদের মনে হল-চেয়েছিলাম ছেলে। যদি হতো তাহলে অন্তত এর জন্য একটু টেক কেয়ার-একটু ভালোবাসা মনের মধ্যে আসলেও আসতে পারত। যেহেতু চাওয়ার বিপরীত-তাই ওর দিকে ফিরে তাকাতেও হবে না নিশ্চয়। কিন্তু এবারও শাহেদের হারবার পালা-একেবারে হাতি-হারা (পায়ের নিচে কুলের আটি পড়া/কাদায় পা পুঁতে যাওয়া-হাতি আরকি)। মেয়ের মুখের দিকে প্রথম তাকানোতেই কুপোকাত! সব বিতৃষ্ণা-না চাওয়ার প্রাপ্তি নিমেষেই উবে গেলো।

ভালো-লাগা; স্নিগ্ধ-অনুভূতির প্রকাশ ভাষায় করা শাহেদের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব হল না! অনেকদিন পর তার চিৎকার করে-পাড়া-কাঁপিয়ে বলতে ইচ্ছে করল- ‘বাবা-মা ছেলেমেয়ে একদিন তার গলার কাটা হবে জেনেও; কেন ছেলেমেয়েকে এতো ভালোবাসে।-এই প্রশ্নের উত্তর আমি পেয়ে গেছি। হাঃ হাঃ…।’ এ হাসির গমকে যেন চমকে উঠে পৃথিবীর সকল অপিতা (ভবিষ্যতের হবু পিতা)। আর নীতা এখন মেয়ে বলতে সজ্ঞান (অজ্ঞান)। পৃথিবীর সব কাজ পড়ে থাকে; ট্যা-শব্দের দৌড়ে। শুধু পড়ে থাকে না মেয়ে। এমনকি বিছানাতেও বেশিক্ষণ থাকে না সে…! নীতার কোল যেন ৯৯ বছরের জন্য লিজ নিয়েছে ও। আর শাহেদ অফিস শেষে যে কিনা কাজল-মিল্কী কিংবা সুখীর সাহচর্যে বন্ধুপরায়ণ হয়ে উঠত। সেই শাহেদই এখন অফিস থেকে ফেরার পথে জ্যামে পড়লে রিকশা থেকে নেমে দৌড়াতে থাকে বাসার দিকে। তার কোলজুড়ে ছোট্ট মাংসপিণ্ডটা কত কী-ই না করে। সবকিছুই ভালো লাগে; এমন কী হিসু করলেও!

পুনশ্চ: বাবা-মা হয়েছেন যারা-এ গল্পটি তারা না পড়লেও চলবে। শাহেদের মেয়ের বয়স মাত্র ৫ মাস। নীতার শাহেদের দেওয়া একটা নাম আছে; নামটা আর কেউ জানে না। কিন্তু অফিস থেকে নীতার কাছে ফোন করে দিনে শাহেদ অন্তত ৫/৬বার জানতে চায়, ‘আমাদের রানীকন্যা কেমন আছে?’