আল মাহমুদ। বাংলা সাহিত্যের পঞ্চাশের একটি স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর। ইউরোপীয় সাহিত্যের কাঠামোগত উপাদানকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে, ভূগোলে ফেরার প্রত্যয়ে যে ক’জন শিল্পী সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন, আল মাহমুদ তাদের একজন।
আল মাহমুদ। লেখক জীবনের বড় একটা সময়, প্রতিক্রিয়াশীলতার দোষে, যথেষ্ট সমালোচনাও তার কপালে জুটেছে; এটি সত্য এবংঅবধারিত। শুধু শিল্প-প্রতিভার আলাদা বৈশিষ্ট্যের জোরে তিনি টিকে যাবেন এই আশা নানাভাবে করা যায়।
কবিতার পাশাপাশি তার ছড়া-গদ্যের হাত যেমন শক্তিশালী; তেমনি গল্প উপন্যাসেও তার জোর-শক্তি কম নয়। পাক ভারত উপমহাদেশের বঙ্গজ মানুষ, তাদের আচরণের সংস্কৃতি ও প্রকৃতিঘন যে সৌন্দর্য, সেই সৌন্দর্যকে নিজস্ব ঘরানায় আনতে সর্বদা প্রচেষ্ট ছিলেন তিনি; বিশেষ করে ভাটি বাংলার চির চেনা ঝাউপথ, সরোবরের স্নিগ্ধ অমল-ধবল আঁষটে রূপটিই-তিনি ধরতে চেয়েছেন। তার প্রকৃতি বর্ণনার রূপ-ঘনিষ্ঠতার সাথে পরিপার্শ্বের বহুকিছু সুন্দরময় হয়ে ওঠে। তার সাহিত্যে, ভাটি-বাংলার ললিতকলার বিন্যাস— বাংলার মানুষের খাওয়া দাওয়া চলা ফেরা রুচি অভ্যাস তথা জৈবিক অনুভূতির একটি ধারালো স্বরূপ আছে।
বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি ‘লোক লোকান্তর’, ‘কালের কলস’ এবং ‘সোনালি কাবিন’ এর মতো কিছু কাব্যগ্রন্থ’র সাথে গল্পকার হিসেবেও আল মাহমুদ, মহা সন্তের কিছু ভূমিকা দারুণভাবে পালন করেছেন। গল্পে— বিশেষ করে ‘পানকৌড়ির রক্ত’ ‘জলবেশ্যা, ‘কালো নৌকা’সহ এরকম উল্লেখযোগ্য গল্পের পাঠোত্তরে, নানাভাবেই আমাদের একটু নড়ে চড়ে বসতে হয়। তার ভাষার সৌকর্য আর মাটিজাত চরিত্রগুলো একটি সম্পন্ন সত্তার নিজস্ব রূপ নিয়ে ফুটে ওঠতে চায়—তখন আমরা ইউরো সাহিত্যের মোচড় পর্ব থেকে বেরিয়ে আরেকটি ভেষজ গন্ধের কৃষ্টি-বাংলা তথা কৃষ্টি-সংস্কৃতির সহজাত রুপটিই অনুভূত হতে দেখি। আজকের পর্বে আল মাহমুদ এর ‘পানকৌড়ির রক্ত’ নামের একটি অনবদ্য গল্পের, ছোট্ট ভূমিকা তথা সারাংশ-রূপ তুলে ধরার চেষ্টা হয়েছে ; সেই সাথে পঞ্চাশের ঘরানা ও বৈশিষ্ট্যের যে রূপ-লক্ষণগুলো ফুটে ওঠেছে, সংক্ষেপ-গল্পে তার শিল্প-কুঞ্চনটাই স্পষ্ট করার চেষ্টা হয়েছে।
পানকৌড়ির রক্ত। ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত হওয়া গল্পটির ভেতরের রূপ-রূপান্তর, আমাদের জলা-জংলার ভেতরে উত্থিত উদ্ভিদ তথা প্রাণির সংবেদন থেকে ওঠে এসেছে। গল্পের ধ্রুপদি ভাষা ও শব্দ চয়নে যার আবেদন এখনো আছে।গল্পের পানকৌড়ি প্রাণিটিও ঠিক তেমন; অ্যান্টার্কটিকা তথা দক্ষিণ মেরু বলয়ের কোট পরা ভদ্রলোক, প্যাঙ্গুইন-যেমন বরফ অঞ্চলের নির্দিষ্ট ভূগোল তথা পরিপার্শ্বের বাস্তবতা থেকে ওঠে এসেছে। ক্যাঙ্গারু, এনাকোন্ডা, ড্রাগন— এইসব শক্তিশালী প্রাণির মর্যাদা, কল্পনাশক্তি তথা দেবতা-প্রতীকিও আলাদা দেশের বাস্তবতা, প-সৌন্দর্য ও বিবেচনা থেকে ওঠে এসেছে— পানকৌড়ির ভেতরেও আছে, লেখকের নিজস্ব ভাটির নিজস্ব প্রাণির প্রতি নির্দিষ্ট চয়েস বা ভাল লাগা। তারই সাথে সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে পানকৌড়ি নামক প্রাণিসত্তাটির পরিপূরক বা সমান্তরাল করে তোলার যে কল্পনা শক্তি, তা ভাটি বাংলার মৃত্তিকাভেদ্য অরূপ সন্ধানি কোনো প্রকৃত শিল্পীর পক্ষেই সম্ভব যেটা তিনি অনায়াসে পূরণ করতে সমর্থ হয়েছেন—ভাটি বাংলার গার্হস্থ্যভিত্তিক যৌনতার একটি বাস্তুধারা আছে; যেটি অনেক বেশি নিজস্ব, আঁষটে ও পুঁতিগন্ধময়; সেটিও তিনি অনবদ্য রূপে ফুটিয়ে তুলেছেন।
‘পানকৌড়ির রক্ত’ গল্পের পাঠোত্তরে নির্দিষ্ট কিছু লাইনবন্ধে, গল্পের অভিনিবেশ যেভাবে ধরতে চেষ্টা হয়েছে—‘আমি যখন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হয়েছি তখন ফ্রকপরা একটি শ্যামলা মেয়েকে দেখতাম আমার বিধবা মায়ের সাথে বেশ ভাব জমিয়ে বারান্দায় কথা বলছে’।
এই যে ফ্রক পরা শ্যামলা মেয়ে; শ্যামলা শব্দটি মা কালির সমার্থক। এটি কালির সৌন্দর্য ও শক্তিকে প্রকাশ করে। আবার কালি অনার্য।এই ভাটি বঙ্গে যার আলাদা কদর রয়েছে। এবং শ্যামলা শব্দের সাথে বাংলার সবুজ নামটি জড়িয়ে আছে; এটি শ্যামল প্রকৃতির প্রতিনিধিত্ব করে। সেই অর্থে গল্পের চরিত্রের সাথে শ্যামলা নামের শব্দবন্ধটি বিশেষ তাৎপর্য বহন করে।
‘আদিনার সাথে পানকৌড়িটার কোথায় অমন মিল আছে আমি ধরতে পারছিলাম না। অথচ পাখিটা যেই পালক ঝাড়ছে, গ্রিবা দুলিয়ে এপাশ ওপাশ দেখছে ততই মনে হচ্ছে আমি আদিনার মধ্যে এরূপ ভাবভঙ্গি দেখেছি ।’
এখানে আদিনার রূপ-সৌন্দর্য আর আবেদনের সাথে পানকৌড়ির রূপ-সৌন্দর্য আর ভঙ্গি দু’টাই সমার্থক ও অনন্য হয়ে ওঠেছে ; দুই প্রাণিসত্তা ভাটি বাংলার, নদীকেন্দ্রিক পালতোলা কোনো নৌকার চলন তথা ছন্দ-গতির তালকে নিয়েই সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে; এতে করে আদিনা আর পানকৌড়ি দু’টাই একই ভূগোলের, দুই পাড়ের দুটিপ্রাণির অস্তিত্ব বা সত্তাকে প্রকাশ করে—নরম পলিমাখা বাংলার মাটি-অন্বেষিত রূপটাই যেখানে ফর্সা হয়ে ওঠে।
“আমি আবার আমার একনলা বন্দুক হাতে ত্রিকোণাকৃতি চরভূমির নরম গুল্মলতায় পা মাড়িয়ে চলতে লাগলাম। নদীটা যেখানে বাঁকনিয়েছে আমি সেখানে এসে পেশাদার শিকারির মতো হাঁটু গেড়ে বন্দুক বাগিয়ে বসলাম। আমার বসার সাথে সাথে কালো বেলুনের মতো একটা পানকৌড়ি পানির ওপর ভেসে উঠল। আমি মুহূর্তমাত্র বিলম্ব না করে গুলি ছুড়লাম। গলির শব্দ আর বন্দুকের পাল্টা ধকলে আমার চোখের সামনে সমগ্র নিসর্গচিত্রটি ফেটে চৌচির হয়ে গেল। আমি দেখলাম, একটি শ্যামবর্ণ নারীশরীর নদীর নীলিমায় আপনরক্তের মধ্যে তোলপাড় করছে।’
ভাটি বাংলার লেপ্টে থাকা সবুজ নরম মাটি; গুল্মলতার পা মাড়িয়ে তন্ময় হেঁটে যাওয়া আর সঙ্গিনীর নরম শরীরী-সংবেদনা তথা তার যোনিমণ্ডলের পরিপার্শ্বের সৌন্দর্যকে গুল্মলতার সাথে তুলনা— এটি একটি অনবদ্য এবং শক্তিশালী চিত্রকল্প। এখানে লেখকের নিজের ভাটি বাংলার ঘন-প্রকৃতি, মানুষের জৈবিক তাড়না, রতি ক্রিয়ার মাটিগন্ধী বাস্তু ঘর, আসবাব, এমনকি লোটা বদনা থেকে শুরু করে প্রত্যেক বস্তুর আবেদনকেই যেন (অবচেতনে) অন্য-মাহাত্ম্যে ছুঁয়ে যায়; সর্বোপরি এই জলা-ভূ-বাংলার রতি ক্রিয়ার নিজস্ব স্টাইল বা পাঠ-পদ্ধতির, একটি নিজস্ব ভঙ্গিও অনবদ্য করে ফুটে উঠে—যে আবেদন, আবহ বা আবেশগুলো আলাদা তথা স্বতন্ত্র। যৌনতা এখানে সহজাত রূপে ফ্রয়েডের মনো বিকলন তথা তার ভারসাম্য রক্ষা করেই সম্পন্ন হয়েছে।
উল্লিখিত গল্পে বন্দুক, গ্রীবা, শ্যামলা আদিনা, চঞ্চু, বারুদের গন্ধ ইত্যাদি শব্দচয়ন ও নাম করণের বিবিধ উপস্থাপনগুলো প্রখর অনুভূতি সম্পন্ন একজন যথার্থ শিল্পীর পক্ষেই সম্ভব। যিনি তেঁতুলের বহিরাভরণের ফিগার-কাঠামোর আবেদন বুঝতে পারেন; টকফলের অম্ল-মিষ্টতাও একদম সহিভাবে ধরতে পারেন। ভাল বর্ণ বুঝেন; রঙের ব্যবহার জানেন; পেইন্টিং বুঝেন; চিত্রগল্প বুঝেন—লেখকমাহমুদও ভাটি-বাংলার (ললিত কলার) সব ধরনের বস্তু ও অবস্তুগত সত্তাকে অনুভূতির শক্তিশালী মাত্রায় ছুঁয়ে যান।
রামায়ণ, মহাভারত, কামসূত্র, শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের লীলায় আছে পাক ভারতের বিশাল ধ্রুপদি (প্রকৃতিলগ্ন) স্পেইস তথা অনন্য সংবেদন; এছাড়াও অজন্তা ইলোরার রহস্যাবৃত নির্মাণ থেকে শুরু করে আয়ুর্বেদীয় ভেষজ চিকিৎসা পদ্ধতির যে প্রাকৃতিক-মিষ্টতা, সেই মিষ্টতার ভেতরের আঁশ ও শ্বাস যে ধরতে পেরেছে, তিনিই হচ্ছেন যথার্থ ভ্রমর—ভলগা থেকে গঙ্গা, আরণ্যক, শ্রীকান্তের পরিভ্রমণ ও নিসর্গ বর্ণনার ধারালো পরিক্রমা—এইসব বিবিধ বাঁক পরিক্রমা অথবা অবচেতন পরিভ্রমণের তিল-সারাংশ’ পানকৌড়ির রক্ত’। যেটি লেখকের নিজের মোহনায় এসে সঞ্চরণশীল থেকেছে। পঞ্চাশের গল্প-সাহিত্য তথা আধুনিক বাংলা সাহিত্যের একটি অন্যতম সংযোজন এই গল্প।
মানুষের মনের আবেগকে বলা হয় ভাব। এই ভাবের পুরিপুষ্টি তথা অনুধাবন থেকেই রসের উৎপত্তি। রসের মানসিক উপাদান ভাব। রসের দিক থেকে এই গল্পটি, শৃঙ্গার রস বা সম্ভোগ রসে সমর্পিত। কিন্তু যথার্থ শিল্পকে বাদ দেওয়া হয়নি বলেই ‘পানকৌড়ির রক্ত’ গল্পটি একটি আলাদা আর্ট বা শিল্পোত্তীর্ণ গল্প হয়ে উঠেছে।
শিল্প সাহিত্যে আমাদের চিরাচরিত একটি বাজে অভ্যাস আছে। কোন শিল্পকে একপেশেভাবে শুধু দু’একটি রসের মধ্য দিয়ে নিজের অবচেতনে নিজের বিকৃতিকে প্রকাশ করা। সাহিত্য বিচারে এটি এক রোখা মানহীন হতে বাধ্য। কারণ শিল্পের জন্য শুধুই শিল্প এ থিওরিও যুগবিচারে এখন আর চলে না। তাছাড়া জগতের কোন কিছুই রাজনীতির বাইরেও নয়। সাহিত্যেও যে রসের কথা আমরা বলি; শৃঙ্গার রসসহ আরো যত (রস) ঐশ্বর্য আছে; এইসব বিবিধ উপস্থাপনের সাথে পরিপার্শ্ব, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যও বাদ পড়া উচিত নয়। সচেতন ও সময়জয়ী শিল্পী এই প্রবণতাগুলো টোটালি এড়াতে পারেন না।
১৯৭১-এর রক্তক্ষয়ী মহাকাব্য মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী একটি নতুন দেশ, ভূ-খণ্ড তথা বাংলাদেশের কথা আমরা বলি। অথচ এই বাংলার মাটির গঠন, পলিময় সংবেদন, প্রত্নতত্ত্ব বা ভূগোল নির্মাণের কাজটি শুরু হয়েছে আজ থেকে হাজার বছরেরও আগে; বিভিন্ন প্রত্ন-নিদর্শন তথা বাংলাদেশ পরবর্তী অনেক নতুন নিদর্শনের মধ্য দিয়ে (আজও চলমান আছে) যা বরবরই স্পষ্ট; এর সাথেই লীন হয়ে আছে এই বঙ্গেরই পুরনো রক্তধারা, চলা ফেরা, আহার পদ্ধতি, রুচি স্টাইল ও ব্যক্তিত্ব। যেমন খনা। খনা পাক ভারতের কৃষি বাংলার অমোঘ সম্পদ; জ্যোতির্বিদ্যাও যার মজ্জাগত; মোটাদাগে মৈমনসিংহ গীতিকা থেকে শুরু করে চন্দ্রাবতীর ঐতিহ্যসহ ভাটিবাংলার মোদ্দা-কিছু রূপ নিংডে নিলেই, আমরা এমন সব গল্পের আলাদা বৈশিষ্ট্য বা চরিত্রের সন্ধান পাই। আল মাহমুদ সেই সব প্রবণতা তথা উত্তরাধিকারের প্রতিভূ। জীবনানন্দ পরবর্তী (প্রকৃতির ঘন-আবেশসহ) আরো কিছু বৈশিষ্ট্যকে অধিগ্রহণে, মাটিবর্তী সৃজনে ও মননে ধরতে প্রয়াসী হয়েছেন আল মাহমুদ, গল্পেও যার বিশেষ আভা পাওয়া যায়।
‘পানকৌড়ির রক্ত’ গল্পটির সারাংশ বা এনাটমি করলে, আমরা উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা, গার্হস্থ্যবিদ্যা, শরীরবিদ্যা তথা প্রত্নবিদ্যার বিশালস্বরূপের সাথে অনবদ্যভাবে মিলিত হতে পারি; যেটি হাজার বছরের বাংলার বড় ক্যানভাস ছুঁয়ে, এই বাংলাদেশে এসে নিজের অবস্থা ও অবস্থান-কল্পটি নিশ্চিত করেছে। এছাড়াও বলতে হয় বাৎসায়ন এর কামসূত্র যেমন শুধু আর্ট অফ লিভিং নয় আরও অতিরিক্ত বা জরুরি কিছু। বিশিষ্ট ভাষাতাত্ত্বিক কলিম খান যেমন কামকে কাজ নামে সম্বোধন করেছেন; এবং গৌরবান্বিত করেছেন। পানকৌড়ির রক্ত গল্পটির সম্ভাবনাও এমন উতরে গেছে। গল্পে, এও হতে পারে— গল্পের চরিত্রগুলোও যে (আঁষটে গন্ধ ফেলে) সময় বিচারে আরো পাল্টাতে পারবে না তার দুর্বল কোন ইঙ্গিত এখানে নেই।