মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু তার ‘কথা’। যে কথা একবার মুখ থেকে বের হয়ে যায়, সে কথা কোনো না কোনোভাবে শত্রুর জন্ম দেবেই। ‘সেই কথা’টুকু সত্য হোক কিংবা মিথ্যা হোক, তাতে শত্রুতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে কোনো হেরফের হবে না। এখন সবার আগে সামনে যে প্রশ্ন উঠছে, তাহলে কি মানুষ কথা বলবে না? ‘বোবার শত্রু নাই’ বলে যে প্রবাদ আছে, তাকেই মান্য করে চলবে? প্রথম প্রশ্নের উত্তর যদি ‘না’ এবং দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর যদি ‘হ্যাঁ’ও হয়, তাহলেও মানুষ শত্রুমুক্ত থাকতে পারবে না। সমাজে-সংঘটিত নানামুখী ঘটনা-দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেও ব্যক্তি যদি চুপ থাকে, তাহলে একদল বলবে, ‘লোকটা সুবিধাবাদী, তাই জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতেও চুপ করে আছে।’
কল্যাণমূলক চিন্তার দিক থেকে মানুষকে দুই শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। প্রথম শ্রেণী কল্যাণকামী, দ্বিতীয় শ্রেণী ধ্বংসকামী। কল্যাণকামী মানুষের ধর্মই হলো, যে-সব কর্মকাণ্ডের ফলে সমাজ-রাষ্ট্র-মানবজাতিসহ বিশ্বসংসারের কল্যাণ সাধিত হয়, সেই ধরনের কর্মকাণ্ডে নিজেকে নিয়োজিত রাখা। আর সব ধরনের অকল্যাণ ও ধ্বংসাত্মক কর্মযজ্ঞ থেকে বিরত থাকা। কল্যাণকামী মানুষের পথ সাধারণত মসৃণ হয় না। তাদের পদে পদে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে ধ্বংসকামী, হিংস্র ও ভয়ঙ্কররা। ফলে যে কাজে সাফল্য অর্জন মুহূর্তের ব্যাপার মাত্র, সেই কাজই যুগ-যুগান্তর পার হয়ে যায়। কারণ সমাজের অধিকাংশ মানুষ রঙিন মিথ্যায় ভোলে, সাদাকালো সত্যায় আস্থা রাখতে চায় না। তাদের কাছে ‘সত্য তত প্রিয় নয়, যত প্রিয় মোহন মিথ্যারা’। এই মোহন মিথ্যাচারীরা সমাজকে বাকচাতুর্যে ধরাশায়ী করে একদিকে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে, অন্যদিকে সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে বাধা দেয়। ফলে সংসার মিথ্যাচারীদের ষড়যন্ত্রকে মনে করে ঐশীবাণী, আর সত্যবাদীদের প্রাণান্তকর সাধনাকে ভাবে পণ্ডশ্রম। তাই ‘দৃশ্যত নিষ্ফল সাধনা’কে সংসার গুরুত্বহীন ভাবে। দৃশ্যত চাকচিক্যময় মিথ্যার জগৎকে তাৎপর্যপূণ মনে করে।
ধ্বংসকামীরা সংসারকে ভুল পথে পরিচালিত করার জন্য নিপুণ কৌশলের আশ্রয় নেয়। তারা সবসময় উপস্থিত ঘটনাকে গুরুত্ব দেয়, অতীতকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। বিশেষত কোনো জাতির অতীতের গৌরবজনক অধ্যায়কে তারা মূল্যহীন করে দেখে। জাতির সংকটকালে তারা হয় নিস্ক্রিয় থাকে, নয় বহিঃশত্রুর সঙ্গে হাত মিলিয়ে জাতিকে বিপদের দিকে ঠেলে দেয়। যেমন ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধে দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য কল্যাণকামীরা প্রাণ উৎসর্গের লড়াইয়ে নেমে পড়লেও ধ্বংসকামীদের একাংশ ছিল নীরব। আরেকাংশ সরাসরি আল বদর, আল শামস ও রাজকারের খাতায় নাম লিখিয়েছিল। শুধু নাম লিখিয়েই ক্ষান্ত থাকেনি, তারা গ্রামকে গ্রাম ধর্ষণ, জ্বালাও-পোড়াও, হত্যা-খুন, ধর্ষণ-গণধর্ষণে মেতে উঠেছিল। এর আগের ঘটনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ১৭৫৭ সালের পলাশীর আম্রকাননের যুদ্ধ। একদিনে নবাব সিরাজের দেশপ্রেমিক সৈনিক দল, অন্যদিকে মীরজাফরের অনুসারী দেশদ্রোহীরা। ওই যুদ্ধের ফল নবাবের পরাজয়, বিশ্বাসঘাতকদের আপাত জয়। এই দুটি সত্য ঐতিহাসিক সত্য। তাই তথ্যসূত্র দিয়ে নিবন্ধের কলেবর বাড়াতে চাই না।
তাই তাকে চুপ না থেকে তার ব্যক্তিগত সততা, নিষ্ঠা, দেশপ্রেম, মানবপ্রেমের জায়গা থেকে কথা বলে যেতেই হবে। ফলের আশা করা যাবে না। তবেই দেশ-দশ ও বিশ্বসংসারের মঙ্গল।
এবার প্রশ্ন উঠতে পারে, নিবন্ধটি কথাবিষয়ক, সেখানে ঐতিহাসিক ঘটনার অবতারণা কেন? এই প্রশ্নের যেমন সঙ্গত কারণ রয়েছে, তেমনি ঐতিহাসিক ঘটনার অবতারণা করারও রয়েছে যথেষ্ট যুক্তি। কল্যাণ-অকল্যাণ বিবেচনায় মানবজাতিকে দুই ভাগে বিভক্ত করতে গেলে, তাদের কর্ম ও কর্মফলের বিচার অনিবার্য। সেই অনিবার্য কার্যকারণ-যুক্তির নিরিখেই ঐতিহাসিক ঘটনার প্রসঙ্গ টানতে হলো।
ব্যক্তি কথা বলুক কিংবা চুপ থাকুক, তার কমবে না। বন্ধু কমবে। পরশ্রীকাতর ও বিধ্বংসকামীরা সবসময় কল্যাণকামীদের বিরূপ সমালোচনা করবেই। কথা বললে, তাতে ত্রুটি খুঁজবে, চুপ থাকলে তাদেও দোষ দেখবে। কথা বললে সেই ‘কথা’ পরশ্রীকাতর-বিধ্বংসকামীদের পছন্দ হবে না, তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যাবে, তখন তারা ব্যক্তির ‘কথা’র বিরূপ সমালোচনায় উন্মত্ত হবে। আবার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে ব্যক্তি চুপ থাকলে পরশ্রীকাতর-ঈর্ষাপরায়ণরা সেখানে ‘নীরব ব্যক্তি’র ভেতর স্বার্থপরতার সন্ধান করবে। তাদের দিক থেকে অভিযোগ উঠবে, ‘লোকটি স্বার্থপর, তাই জনস্বার্থে কিছু বলছে না।’
উল্লিখিত আলোচনা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, ‘বোবার শত্রু নেই’ কথাটা যতই শ্রুতিমধুর হোক, বাস্তবে তার ভিত্তি নেই। শত্রু সরবের যেমন আছে, তেমনি বোবারও আছে। সরব ব্যক্তির শত্রু সীমিত কিংবা বোবার শত্রু অসীম। বোবা কথা বলে না, তাই তার বিরুদ্ধে মনের মাধুরী মিশিয়ে মিথ্যাচার করা যায়। শত্রুরা তাই করেও। অতএব ব্যক্তি চুপ থাকলেও তার শত্রু বাড়বে, কথা বললেও বাড়বে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুনকে তার সারথী শ্রীকৃষ্ণ বলেছিলেন, ‘হে পার্থ কর্ম করে যাও, ফলের আশা করো না’। অর্থাৎ কর্মীর কাজ কর্ম করা, ফল কী হবে, তা নিয়ে ভাবিত না হওয়া। তেমনি কথাও একধরনের কর্ম, বলা ভালো সর্বোত্তম কর্ম। তাই তাকে চুপ না থেকে তার ব্যক্তিগত সততা, নিষ্ঠা, দেশপ্রেম, মানবপ্রেমের জায়গা থেকে কথা বলে যেতেই হবে। ফলের আশা করা যাবে না। তবেই দেশ-দশ ও বিশ্বসংসারের মঙ্গল।