গরু-ছাগল ও ছাগল-গরুর দুনিয়ায়


গরু-ছাগল পর্ব
এত বড় ধরাও খেতে হয় গরু কিনে! অপুষ্ট, রুগ্‌ণ গরুটার প্রকৃত চেহারা দেখে আবদুল মালেকের বেদিশা অবস্থা। আরও আগেই বোঝা উচিত ছিল ঠকার বিষয়টা। কোরবানির ঈদ সামনে রেখে গরু কিনে ফিরছেন আর লোকে দাম জিজ্ঞেস করেনি এমন হয়নি কখনো। এবার জিজ্ঞেস করেনি একবারও। দড়ি হাতে হাঁটার সময় কেউ বাতচিত এলে মন্দ লাগে না। খুব আনন্দের সঙ্গে দাম বলে দেওয়া যায়। দাম যদি কম শোনে, লোকজন খুশি হয়ে ওঠে, যেন বাজারের বিক্রেতার সঙ্গে টেক্কা দিয়ে তারাই জিতেছে। আবার দাম বেশি মনে হলে ‘জিজ্ঞাসাবাদ’কারী লোকরাই বিমর্ষ হয়ে পড়ে, এত ঠকাও কেউ ঠকে!

এবার এত বড় দাগা খেলেন কীভাবে! সঙ্গে দুই মাত্র সন্তান মশিউরও ছিল, সে এই পরিবারের ছোট ছেলে। কিন্তু কী দেখল মশিউর! পাড়াপড়শির কথা না-হয় সহ্য হয় কিন্তু ঘরের মানুষ খোঁটা দিয়ে কথার হুল ফোটালে? রাগত স্বরে ছেলেকে ডাকলেন তিনি। মশিউর সভয়ে সামনে এসে দাঁড়ালে আবদুল মালেক বললেন, ‘আমি না-হয় চোখে কম দেখি, তুই কী দেখলি? এমন আধমরা গরু কেনালি কেন! সেটা কি মানুষের কাছে আমাকে অপমান করানোর জন্য?’
‘আপনাকে বারবার সতর্ক করেছিলাম, আব্বা!’
‘কীভাবে সতর্ক করেছিলি? অহেতুক তর্ক করিস কেন আমার সঙ্গে!’
‘আপনেরে কইছিলাম না, গরু লাট!’

মালেক সাহেবের মনে পড়ল কথাটা। ছেলে বলেছিল। এমন কথা কেন বলবে মশিউর! গর্জন করে বললেন, ‘লাট মানে কী রে!’
‘ইয়ানও ভুলি গেছেন আব্বা? লাট মানি রোগা গরু; অপুষ্ট! ব্যারাম কবলিত।’

শৈশবেই ছেলেকে গ্রাম থেকে এনে শহরে রেখেছেন। কী আশ্চর্য, গ্রামীণ কিছু শব্দ সে প্রমিত বাংলার সঙ্গেও অবলীলায় ব্যবহার করে এখনো! থেকে থেকে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতেও ছাড়ে না। দোষটা মালেক সাহেবের নিজেরই, মাথা ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করেন। ছেলে যখন গরুটিকে ‘লাট’ বলছিল বারবার, তার মন চলে গিয়েছিল ব্রিটিশ আমলে। তার চোখে এমন দৃশ্য ভাসছিল তখন, লাট সাহেবের ছেলে-মেয়েরা ঠাঁটবাট দেখিয়ে বাজারের সবচেয়ে ভালো গরুটা কিনছে। তাই নিজেকে লাট সাহেব ভেবে গরুটিকেও গুলিয়ে ফেলেছিলেন। মনে মনে গোপন গৌরব বোধ করেছিলেন এটা ভেবে, গরু নিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় লোকজন ভাববে লাট সাহেব যাচ্ছে! সাহেবের গরুও তারই মতো খান্দানি! কিন্তু কী বুঝতে গিয়ে কী বুঝলেন।

একটি অর্ধ জাতীয় দৈনিক শিরোনাম করল, ‘অবশেষে আলোচিত সেই ছাগল ঘুমাচ্ছে সোনার খাটে!

রোষ কষায়িত দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকালেন তবুও। একী, মশিউরকে এত নাদুসনুদুস লাগছে কেন! বিভ্রান্ত হয়ে চশমাটা খুলে ফেলেন। আবছা দৃষ্টিতে দেখেন, সব ঠিকই আছে। আবার চশমাটা চোখে বসান; এবার মশিউর আগের মতোই হৃষ্টপুষ্ট। তার মানে সব সমস্যার মূলে এই ‘রঙিন চশমা’! তার মানে হচ্ছে, যত দোষ এই বেশি পাওয়ারের চশমার। নতুন কেনা চশমাটার জন্যই রোগা গরুকে মোটা-তাজা দেখেছিলেন। এ জন্যই লোকে বলে, চশমা আর বউ দুটোই পুরোনো ভালো!
মাথা ঠাণ্ডা হলে মশিউরকে জিজ্ঞেস করেন, ‘এখন তাহলে কী করা যায়? এমন অসম্মান এই বয়সে কীভাবে সহ্য করব!’
‘এবার আমরা সবদিকেই ঠকেছি। গরুর হাটে এত টাকা হাসিল দিতে হলো! নইলে হাসিলের টাকায় আরেকটা ছাগল কেনা যেত। ইজ্জত কিছুটা হলেও রক্ষা করতে পারতেন!’
‘অসম্মানটা শুধু আমার একার!’

ছেলেও তাকে ঠিকমতো বুঝতে পারল না। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন মালেক সাহেব। গরু কেনার পর হাসিল গুনতে হলো ৫ শতাংশ হারে, এটা মগের মুল্লুক ছাড়া আর কী! খাজনার বাজনা কমানোর জন্য কম তর্কাতর্কি করেননি। ইজারাদার শুনিয়ে দিয়েছে, পুরো শহরেই নাকি এই নিয়ম। দেয়ালে লাগানো পোস্টারগুলোতেও ফাইভ পার্সেন্ট কথাটা লেখা আছে। দীর্ঘশ^াস গোপন করে ভাবলেন, এজন্যই বোধহয় সাবেক ভিলেন ও নেতা চলচ্চিত্রের সমস্যাগ্রস্ত শিল্পীদের গরুর হাটে চাকরি দেওয়ার কথা বলেছিলেন! গরু-ছাগলে লাভ তো ভালোই, সেরের উপর সোয়াসের।

মশিউর বরাবরই গরু কেনায় বাবাকে সাহায্য করে আসছে। এবারই প্রথম বিপত্তি ঘটল। ছেলেটি কিশোর থাকাকালীন মালেক সাহেবের চোখ ভালো ছিল। তাগড়া দেখে গরু কিনেছিলেন একবার। হাট থেকে বের হওয়ার পরপরই গরুটি এলোপাতাড়ি দৌড়াতে থাকে। পিছু ছোটে দুরন্ত মশিউর। লেজ ধরে টানে। তবুও কি নিয়ন্ত্রণে আসে! উল্টো গরুটি রেগে লেজ দিয়ে বাড়ি দেয়। ঝাড়ার তোয়াক্কার না করে মশিউর লেজ বেয়েই উঠে আসে গরুর পিঠে। তারপর শিং ধরে নিয়ন্ত্রণে আনে অবাধ্যকে! ছেলের প্রতিভায় যারপরনাই আনন্দিত হয়েছিলেন মালেক সাহেব। এবার কেন যে লাট সাহেব হওয়ার কুমন্ত্রণায় পড়লেন। লাট সাহেবের অহংকার মনে দানা না বাঁধলে হয়তো এত বড় বিপদে পড়তেন না।

গরুর দাম কখন বাড়ে আবার কখন কমে হদিস পাওয়া ভার। গতবার শেষ মুহূর্তে প্রায় দেড়গুণ দাম দিয়ে কিনতে হলো। এবার বুদ্ধি করে আগেই গরুটা কিনে ফেললেন। কোরবানির আরও সপ্তাহখানেক বাকি। হলোইবা ‘লাট’, হাড্ডিসার গরুর নাম-পদবি বলিউডের খান, না খাইয়ে তো রাখা যাবে না। বরং স্বাস্থ্য ফেরাতে এখন ভালো খাবারদাবার জরুরি। সাভারের ওইদিকটাতে কিছু গ্রাম এখনো আছে, যেখানে চাষাবাদ হয় পুরোদস্তুর। ছেলেকে পাঠালেন; তাজা ঘাস কিনে আনুক। খড়-খৈলের পাশাপাশি পুষ্টিকর খাদ্যসামগ্রীও দিতে হবে। একজন পুষ্টিবিদ বা পশু চিকিৎসককে পেলে ভালো হতো। পরামর্শমাফিক রেসিপি বানিয়ে দেওয়া যেত।

সাতসকালে ঘাস কিনতে বেরিয়েছিল মশিউর, ফিরল গভীর রাতে। অল্প কিছু ঘাস আনতে পেরেছে। ঘাস নাকি বিক্রি হচ্ছে গরুর মাংসের বাজার-চলতি দামে, ৮০০ টাকা কেজি! তিন কেজি ঘাস ২,৪০০ টাকায় কিনে মশিউরের সব টাকা ফুরিয়ে গেল। বাধ্য হয়ে হেঁটে এসেছে অনেকটা পথ। এবার দানাপানি পেটে দিতে হবে। আহারে, সারাদিনের অভুক্ত গরুটা। গিন্নিকে বলেছিলেন মালেক সাহেব, ভাতের মাড় গেলে দেওয়ার জন্য। এসব গরু খায়। কিন্তু অনভ্যস্ত হাতে সিঁড়ি দিয়ে মাড় নামাতে গিয়ে গিন্নি নিজের পায়েই ঢেলে দিলেন মাড়। তারপর ত্রাহি চিৎকার, চেঁচামেচি। সিঁড়ি মুছতেও বড় পেরেশানি গেল। ডাক্তার থেকে ধোয়া-মোছা সবই আবদুল মালেক একার হাতে সামলালেন। বড় ছেলে বরাবরই শ্বশুরবাড়িতে ঈদ করে। একেবারেই বউ ন্যাওটা। এবারও সে ওই বাড়ির জন্য কেনাকাটায় ব্যস্ত। যাওয়ার আগের প্রাক-প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই বাসার কোনো কাজে তাকে পাওয়া যায় না আর।

ব্যস্তসমস্ত মশিউর আগে দুটো খেয়ে নিল। তারপর আয়েশ করে বসল ঘাস কাটতে। ঘোড়ার ঘাস কাটা যতটা সহজ, গরুর ঘাস কাটা ততটাই কঠিন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘাস ভ্রমে আঙুল কেটে ফেলল মশিউর। তার সে কী আহাজারি! এমনিতেই রেগে ছিলেন, তাই ব্যথা-বিদীর্ণ হল্লাচিল্লায় কান দিলেন না আবদুল মালেক। হুঙ্কার দিয়ে বললেন, ‘ঘাস না কেটেই আঙুল কেটে ফেললি? তাহলে ঈদের দিনে গরু জবাইয়ের পর কী কাটবি!’
মশিউরের গলাও চড়ল এবার। বলল, ‘আব্বা, লাট গরু কিনছেন তবুও আপনের পাওয়ার কমে না কিল্লাই?’

কোনোভাবেই নতি স্বীকার করা চলবে না! তাই তিনি ছেলেকে ভর্ৎসনা করে বললেন, ‘ছাগল হইতে পারলি না রে বাপ, সবসময় গরুই থেকে গেলি!’

ছাগল-গরু পর্ব
স্বল্পায়তনের জীবনে সিনেমায় দেখেছে ইমরান, লাল পোশাক-পরা মানুষ দেখলে গরু ক্ষেপে যায়। সৌজন্য ভুলে ধাওয়া ধাওয়া করে! শিঙ দিয়ে গুঁতিয়ে, লাথি মেরে মদমত্ততার প্রকাশ ঘটায়। তাই বলে ছাগলকেও পাগল হতে হয় কেন! প্রতিবেশী ফেসবুকবাসী লোকজনের ছাগলামি শরবৃষ্টির মতো আঘাত করছে এখন, এই জ্বালা কি প্রাণে সয়!

আগে যেসব কাজের জন্য প্রশংসা জুটত, এখন আসছে নিন্দা। নিন্দাজনিত ট্রল গায়ে ফোস্কা ফেলে দিচ্ছে। বর্তমানে তেমন কেউই অন্যের সাফল্যে মাথা নোয়াচ্ছে না, উল্টো সুযোগ পেলে নাস্তানাবুদ করছে। ফেসবুকবাসী হয়ে যেন একলাফে একেকজন তালগাছ-বটগাছ হয়ে গেছে! সম্মানী মানুষের বিরুদ্ধে নিন্দাঝড় বইয়ে দিতে এতটুকুও বাধে না তাদের।

লাখ টাকার বাগান খায় পাঁচ সিকার ছাগল, অতীত দৈন্যদশার গল্প এসব। এখন লাখ টাকার ছাগল খেয়ে দিচ্ছে শত কোটি টাকার মান-সম্মান। ঘাস-লতাগুল্ম সাবাড় করতে করতে ছাগলটা শেষপর্যন্ত লুঙ্গিও চিবাতে শুরু করেছে! চিবাতে চিবাতে যদি হাঁটু বেয়ে আরও উপরে ওঠে, ইজ্জত বাঁচানোই মুশকিল হয়ে পড়বে।

বাবাকে বলে পনেরো কোটি টাকা দিয়ে দেশসেরা গরুটা কিনিয়ে নিয়েছিল ইমরান। গরুর নামটাও চমৎকার, বলদ খান। খান্দানি বংশের গরু-ছাগলগুলোর নাম দেওয়া হচ্ছে সেলিব্রেটি নায়কদের নামে। ইমরান জানে, বেশি টাকায় কোরবানির পশুর ক্রেতার সাক্ষাৎকার টেলিভিশন প্রচার করে, পত্রিকায় ছাপা হয় গরু ও ক্রেতার রঙিন ছবিসহ খবর। নিজের প্রচার দেখার সাধ কার না থাকে!

ভাই-হন্তা ভাইরালের যুগে লোকজন এসবই বেশি খায়। গরুটি কেনার পর ভালোই প্রচার পেল ইমরান। টেলিভিশন পর্দায় কিছুক্ষণ তার ছবি, এরপর গরুর ছবি, আবার তার ছবি প্রদর্শন করা হলো। আড়াল থেকে ভেসে আসা খবর-কণ্ঠে গরুর বংশ বর্ণনার পাশাপাশি রূপ ও তাকদের প্রশংসাও করা হলো। সেই সঙ্গে ইমরানের সুরুচি ও উদ্যমের। আরও প্রচারের নেশা পেয়ে বসল ইমরানকে। উচ্চবংশীয় একটি ছাগল অনলাইন হাটে তুলেছে ভাইরাল কোম্পানি। ফেসবুকে খবরটা পড়েই পড়িমরি করে ছুটল ইমরান। ছাগলটা উচ্চতায় মানুষকেও ছাড়িয়ে যায়। পনেরো লাখ কেন, পনেরো কোটি টাকাও হাতের ময়লা এখন; অন্তত ইমরানের। ওর বাবা বড় একটি চাকরি করেন। পাশাপাশি ব্যবসা করেন। মাও যথেষ্ট প্রতিপত্তিশালী নারী। তৎক্ষণাৎ ছাগলটা কিনেই সে ফেসবুক লাইভে এল। খান্দানি বংশের ছাগলের মালিক হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। সে নিজেও উচ্চবংশীয়। বাবা-মা দুজনেই ভালো বংশে বিয়ে করেছেন!

লাইভে ছাগলের পশ্চাদ্দেশে মৃদু চাপড় মারলে ইমরান। এ কী, ছাগল ‘চ্যা’ বলল কেন? ‘ম্যা’ ভুলে গেছে নাকি! সম্ভ্রান্ত, মেধাবী বংশীয় ছাগল, ভাষা ব্যবহারেও ব্যতিক্রমী হওয়াই স্বাভাবিক। এটা হয়তো ছাগল মিডিয়ামে পড়াশোনা করেছে। ছাগল কেনার অনুভূতি জানিয়ে কয়েকটি ইউটিউব চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিল ইমরান। হাসিমুখে ছাগলকে চুমু দেওয়ার ছবিও আপলোড করল ফেসবুকে। ঘড়ির কাঁটায় ঘণ্টার ঘণ্টা বাজার আগেই ভাইরালের দুনিয়ায় শীর্ষাসনে পৌঁছাল সে। আনন্দে ম্যা-ম্যা করতে করতে ভাবল, আগামী বছর বিদেশ থেকে উট-দুম্বা আমদানি করবে। প্রচার মিলবে আরও বেশি। লাখো মানুষ তার উট-দুম্বার সঙ্গে সেলফি তুলতে আসবে।

হঠাৎ কেন পাশা উল্টে গেল, ছাগলটা ‘চ্যা’র পরিবর্তে ‘এ্যা-এ্যা’ স্বরে ডাক ধরল বুঝতে পারল না ইমরান। তাকে প্রশংসায় ভাসানো লোকজনই বলাবলি শুরু করল, চ্যাংড়া পোলাডায় এত দামি টাকার ছাগল কীভাবে কিনল; টাকার উৎস কী? বাবা ঘুষের চাকরি করেন কিনা, প্রশ্নও ধেয়ে এল চারদিক থেকে। উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা বাবাও বুঝতে পারেননি ছেলের কাণ্ড তাকে এভাবে ন্যাংটো করে ফেলবে প্রকাশ্যে। যত দোষ ওই ফেসবুকের।

আপন বাবার পরামর্শে ইমরান ছাগলটা লুকিয়ে ফেলল। ক্রয়-চিহ্ন রাখল না কোথাও। ঘাপটি মারল নিজেও। ছাগলটাকে আর লুকানো গেল না। বেড়াল ও ছাগল নিয়ে আত্মগোপনে যাওয়া কঠিন। যতই বুদ্ধি থাকুক, এরা ভ্যা ভ্যা ম্যা ম্যা করবেই। শুরু থেকে ছাগলটাকে ইমরান নিজের বেডরুমে রেখেছে। এটা তো যেনতেন ছাগল নয় যে খোঁয়াড়ে রাখবে। এখন এতটাই স্বাধীনতা পেয়ে গেছে, সারা বাড়ি দাপিয়ে বেড়ায় ছাগলটা। ইতোমধ্যে নোট-ডলার থেকে শুরু সম্পদ-সম্পত্তির দলিলপত্রও খেতে শুরু করেছে। লোকে কি আর সাধে বলে, ছাগলে কী না খায়! কোন ফাঁকে যে ঘরে ঢুকে পড়েছে সাংবাদিক! এরা ক্ষণে ক্ষণে ছাগলের গতিবিধি জানাচ্ছে দেশবাসীকে। আলীশান বাড়ির সোফায় বসে, সোনার খাটে শুয়ে ছাগলটাও বিভিন্ন পোজের ছবির মডেল হচ্ছে। ছবিগুলো লহমায় আবার ছড়িয়ে যাচ্ছে ইন্টারনেট দুনিয়ায়।

এদিকে সংবাদও হতে থাকে সমানতালে। একটি অর্ধ জাতীয় দৈনিক শিরোনাম করল, ‘অবশেষে আলোচিত সেই ছাগল ঘুমাচ্ছে সোনার খাটে!’ উপশিরোনামে বলা হচ্ছে, ‘কত হাজার-কোটি টাকার সম্পদের মালিক মফিজুর রহমান?’

সমুদ্রচুরি ও দেশভক্ষণের আমলনামা আড়াল করতেই ইমরানুর রহমানের বাবা মফিজুর রহমান প্রচারমাধ্যমে মিথ্যাটা বলেই ফেললেন, ‘ইমরান কে? চিনি না। এটা যে মানুষের নাম হতে পারে, আমার জানা ছিল না!’

ভালোভাবে ঘাস কাটা না শিখলে যে জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে পস্তাতে হবে, এমন হিতোপদেশ দিয়েই যাচ্ছেন!

বিভিন্ন কাগজে ও চ্যানেলে ইমরানের নায়কোচিত ছবি প্রচারিত হচ্ছে, এমন সময়েই কিনা বাবা তাকে অস্বীকার করে বসলেন! এটা ওর জন্য বিরাট বিষাদে হরিষ! অভিমানী ইমরান বাবাকে বলল, ‘আব্বা, এটা কী বললেন, আমি আপনার পুত্র নই? তাহলে কে আমার বাবা! তাহলে এখন থেকে আমি কি অন্য কাউকে বাবা ডাকব!’

মফিজুর রহমান ঝাড়ি দিয়ে বললেন, ‘চুপ থাক ছাগলের বাচ্চা! আমার সহায়-সম্পদের পাহাড় বাঁচাই আগে। ধনসম্পদ রক্ষা করতে পারলে তুই কাঁড়ি কাঁড়ি বাবা পাবি, আমিও গণ্ডায় গণ্ডায় পুত্র-কন্যাসন্তান পাব।’

উষ্মা প্রকাশ করে ইমরান বলল, ‘আবার কন্যাসন্তান চান কেন! তারা তো আপনার বিচার চায়!’
‘ওরে মূর্খ বলদের বংশধর, এটা তো আমি কথার কথা বলেছি! আর বাচ্চা নিতে হলে তো আরও বিয়ে করতে হবে। সেটা কি এই বয়সে আমি আর পারব?’
রাগান্বিত বাবাকে সান্ত¦না দিয়ে ইমরান বলল, ‘পারবেন আব্বা। কীইবা এমন বয়স হয়েছে আপনার? এখনো রঙিন পাঞ্জাবিতে আপনাকে ইয়ং দেখায়।’

ইমরান জানে, শেষপর্যন্ত ক্ষমতাধর আব্বার কিছুই হবে না। অর্থ-প্রতিপ্রত্তির চেয়ে ক্ষমতাধর আব্বা আর কী আছে! যে কারণে ধেড়ে ইঁদুর ও কালো বিড়াল শিকার সংস্থা (ধেইঁকাবিশিস) আব্বাকে বারবার ডেকেও সম্মানের সঙ্গে দায়মুক্তি সনদ দিয়েছে। এবারও নিশ্চয়ই অন্যথা হবে না। হয়তো একটু বেশি টাকা খসাবে তারা।

কাণ্ড শাখা-প্রশাখা মেলে। ছাগলকাণ্ডের মধ্যেই আরেকটি রাষ্ট্রীয় সংস্থা তাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে উচ্চবাচ্য না করার হুমকি দিয়ে বসল প্রচারমাধ্যমকে। বাবার উপরেও তো বাবা থাকে, নাকি! যে বাবারা প্রকাশ্যে ও আড়াল থেকে দেশের নানারকম কলকাঠি নাড়ে। নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা রাখে।

গুপ্ত স্থানে শুয়ে-বসে থেকে দিন কাটে না ইমরানের। অফুরন্ত অবসর এখন তার। দিন কাটে না, রাত যায় না। ছাগলটাকেও কাছে পায় না। সময় কাটাতে এখন সে হিন্দি সিনেমা দেখে, উর্দু গান শোনে। আর স্বপ্ন দেখে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে গড়ে তুলবে উন্নত প্রজাতির ছাগলের খামার। হয়ে উঠবে উদ্যোক্তাদের ছাগল-রাজা। খামারে বসে নিয়মিত সেলফি আপলোড দেবে। আর যারাই বাবাকে নিয়ে প্রশ্ন তুলবে, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকবে, সবার কাছে নজরানা হিসেবে পাঠিয়ে দেবে নিজ খামারে উৎপাদিত স্মার্ট ছাগল। তেল নুন মশলাসহ। নুন খেলে গুণ না গেয়ে উপায় কী থাকবে তাদের!

এর মধ্যেই একদিন বাবা তার কাছে প্রস্তাব আনেন, ‘তুই বিদেশে গিয়ে বেড়িয়ে আয়, কিছুদিন। আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হোক, তখন এসে ছাগল জবাই করে মাংস খাস! গরুগুলোও ততদিনে আরও মোটা-তাজা হয়ে যাবে।’

হতভম্ব ইমরান সংবিত ফিরে পেলে বলে, ‘আপনি আমাকে পালিয়ে যেতে বলছেন, আব্বা! তাহলে আমার গরু-ছাগলগুলোকে কে দেখে রাখবে?’
‘তোর জেঠা আবদুল মালেককে খবর দেব। আমরা না ফেরা পর্যন্ত তিনি ওই বাড়িতেই থাকবেন। তোর তো সব চারপেয়ে; আমারও তো দু’পেয়ে অনেক গরু-ছাগল আছে। ওদের রেখে আমিও আপাতত অন্য কোনো দেশে চলে যাব। বিদেশ পলায়ন নয়, এটা বিদেশ ভ্রমণ। রিক্রিয়েশন ট্যুর। ওখান থেকেই সব নিয়ন্ত্রণ করব। পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হলে ফিরব কিছুদিন পরে। কয়েকগুণ বেশি শক্তিতে কাজ শুরু করতে পারব তখন!’

কথা শেষ করে মফিজুর রহমান বড় ভাই আবদুল মালেককে কল করেন। মালেক সাহেব তখন তার ছোট ছেলে মশিউরকে বকাবাদ্য করছেন। ভালোভাবে ঘাস কাটা না শিখলে যে জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে পস্তাতে হবে, এমন হিতোপদেশ দিয়েই যাচ্ছেন!