চাঁদে চিংড়ির ঘের


মকবুল স্যার ক্লাসে এলেন। এসে পুরো ক্লাসে চোখ বুলালেন। বললেন, তোরা সবাই আছিস তো?
মিন্টু বললো, জি স্যার, আমরা সবাই আছি।
মকবুল স্যার বললেন, আজ তোদের সায়েন্স পড়াব না। আজ তোদের সাথে বিশেষ একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করব। তোদের কার ভবিষ্যত চিন্তা-ভাবনা কেমন তা দেখব।
ফখরুল বলল, স্যার, এটা একটা কাজের কথা বলেছেন। সবকিছুতে আলোচনা বিষয়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আলোচনা ছাড়া কোনো সিদ্ধান্তে যাওয়া ঠিক না। আমাদের রাজনীতিকরা সবকিছু নিয়ে সব সময় আলোচনা করেন। আলোচনা করতে গিয়ে অনেক সময় ও অর্থ ব্যয় করেন। তবে তাদের আলোচনার ফলটা বেশির ভাগ সময় ভাল হয় না। আলোচনা করতে গিয়ে তারা…
-তুই চলে গেলি রাজনীতিতে। আমি বলতে চাচ্ছি অন্য বিষয়।
-আচ্ছা বলেন স্যার।
-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি তো বুলেট ট্রেনের গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। তোরা বড় হয়ে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে করতে মানুষ হয়ত অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহে বসবাস শুরু করে দেবে। তখন তোদের হয়ত এই পৃথিবীতে আর মন বসবে না।

বল্টু বললো, স্যার, এই পৃথিবীর প্রতি মন বিষিয়ে উঠেছে। যত তাড়াতাড়ি চাঁদে, মঙ্গলে গিয়ে বসবাস করতে পারি ততই ভাল। বিশেষ করে আমাদের দেশে বসবাস করার চেয়ে না করাই ভাল। এই দেশে মানুষ আর মানুষ নাই। ঘুষ, দুর্নীতি, লুটপাট, খুন, চুরি-ছিনতাই ছাড়া এখানে আছে কী? আমাদের এই শহর নাকি পৃথিবীর অন্যতম বসবাস অযোগ্য শহর। বাতাস, মাটি, পানি, খাদ্য সবই দূষিত-বিষাক্ত। যত তাড়াতাড়ি চাঁদে গিয়ে বাস করতে পারি ততই ভাল।
-সে কথাই বলছিলাম। ধর, তুই চাঁদে গিয়ে বসবাস শুরু করে দিলি। তো তুই কী ধরনের ব্যবসা বা কাজ করবি?
-আমি স্যার? বললো বল্টু।
-হ্যাঁ তুই।
-আমি সেখানে চিংড়ির ঘের করব। ঘেরে লোনা পানি নিয়ে আসব। গলদা চিংড়ি, বাগদা চিংড়ির ঘের করব। সাথে থাকবে রুই, মৃগেল, তেলাপিয়া। সেসব মাছ আমি পৃথিবীতে রপ্তানি করব। লোনা পানি, লোনা মাটির কারণে জমিতে অন্য কোনো ফসল ফলবে না। শুধু ঘের আর ঘের।
-তুই চাঁদের মাটি দূষিত করার সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে আছিস। তোর কথায় খুশি হতে পারলাম না। এই গাব্বু, তুই যদি চাঁদে যাস তো কী করবি?
গাব্বু দাঁড়ালো। গলা কেশে বলল-স্যার, আমি জেল-এর কারখানা চালু করব।
-জেল-এর কারখানা? মানে কী?
-স্যার, আপনি তো জানেন এ দেশ থেকে চিংড়ি রপ্তানি করার সময় চিংড়ির পেটের ভেতর জেল ভরে দেয়। জেল ভরার কারণে এক কেজি চিংড়ির ওজন হয় তিন কেজি। বল্টু তো আর সাধু-সন্যাসি না। ও জেল ভরবেই ভরবে। তো জেল কোথায় পাবে? আমার কাছ থেকে কিনবে।
-কি আশ্চার্য! তোরা তো চাঁদের গিয়ে লোকজনকে শান্তিতে থাকতে দিবি না দেখছি। চাঁদকে তোরা একটা বাংলাদেশ বানিয়ে ছাড়বি। আচ্ছা, কেউ কি আছোস যে খুব সুন্দর কোনো মিশন নিয়ে চাঁদে যাবি?

এ তো দেখছি জাতে মাতাল তালে ঠিক। শোন, তোদের কারোই চাঁদে যেতে হবে না। তোরা পৃথিবীতেই থাক, চাঁদকে আর নষ্ট করার দরকার নেই। আমি চললাম।

ফজলু হাত তুললো। মকবুল স্যার বললেন, তুই চাঁদে গিয়ে করতে চাস?
-স্যার, আমি ফলের বাগান করতে চাই। আম, জাম, লিচু, কলা, কাঁঠাল, জামরুল, জলপাই, আতা আরও অনেক রকম ফলের বাগান করতে চাই।
-গুড। তোর কথা শুনে প্রাণটা জুড়িয়ে গেল। তোর ফলের খাবার শুধু সুস্বাদু, পুষ্টিকর ফলই যোগান দিবে না, বৃক্ষগুলো দিবে অক্সিজেন, সুশীতল বাতাস। ইচ্ছে হচ্ছে তোকে বুকে জড়িয়ে ধরি। এই গুল্লু, তুই তো চিরকালের ত্যাঁদর। চাঁদে যেতে পারলে ভাল কিছু করবি, নাকি ত্যাঁদরামিই করবি?
-স্যার, আমি ফরমালিন ও ফলে ব্যবহার করার জন্য কেমিকেল-এর কারাখানা চালু করব।
-কেন, এসব তো ভাল না।
-ফজলু আমার প্রিয় বন্ধু। ওর জন্য আমার ফরমালিন-এর কারখানা খুলতে হবেই। ও তো আর সতেজ, তরতাজা ফল পৃথিবীতে রপ্তানি করবে না। ফরমালিন দিবেই দিবে। জিজ্ঞেস করুন ওকে। তো ও ফরমালিন কোথায় পাবে?
মকবুল স্যার হতাশ কন্ঠে বললেন-তোদের ভবিষ্যত আমার আর শোনার ইচ্ছা নাই। আমাদের এই পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহটাকে তোরা সুস্থ থাকতে দিবি না। তোরা হবি চাঁদের মারাত্মক কলঙ্ক। তা সান্টু তোর বক্তব্য বলতো একটু শুনি।
-স্যার, আমি চাঁদে গিয়ে কোচিং সেন্টার খুলব।
-কোচিং সেন্টার! জানিস কোচিং ব্যবসার কারণেই আজ আমাদের শিক্ষার এই বেহাল দশা।
-জানি স্যার। এই যে আপনি ক্লাশে চাঁদে বসবাস নিয়ে আলোচনা করছেন, আর পড়াবেন আপনার কোচিং সেন্টারে। আমিও চাঁদে গিয়ে ক্লাশে ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে মঙ্গল, বৃহস্পতি, ইউরেনাস, নেপচুনে বসবাস-এর পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করব, আর পড়াব কোচিং সেন্টারে।

পেছনে ঘরররর ঘরররর শব্দ। মকবুল স্যার বললেন, এই পেছনে নাক ডাকে কার? কে ঘুমাচ্ছে? কিসলু বললো, স্যার সগির।
-ওরে ধাক্কা দে।
কিসলু প্রচণ্ড এক ধাক্কা দিয়ে সগিরকে জাগিয়ে দিলো।
মকবুল স্যারের মেজাজ ফোরটি নাইন হয়ে গেলো। মেজাজ ফিফটি হলেই তিনি স্ট্রক করে যাবেন। তো দাঁত খিঁচিয়ে বললেন, তুই সব সময় ক্লাসে ঘুমাস। এখানে গুরুত্বপূর্ণ একটা আলোচনা হচ্ছে আর তুই…
সগির হাই তুলে বললো, আলোচনা জানি স্যার। আমি সব ফাইনাল করে ফেলেছি।
-কী ফাইনাল করেছিস?
-আমি চাঁদে হাউজিং ব্যবসা চালু করব। সব জমি কিনে ফেলব। নো চিংড়ির ঘের, নো ফ্রুট ফার্ম, নো কোচিং সেন্টার, নো ফরমালিক কারখানা। বিশাল বিশাল বিলাশবহুল সব অ্যাপার্টমেন্ট বানাব। উচ্চমূল্যে বিক্রি করব। ডলার আর ডলার।
-ওরে বাবা! এ তো দেখছি জাতে মাতাল তালে ঠিক। শোন, তোদের কারোই চাঁদে যেতে হবে না। তোরা পৃথিবীতেই থাক, চাঁদকে আর নষ্ট করার দরকার নেই। আমি চললাম।
সগির বলল-স্যার, কোথায় যাচ্ছেন, চাঁদে?
মকবুল স্যার ফিরে তাকালেন না।