এবার বই মেলায় ওহিদুল আব্বাসের একটি বই বেরুবে, নাম ‘নীল সমুদ্রের ঢেউয়ে এক গুচ্ছ সবুজ কচুরীপানা’ এটি একটি গল্পগ্রন্থ, বারোটা গল্পের একটা সংকলন। প্রকাশক আগ্রহ করেই নিয়েছেন। বলেছেন গল্পগুলো অসাধারণ, শেষ গল্পটা পড়ে নাকি তিনি চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। তবে তিনি, মানে প্রকাশক একটা শর্ত জুড়ে দিয়েছেন। বইয়ের প্রচ্ছদ তাকেই জোগাড় করে আনতে হবে। এবং অতি অবশ্যই ভালো প্রচ্ছদ হতে হবে। তার প্রকাশনী প্রচ্ছদের ব্যাপারে সিরিয়াস। ভালো প্রচ্ছদ না হলে তিনি বই প্রকাশ করেন না।
– তাহলে কাকে দিয়ে প্রচ্ছদ করাতে বলছেন? মানে কার কাছে যাব?
– কেন ধ্রুব এষ, দেশের সেরা প্রচ্ছদ শিল্পী সবাই জানে।
– ইয়ে কিন্তু উনাকে তো আমি চিনি না। মানে পরিচয় নেই।
– গেলেই পরিচয় হবে। গিয়ে বলবেন আপনি নতুন লেখক একটা প্রচ্ছদ করে দিলে আপনার বই চলবে…উনি লোক ভালো।
– আচ্ছা উনি কোথায় থাকেন?
– ঠিকানা আমি দিচ্ছি। ভালো কথা যাওয়ার সময় একটা ফুলের তোড়া নিয়ে যাবেন। উনি এবার বাংলা একাডেমি পদক পেয়েছেন। শুভেচ্ছা জানানো আরকি এক ঢিলে দুই পাখি। হে হে (গলা নামিয়ে) তবে আমার কথা আমার প্রকাশনার কথা আবার বলবেন না, যেন তাহলে প্রচ্ছদ নাও দিতে পারে।
– কেন?
– আরে ভাই এ লাইনে দুষ্ট লোকের অভাব নেই। আমার নামে কত রকমের কথা ছড়িয়েছে। আমি নাকি প্রচ্ছদ শিল্পীদের টাকা দেই না। হ্যান ত্যান…তবে ভয় নেই যেদিন আপনি প্রচ্ছদ নিয়ে আসবেন সে দিনই উনার সন্মানী পৌঁছে যাবে বিকাশে। আর পরদিনই আপনার বই প্রেসে উঠে যাবে…যান তাহলে।
সাড়ে তিনশ টাকা নিয়ে একটা ফুলের তোড়া কিনে শিল্পী ধ্রুব এষের বাসায় গিয়ে দেখে তিনি বাসায় নেই। তার দরজায় বিশাল একটা চায়নিজ তালা ঝুলছে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন তিনি বেড়াতে গেছেন কক্সবাজার। এখন উপায়? ওহিদুল আব্বাস ফোন দিলেন প্রকাশককে।
– ভাই ধ্রুব এষ দাদা তো বাসায় নেই। বেড়াতে গেছেন কক্সবাজার।
– এহ হে…তাহলে তো কাজটা ঝুলে গেলো।
– অন্য কোনো শিল্পীর কাছে যাব?
– উমমম কার কাছে যাওয়া যায়? তুলির কাছে যান উনিও ভালো প্রচ্ছদ করেন।
– এই আপার বাসা কোথায়?
– আরে মর জ্বালা উনি আপা হতে যাবেন কেন? উনি নিয়াজ মোরশেদ তুলি। আর্ট কলেজ থেকে পাস করা বিখ্যাত শিল্পী। উনাকে প্রথম আলোতে পাবেন সম্ভবত।
– উনাকে যদি না পাই?
– তাহলে যাবেন মুস্তাফিজ কারিগরের কাছে…ইনিও দারুণ প্রচ্ছদ করেন। উনাকে বাংলা বাজারে পাবেন।
– তাকেও যদি না পাই?
– আরে কী জ্বালা, কাউকেই পাবেন না মানে? একজন না একজনকে পেতেই হবে। তারপরও বলি তাকেও যদি না পান তাহলে শেষ চেষ্টা হিসেবে যাবেন মামুন হোসেইনের কাছে। এই শিল্পী বলপয়েন্টে টান-টোন দিয়ে এমন সব প্রচ্ছদ করে মাথা নষ্ট।
ওহিদুল আব্বাস মিন মিন করে বললো, কিছু মনে করবেন না যদি তাকেও মিস করি!
-তাহলে…তাহলে এসে আপনার পাণ্ডুলিপি ফেরৎ নিয়ে যাবেন। বলে ওপাশে খট করে এনালগ ফোনের রিসিভার রাখার শব্দ হলো।
এই বইটারই প্রকাশনা উৎসব হচ্ছে। কবিতার বই। বইয়ের নাম ‘কচুরীপানার কষ্ট’।
তরুণ লেখক ওহিদুল আব্বাস ফুলের তোড়া নিয়ে রওনা হলেন তুলির খোঁজে। তাকে পাওয়া গেলো না। মুস্তাফিজ কারিগরও ঢাকায় নেই। শেষ ভরসা মামুন হোসাইন। তার ‘টানটোন’ স্টুডিও খোলা পাওয়া গেলো, কিন্তু তিনি নেই। তবে আশার কথা তিনি শিগগিরই আসবেন। ওহিদুল আব্বাস বসলেন। এক তরুণ চা খেতে দিলো। বললো,
– মামুন ভাইয়ের কাছে কেন এসেছেন?
– একটা প্রচ্ছদের ব্যাপারে।
– আগে কথা হয়েছে?
– জি না।
– তাহলে তো হবে না মামুন ভাই খুবই ব্যস্ত। সময় বের করতে পারবেন না।
– একটু কথা বলে দেখতাম।
– আপনার বইয়ের নাম কী?
– নীল সমুদ্রের ঢেউয়ে এক গুচ্ছ সবুজ কচুরীপানা।
– ওরে বাপরে এত বড় নাম! মামুন ভাই করবে না।
– কেন?
– উনি আসলে টাইপোগ্রাফির ওপর জোর দিয়ে কভার করে থাকেন তো। এত বড় নাম হলে তো অনেক সময় লাগবে। এত সময় মামুন ভাইয়ের নেই। নাম ছোট করে আনেন। তারপর দেখি উনার সাথে কথা বলে…
ঘণ্টা দুয়েক বসেও মামুন ভাইকে পাওয়া গেলো না। বিষণ্ন বদনে ওহিদুল আব্বাস বের হয়ে এলেন টানটোন স্টুডিও থেকে, ঐ তরুণ স্টুডিও বন্ধ করে এখন লাঞ্চে যাবে। এই সময় প্রকাশকের ফোন।
– কী কোন খবর আছে?
– কাউকেই তো পেলাম না।
– কাউকেই পান নাই?
– জি না
– তাহলে আর কি, এসে আপনার পাণ্ডুলিপিটা নিয়ে যান। আমি এখন প্রেসে অন্য বই উঠিয়ে দেবো। আপনার আশায় বসে থাকলে তো চলবে না। আমি না থাকলেও ম্যানেজারের কাছে আপনার পাণ্ডুলিপি থাকবে, নিয়ে যাবেন। আচ্ছা রাখি।
তরুণ লেখক ওহিদুল আব্বাস হাঁটতে হাঁটতে বই মেলায় চলে এলো। হাতে তখনো ফুলের তোড়াটা। এটা টান-টোনে রেখে আসলে হতো। আর কত বয়ে নিয়ে বেড়ানো যায়।
মেলার এক প্রান্তে এক তরুণীর সদ্য প্রকাশিত বইয়ের প্রকাশনা উৎসব হচ্ছে। বেশ জাকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান। তরুণী মনে হচ্ছে কেউকেটা কেউ… সেলিব্রেটিও হতে পারে। সবাই ফুলের তোড়া তার হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে। আমাদের লেখক ওহিদুল আব্বাস ভাবলেন ফুলের তোড়াটা থেকে উদ্ধার পাওয়ার এই সুযোগ। সেও মঞ্চে উঠে ফুলের তোড়াটা তরুণীর হাতে দিলো। তরুণীর হাসিটা সুন্দর। মঞ্চ থেকে নামার সময় কে একজন তার হাতে একটা বই ধরিয়ে দিলো। এই বইটারই প্রকাশনা উৎসব হচ্ছে। কবিতার বই। বইয়ের নাম ‘কচুরীপানার কষ্ট’।