মামুন রশীদের প্রবন্ধ: কবি ও কবিতার দর্পণ


মামুন রশীদ—কবি ও প্রাবন্ধিক। শিল্প সাহিত্যে তার আগ্রহ ‘কবি ও কবিতা’কেন্দ্রিক। পাশাপাশি সাহিত্যের ইতিহাস ও সমসাময়িক বিষয়ভিত্তিক কিছু পর্যালোচনাও তার লেখায় উঠে আসে। বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য ও প্রতিশ্রুতিশীল কবি ও কবির কবিতার উপমা, উৎপ্রেক্ষা ও তার শব্দব্যঞ্জনা থেকে যুক্তিগুলো সমবণ্টন করে কবি ও শিল্পীর সত্তার পরিচয় দিতে তিনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।

পার্থিব জগতের সবকিছুই সাহিত্যের অংশ হতে পারে। সাহিত্যে তা যথাযথ ব্যবহার করতে পারার যোগ্যতাই তার পূর্বশর্ত। কবি মামুন রশীদ এই প্রবণতা ও শিল্পচিন্তার বাইরের কেউ নন। আজ কবির শুভ জন্মদিন। শুভ জন্মদিনে কবির ‘সাম্প্রতিক বাংলা কবিতা স্বতন্ত্র স্বর’ তিনটি গদ্যে (প্রত্যেকের) নিজস্ব কিছু অভিমত ও আলোচনায় (সাহিত্য ও কবিতা বিষয়ক আলোচনায়) তাঁর নতুনত্ব সম্পর্কে আমার কিছু অবহিতি আপনাদের উদ্দেশ্যে সংযোজন করা হলো।

অবহিতি-১:
মাইকেল পরবর্তী তিরিশের দিকে, বাংলা সাহিত্যে (ইউরো প্রভাবিত) কবিতার নিরীক্ষা বা এক্সপেরিমেন্টের একটা কেতাদুরস্ত-জাগরণশুরু হয়েছিল। এতে যতটা না কবিতা হয়েছে; তারচে’ কবিতা জটিলতার দিকেও বাঁক নিয়েছে। ‘সাম্প্রতিক বাংলা কবিতা স্বতন্ত্রস্বর’ গদ্যে লেখক মামুন রশীদ বলছেন—‘বাংলা কবিতা থেকে নিজস্বতা হারিয়ে যাওয়ার একটা আশঙ্কার কথা একসময় বেশজোরেসোরেই উচ্চারিত হয়েছিল। বাংলা কবিতাকে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে দাঁড় করানোর অজুহাত তুলে স্বেচ্ছাকৃত জটিলতা তৈরিরপ্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন কেউকেউ।

উল্লেখিত গদ্যে বাংলা কবিতায় প্রতিনিধিত্বকারী কিছু কবি প্রতিভাকেতিনি সামনে এনেছেন। তারা হলেন—কাজী নাসির মামুন, চন্দন চৌধুরী, মোহাম্মদ নূরুল হক, ইমতিয়াজ মাহমুদ, রবু শেঠ, মিজান মল্লিক, জাকির জাফরান, জাহানারা পারভীন, ফেরদৌস মাহমুদ প্রমুখ।

বিভিন্ন ইজমের ধুয়া তুলে পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে বাংলা কবিতাকে পাঠক বিমুখ করে তুলতেই যেন সচেষ্ট ছিলেন সেইসব কবি। তারা সৃষ্টির পরিবর্তে নির্মাণের খেলায় মেতেছিলেন। যেন বাংলা কবিতা থেকে বাংলারইতিহাস, ঐতিহ্যশেকড়, রূপ, রস, গন্ধ হারিয়ে যেতে বসেছিল। সেই স্রোতে হারিয়ে যাওয়া বা গা ভাসিয়ে দেওয়ার বিপীরতে কেউ-কেউ, শেকড় সন্ধানীরা উদ্দেশ্যহীনতার পথে বাংলা কবিতাকে হারিয়ে যেতে না দিয়ে, লাগাম টেনে ধরেছিলেন। তারা আমাদের ইতিহাস, ঐহিত্যের ভেতর দিয়েইবাংলা কবিতাকে বৈশ্বিক করে তোলার জন্য সচেষ্ট থেকেছেন।’ উল্লেখিত গদ্যে বাংলা কবিতায় প্রতিনিধিত্বকারী কিছু কবি প্রতিভাকেতিনি সামনে এনেছেন। তারা হলেন—কাজী নাসির মামুন, চন্দন চৌধুরী, মোহাম্মদ নূরুল হক, ইমতিয়াজ মাহমুদ, রবু শেঠ, মিজান মল্লিক, জাকির জাফরান, জাহানারা পারভীন, ফেরদৌস মাহমুদ প্রমুখ।

অবহিতি-২:
মাইকেল মধুসূদন। বাংলা সাহিত্যের মননশীল ঘরানার শক্তিমান শিল্পসত্তা। যিনি ইউরোপীয় রেনেসাঁসের মধ্য দিয়ে মানবতাকে বড় করে দেখেছিলেন। সেইসঙ্গে মধ্যযুগের বর পাওয়া দেব-দেবীর অনুকম্পা-নির্ভর সাহিত্যের দৈন্যকে আঘাত করে বাংলা সাহিত্যে আধুনিকযুগের সূচনা করেছেন। মামুন রশীদ, অগ্রজ কবির মধ্যে মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা ও তার তাৎপর্যের উল্লেখযোগ্য দিকটি সামনে নিয়ে এসেছেন। তিনি বলছেন—‘‘দত্তের রচিত ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ প্রকাশিত হয় ১৮৬১ সালে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মবর্ষে। প্রকাশের পর এই মহাকাব্যটি ইতোমধ্যে পেরিয়ে এসেছে সার্ধশত বর্ষ। দেড়শ বছরের ইতিহাসে এখনো পর্যন্ত মহাকাব্যটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল হয়ে আছে […] বাংলা সাহিত্যে—আধুনিক যুগে প্রবেশের আগে মূলত দেবদেবীর জয়গান নির্ভর ছিল। বিশেষত পুরো মধ্যযুগের সাহিত্য ছিল দেবদেবী নির্ভর। এ ধারা থেকে আধুনিকতার শুরুতে যখন মানুষের জীবনতার সুখ-দুঃখকে সাহিত্যের বিষয় করা হচ্ছে তখন মাইকেল মধুসূদন দত্তের এই কাব্য নতুনত্ব নিয়ে আমাদের সাহিত্য ভুবনে। এই নতুনত্বসব দিক থেকেই। কারণ এটিই আমাদের প্রথম মহাকাব্য […] মাইকেল মধুসূদন দত্ত তার ‘মেঘনাদবধকাব্যে’ রাবণ চরিত্রের মধ্যে চিরকালীন পিতার যে ছবি এঁকেছেন, অন্য আর আর কারণের মধ্যে এই একটি কারণে আরও বহুকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।’’

অবহিতি-৩
শামসুর রাহমান ও শহীদ কাদরীকে নিয়েও লিখেছেন মামুন রশীদ। শামসুর রাহমান নিয়ে মামুন রশীদের আলোচনায় কবির প্রতিবিশেষ ভালোবাসা, আবেগ, স্মৃতিই মূলত স্পষ্ট হয়েছে। অন্যদিকে শহীদ কাদরী নিয়ে ‘শহীদ কাদরীর কবিতা: নগর জীবনের আর্তনাদ’ গদ্যে কাদরীর কবিতার বিশেষ কিছু দিক ও বিষয় আশয় (অনেকটা মার্ক বা কোটেশন সহকারে) অল্প কথায় তিনি তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন। লেখক বলছেন, ‘‘তাঁর কবিতায় উজ্জ্বল হয়ে আছে পাপ, অন্ধকার, সন্ত্রাস, শয়তান, মৃত্যু, মাতাল, লম্পট, জরা, কৃমি, ভিখেরী, বেশ্যা, দালাল, জুয়াড়ি, কীট, কবর এবং নপুংশকেরা। জীবনের ক্লেদাক্ত দিকগুলো অবলীলায় তুলে এনে কবিতাকে করেতুলেছেন নগরজীবনের আর্তনাদ। তাঁর তুলে ধরা শূন্যতা ও হাহাকার শিল্পের মাত্রা পেয়ে হয়ে ওঠে নাগরিক জীবনের প্রতিচ্ছবি। যেখানেস্পষ্ট হয়ে ওঠে জীবনের অকপট সত্য […] শহীদ কাদরীর কবিতার প্রধান বিষয় নগর। কিন্তু নগরকে শহীদ কাদরী কখনোই মফস্বল থেকে উঠে আসা কোনো লাজুক বালক অথবা কিশোরের মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখেননি। বরং তার দেখা নগরের বর্ণনায় উঠে এসেছে এর কদর্য দিকগুলোই। নিরাবেগ কিন্তু নিরুদ্বেগ নয় এক্ষেত্রে তাঁর দেখা। জীবনের অন্তর্গামী বিষয়গুলোকে তিনি নাগরিক পরিভাষার ভেতর দিয়েতুলে ধরেছেন। যেখানে ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা ছড়িয়ে থাকে পরতে পরতে। ফলে তার কবিতা পাঠের সময় মনে বিষণ্নতা ভর করে।’’

গদ্যের ভাষা ও ভাবে মামুন রশীদ সৃজন, মনন ও প্রতিশ্রুতিমাণ। যার ভাবনার ভূগোলে মূলত কবি ও কবিতাকেন্দ্র; কিন্তু বাহির-পরিসরেও তাঁর রয়েছে স্বচ্ছন্দ বিচরণ।

পঞ্চাশ ষাটের দিকে কনফেশনাল পয়েট্রি নামে আমেরিকার নতুন ধারার একটি কাব্যচর্চা সংঘঠিত হয়। বাংলা সাহিত্যে শহিদ কাদরী কনফেশনাল পয়েট্রির এই ধারার কবিতার নতুন একটা ভাঙচুর শুরু করেছিলেন। এছাড়া, বিশ্ব সাহিত্যের ইউরো-প্রভাবিত বাংলা ভাষা-কাঠামোর বড়ো একটা দৈন্যকে তিনি ঘুছিয়ে দিয়েছেন। অর্থাৎ ভাবনায় তিনি বাঙালি ঐতিহ্যের অনেক বিষয় আশয় কে বাংলার আধুনিক ভাবি-নাগরিক চেতনাকে সমৃদ্ধ করেছেন। শহীদ কাদরী নিয়ে মামুন রশীদের বক্তব্যেও (বিশেষ করে কবিতার) কিছু ব্যতিক্রমী প্রবণতা বিষয় খুব গুরুত্বের সঙ্গে উঠে এসেছে।

অবহিতি-৪
‘বাংলা কবিতায় দেশভাগের বেদনা’, ‘বাংলা সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ’, ‘এ সখি হামারি দুঃখের নাহি ওর’, ‘বাগিচার বুলবুল’সহ কিছু অনুসন্ধানিমূলক গদ্যে দেশভাগ, মুক্তিযুদ্ধ, বিদ্যাপতি,নজরুল নিয়ে (তার আলোচনার) কিছু উল্লেখযোগ্য বিষয় তিনি সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছেন। বিশেষ করে দুটি গদ্যে সামগ্রীক ভাবনায় ওঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ ও দেশভাগ বিষয়ে লেখা কবি ও কবিতাবিষয়ক কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশেষ করে ‘বাংলা কবিতায় দেশভাগের বেদনা’ গদ্যে একটি মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। তিনি বলছেন—‘বাংলা সাহিত্যে খুব অল্প সাহিত্যিকের লেখাতেই দেশভাগ প্রসঙ্গ এসেছে, তার বেদনা অনুভূত হয়েছে। কিন্তু দেশভাগকেই সাহিত্যের উপজীব্য করেতোলেননি কেউই।’

গদ্যের ভাষা ও ভাবে মামুন রশীদ সৃজন, মনন ও প্রতিশ্রুতিমাণ। যার ভাবনার ভূগোলে মূলত কবি ও কবিতাকেন্দ্র; কিন্তু বাহির-পরিসরেও তাঁর রয়েছে স্বচ্ছন্দ বিচরণ। ফলে কবি ও কবিতা বিষয়ক আলোচনায় তুলনামূলক আলাদা কোনো প্রশ্ন, উপলব্ধির জাগরণ না করলেও (স্পেসিফিক তথ্য দানে) নন্দন ও শিল্পমুখীনতায় মননশীল হয়ে ওঠেন। তার ভাষা সরল ও প্রবহমান। ভাষায় চলিত ও তৎসম শব্দের ব্যবহার ভাষা-কাঠামোকে সুন্দর ও ভাবগম্ভীর করে তোলে।