সাম্প্রতিক কবিতাও তার ব্যতিক্রম নয়। সব কবিরই চেষ্টা থাকে কবিতায় নিজের স্বাতন্ত্র্য ফুটিয়ে তোলার। কবিতায় নিজের উপস্থিতি জানান দিতে চান সব কবিই। আর এটা করতে গিয়ে কেউ কেউ নিজের ভেতরের জটিলতা, বৈপরীত্য, বোধকে প্রাধান্য দেন। আবার কেউ অন্তর্গত বেদনার সঙ্গে চেনা দৃশ্য, চেনা পরিবেশকে মিলিয়ে পাঠকের সামনে সহজ, সুন্দর একটি দৃশ্য নির্মাণ করেন। যেন সেই পরিচিত দৃশ্যাবলি অদ্ভুত স্বপ্নময় হয়ে ওঠে পাঠকের কাছে। পাঠক নিজেকে নতুন করে দেখতে পায় কবির দেখানো আয়নায়।
কাজী নাসির মামুন এই সময়ের সেই শ্রেণীর কবিদের একজন প্রতিনিধি। যে নিজেকে নিজের বোধকে বহুমাত্রিকতায় পাঠকের সামনে মেলে দিতে পারে। তার সচেতন মন, নির্মিত দৃশ্যাবলী পাঠকের মনকে স্বস্তি দেয়। চেনা জগতের জটিলতা নানান সংকেত, চিহ্ন এবং শব্দের সাঁকোতে মামুনের কবিতায় নতুন জগৎ তৈরি করে। আর কাজী নাসির মামুনের দেখা বস্তুও নিরপেক্ষ নয়। তাই পাঠককে নেশার ঘোরের মতো কবিতার ভেতের ঢুকে পড়তে সহায়তা করে। পাঠককে কবিতার ভেতর ডেকে আনতে মামুন কখনো আশ্রয় নেন ছন্দের, কখনোবা ছন্দহীন গতিময় গদ্যের। মামুনের সংবেদনশীলতা, অনুসন্ধিৎসা বাংলা কবিতার ধারাবাহিক উত্তরাধিকরাকে চিহ্নিত করে। এই বক্তব্যের সাক্ষ্য মিলবে তার ‘লবণপ্রার্থনার দিনলিপি’ কবিতায়:
বাগান সংগুপ্ত রেখে
তুমি কেন পাথর ভালোবাসো?
দেয়ালে শ্যাওলা জমে
কাঠামো গুঁড়িয়ে দিলে ধুলো জমে
প্রত্ন-প্রবেশিকায়
অতীত মোহিত করে তুমি কেন
পিছনে হাঁটো?
তাল গাছ নীরবে বাড়ে। ঝড়েও লুটিয়ে পড়ে না।
তোমাকে পাহাড় দিলাম। মৌনতায় উঠে আসো।পুলক ছড়িয়ে দিলে
সঙ্গে কিছু বিষাদের দায় থেকে যায়
ঢেউয়ে ঢেউয়ে জীবন মিলিয়ে দেখো
সমুদ্র কখনো লিখবে না লবণ প্রার্থনার দিনলিপি।
বিষাদ তাড়িত হলে তুমি কেন আকাঙ্ক্ষা মাড়াও?
অপূরণের দাবানলে
মানুষ কেবলি ছাই হতে চায়, সোনা নয়।
হৃদয়ে আকাশ গুঁজে রাখো
মেঘে মেঘে স্বপ্ন খুঁজে পাবে।
মৃত্যুকে প্রেমের জন্য উপাত্ত ভেবো না
তোমাকে শোনাবো লুপ্ত পাথরের গান।
(লবণ প্রার্থনার দিনলিপি: কাজী নাসির মামুন)
কাজী নাসির মামুন হতাশাবাদীদের দলে নন। তার কবিতায় প্রাণের আবেগের ফল্গুধারা শোনা যায়। সেখানে শরীর খুঁজে পেতেও পাঠককে কষ্ট করতে হয় না। শরীরকে ধারণ করেই কবিতায় তিনি জীবনের অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করেন। যা কাব্যপিপাসু মনকে সুস্থির করে আশ্বাসের বাণী শোনায়।
এ সময়ের আর এক কবি-প্রতিনিধি চন্দন চৌধুরী। নতুন শতকের সূচনাপর্বেও প্রতিনিধিদের মাঝে চন্দন সম্ভবত সবচেয়ে বেশি প্রকাশিত। সাহিত্যের সব শাখাতেই তার বিচরণ রয়েছে। চন্দন যেমন শিশুদের জন্য লিখতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, তেমনি গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, অনুবাদ সাহিত্যেও তার বিচরণ অবাধ। কাব্যগ্রন্থের পাশাপাশি তাই প্রবন্ধ, উপন্যাস এবং শিশুতোষ গ্রন্থও রয়েছে তার। তবু সব ছাপিয়ে চন্দনের পরিচিতি কবি হিসেবেই। তার কবিতার লক্ষণীয় বিষয় হলো আবেগেরে প্রাধান্য। তবে আবেগের প্রাবল্যে চন্দন কবিত্বকে বিসর্জন দেন না। নিজের ব্যক্তিসত্তা, বোধ, বিবেচনা ও নিজের দেখা প্রাত্যহিক জীবন চন্দন চৌধুরীর কবিতার বিষয়বস্তু। আর একে কাব্যবিন্যাসে ফুটিয়ে তোলার জন্য চন্দন জীবনকে নানাভাবে নেড়ে-চেড়ে দেখেন। এই নেড়ে চেড়ে দেখা থেকেই চন্দনের কবিতায় ফুটে ওঠে বাংলাদেশের ছবি। সেখানে বাংলার প্রকৃতি, মাটি, জল, হাওয়া তার ব্যক্তিত্বে স্বতন্ত্র হয়ে ওঠে। জীবনযাপনের প্রাত্যহিকতায় চন্দন নিজেকে তুলে ধরেন পাঠকের সামনে। আর এই তুলে ধরা থেকে পাঠকের পক্ষে চন্দনের ব্যক্তিত্ব বুঝে নেওয়া সম্ভব হয়। ব্যক্তিসচেতন চন্দন তার কবিতার ভেতর দিয়ে নিজেকে উন্মোচন করে দেন পাঠকের সামনে। সেখানে, চন্দনের কবিত্বের এই গুণের জন্য তার কবিতা তখন শুধু শিল্পের জন্য শিল্প হয়ে থাকে না, হয়ে ওঠে ব্যক্তি চন্দনের অনুভূতিও। যা ব্যক্তি চন্দনকে ছাপিয়ে পাঠকের হৃদয়ের দরজাও খুলতে বাধ্য করে। নাড়া দেয় ব্যক্তি হৃদয়ের নিভৃতে লুকিয়ে থাকা একান্ত আমিকে। এক্ষেত্রে চন্দন চৌধুরী’র ‘চৈতি ও চন্দ্রবিষয়ক’ কবিতাটি পাঠকের সামনে উপস্থিত করা যেতে পারে:
এই পড়ন্ত বইমেলায় তোমার টিপের চাঁদে
বসন্ত সাজানো দেখে আমি হই চন্দ্রচিকিৎসক
আর তখন তোমার স্পষ্টতম জোনাকিরা অদৃশ্য শাসায়—
বাইরে মাড়িয়ো না পা, পরাজিত হবে।
চৈতি, আমি শতবার পরাজয়ের লোভে সে-ই বাইরে বাড়ালাম পা।
(চৈতি ও চন্দ্র বিষয়ক : চন্দন চৌধুরী)
এ সময়ে ঐতিহ্যের শেকড় সন্ধানী, কবিতা চর্চাকারী মোহাম্মদ নূরুল হক। মোহাম্মদ নূরুল হকের কবিতা চিত্রকল্পময়। সেইসঙ্গে সবসময়ই তার কবিতায় একটি মেসেজ থাকে। কবিতার পঙ্ক্তিগুলোর সমন্বিত বাঁধনের ভেতর দিয়ে পুরো একটি দৃশ্য রচিত হয়। যেন বাংলা কবিতার সম্পূর্ণ নিজস্ব ঢঙ অনুভূত হয়। এক্ষেত্রে মোহাম্মদ নূরুল হকের ‘স্রোতের নামতা‘ কবিতাটি পাঠ করে দেখতে পারি:
ডালিম দানার মতো লাল লাল কামুক সূর্যাস্তে
লাফিয়ে উঠুক মুঠোবন্দি রাধিকার স্তন। আর
সমস্ত আকাশ সেই শিক্ষিত মন্থন দৃশ্য দেখে
নাক্ষত্রিক বেদনায় কেঁদে কেঁদে উঠুক এবার।জ্বলন্ত সূর্যের ঠোঁটে চুম্বন এঁকেছি চণ্ডীদাস।
আর রজকিনী ঘাটে—রসের দিঘিতে আমি ঢেউ।
নদী নদী জল এনে—আয় তৃষ্ণা মেটাবি দিঘির।জানি তোর কোমরের কলসে প্রেমের বিষ নাচে
তোর চুলের বেণীতে ফনা তোলা সাপের নিশ্বাস
তোর চোখের তৃষ্ণায় পুড়ে খাক সহস্র সমুদ্র
চান্দের আন্ধারে নামে গেলাশ গেলাম প্রিয়ঘুম
আমি ঘুম পান করি—রাত খাই কালাসন্ধ্যায়
বয়স্ক রাতের দিঘি ঢেউ তোলে শরীরে আমার।তোর গতরের নদী স্রোতের নামতা শেখে নাই?
(স্রোতের নামতা: মোহাম্মদ নূরুল হক)
এ সময়ে ঠিক এ ধরনের কবিতা লিখেছেন জাকির জাফরান। তার কবিতা আমিত্বময়, আকৃতিতে ছোট। কাব্যের পঙ্ক্তি বিন্যাসও স্বল্পদৈর্ঘ্যের। ছোট ছোট চেনা শব্দে জাকির জাফরান নিজের জগৎ ও নিজেকে পাঠকের সামনের উন্মোচন করেন অকৃত্রিমভাবে। যেখানে পাঠকের বুঝে নিতে কষ্ট হয় না নিজের জগতের সঙ্গে তার জগতের পার্থক্য। চেনা শব্দে, চেনা দৃশ্যে জাকির জাফরান যে পঙ্ক্তি নির্মাণ করেন তা থেকে কবিতা পাঠকের অনুভূতি খুব দূরের নয়। তাই তার কবিতার সঙ্গে, তার জগতের সঙ্গে, তার চিন্তার সঙ্গে পাঠক একাত্ততা অনুভব করেন। যে কারণে জাকির জাফরানের কবিতা উদ্ধৃতিযোগ্য। তার কবিতা পাঠকের হৃদয়ে প্রভাবসঞ্চার করতেও সক্ষম হয়। সহজবোধ্য পঙ্ক্তিবিন্যাস হলেও রফিকের কবিতা দূর-সঞ্চারী। দূর সময়ের ইঙ্গিত দেয়। পাঠককে ভাবনার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিতে সক্ষম হয়। বাংলা কবিতার মৌল উপাদান সমৃদ্ধ হয়ে তাই জাকির জাফরানের কবিতা ইতিহাস ঐতিহ্য চেতনার রাস্তায় হেঁটে চলে। আর এই হেঁটে চলার ভেতর দিয়ে নিজের অনুভূতিকে পাঠকের সামনে ছড়িয়ে দিতে পারে জাকির জাফরান। যেমন:
আজ বাবা অঙ্ক শেখাচ্ছিলেন
বললেন: ধরো, ডালে-বসা দুটি পাখি থেকে
শিকারির গুলিতে একটি পাখি মরে গেল
তবে বেঁচে থাকলো কয়টি পাখি?
অঙ্কের বদলে এই মন চলে গেল
বেঁচে থাকা নিঃসঙ্গ সে-পাখিটির দিকে
আর মনে এলো তুমি আজ স্কুলেই আসোনি।
(চিঠি: জাকির জাফরান)
একটি কবিতা লেখার জন্য কবিকে অনেক অকবিতা লিখতে হয়। অন্যের প্রভাব কাটিয়ে নিজের স্বাতন্ত্র্য নির্মাণের জন্য পুনঃপুনঃ নিজেকে নিয়োজিত করতে হয় শিল্পের ভুবনে। শিল্পের ভুবনে নিজেকে স্থাপিত করার প্রয়োজনে কেউ কেউ এক্ষেত্রে নিজের মনোজগৎকেই প্রাধান্য দেন, আবার কেউ কেউ নিজেকে নয় বরং বর্হিজগতের দিকে মেলে দেন তার দৃষ্টি। কেউ হয়ে ওঠেন অন্তুর্মুখী, নিজের ব্যক্তিগত উপলব্ধিসঞ্জাত অভিজ্ঞতাকেই কাব্যের বিষয় করে তোলেন। ফুটিয়ে তোলেন অন্তর্গত বেদনার দিক-সকল। নিজের ব্যক্তিসচেতন মনকেই পাঠকের সামনে মেলে দেন, পাঠকের সামনে নিজের জগৎ মেলে দেন।
শব্দের জটিলতা ছাড়াও যে কবিতা রচনা সম্ভব। সহজ-সরল ভাষ্যের ভেতর দিয়ে নিজের অনুভূতিকে যে প্রকাশ সম্ভব। উত্তর-আধুনিকতার আছড়ে পড়া ঢেউয়ের ভেতর দিয়েও শব্দের বিচিত্র বর্ণবিভায় নিজেকে স্বতন্ত্র করে তোলা সম্ভব। এসময়ের কবি মিজান মল্লিকের কবিতা সেই বেলাভূমি নির্মাণ করে। শব্দের দ্যোতনায়, কোনো উদ্দেশ্যহীন স্বপ্ন নির্মাণ নয় বরং সযত্নে নিজেকে নির্মাণের প্রচেষ্টা মিজান মল্লিকের কবিতা ধারণ করে। তার কবিতা শ্রমসাধ্য কোনো কৌশলীর নির্মাণ নয়; হৃদয় খুঁড়ে শব্দের বেলাভূমি সেঁচে, খুঁজে খুঁজে হীরা-মনি-মুক্তা দিয়ে অভিনব করে নিজেকে উপস্থাপনের প্রয়াস। মিজানের একটি একটি কবিতা উদ্ধৃত করি:
দূর গ্রাম থেকে খাদ্য বয়ে আনো
বৃদ্ধ কঙ্কালসার ঘোড়া।
কতকাল পিঠে চড়েছি পুরো পরিবার
ছিঁড়ে নিয়েছি তোমার মাংস,
উৎসবের দিন রন্ধনশালা থেকে
বাতাসে ছিটিয়ে নিয়েছি মশলার ঘ্রাণ।তোমার পাহাড়ি ধসনামা চোয়াল থেকে
নামিয়ে রেখেছি
ছুটির আবেদননামা।
জুতা পায়ে ঘোড়ায় চড়তে অভ্যস্ত
আমরা মাংসাশী।
আমার মেয়ে পিটে সওয়ার হলে
মনে হয়, আমিও পিতা হয়েছি।
(পিতা: মিজান মল্লিক)
সব কবিতাই প্রভাবসঞ্চারী হয় না। সব কবিই পারে না প্রভাব বিস্তার করতে বা তাদের চিন্তার উৎসারণ পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে। তারপরও কবি পাঠকের সঙ্গে নিজের হৃদয়ের, চিন্তার দূরত্ব ঘোচাতে ক্রমাগত শব্দের পর শব্দ দিয়ে সেতু তৈরির চেষ্টা করেন। কুয়াশার চাদর দূরে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করেন। ব্যাপারটি শ্রমসাধ্য। কারও কারও কবিতায় এই শ্রমের চিহ্ন স্পষ্ট, কারও অস্পষ্ট। কারও কবিতা পড়ার পর পাঠকের মনে হয় নির্মাণ। যেন কবি সেতু নয়, শব্দের ধোঁয়াশা তৈরির চেষ্টা করেছেন। আবার কেউ স্পষ্টই সফলতার দিকে এগিয়ে যান আপন বর্ণবিভায়। নিজের স্বতন্ত্র স্বও ও সুর নির্মাণের প্রয়াসী হন। ইমতিয়াজ মাহমুদ বাংলা কবিতার প্রবাহকে সচল রাখতে নিরন্ত্রর প্রয়াসী। ইমতিয়াজ মাহমুদ কবিতার সঙ্গে, কবিতার আবেগের সঙ্গে নিজের মস্তিষ্ককে জুড়ে দিতে চান প্রায়ই। নিজের স্বাতন্ত্র্য বোঝাতে কখনো বা শব্দের বানানেও চমক তৈরির প্রয়াসী। যা অনেক সময় বাধাগ্রস্ত করে সহজ স্বাভাবিক পাঠ। তারপরও কাব্যগুণ বিচারে ইমতিয়াজ তার বিশাল কল্পনা শক্তির সঙ্গে মেধার সমন্বয় ঘটিয়ে উৎরে যায়, ভাবিত করে পাঠক হৃদয়, দ্বিধাহীনভাবে তার অস্তিত্ব স্বীকার করতে বাধ্য করে। ইতিহাস ঐহিত্যের সঙ্গে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট মেলানোর প্রচেষ্টা ইমতিয়াজের স্বাতন্ত্র্য নির্দেশ করে। যেমন:
সোমালিয়ার শিশুর যে ভাষায় কাঁদছে, বাংলাদেশ বা স্পেনের শিশুরাও
সে ভাষায় কাঁদে। তাদের বর্ণমালা সহজ। উচ্চারণও এক। যেমন খরগোশ
বা শেয়ালের ডাক অনুবাদ করার জন্য কোন ভাষা বিজ্ঞানীর প্রয়োজন পড়ে
না। বিশ্বব্যাপী পশুদের ভাষা এক। পশু ও শিশুরা একই স্বভাবের।
মানুষ আলাদা রকম।
(বৈসাদৃশ্য: ইমতিয়াজ মাহমুদ)
সম্প্রতি লিখেছেন অনেকেই। তাদের কারও সম্পর্কেই শেষ কথা বলার সময় এখনও আসেনি। কেউই সম্পূর্ণভাবে নিজেকে মেলে ধরার মতো করে, সবার চোখে পড়ার মতো, ঘোর লাগানো, চোখ ধাঁধানো, চমকে দেওয়ার মতো এখনো কিছু করে উঠতে পারেননি। তবে কবিতার ভুবনে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে, স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত করতে সবাই সচেষ্ট। কে সফল হবেন, আর কারা সফল হবেন না, ঝরে পড়বেন দশক পেরুনোর আগেই, তা নির্ণয় করার সময় এখন সুদূর পরাহত। তবু বাংলা কবিতার নিজস্বতার ভেতরেই চেষ্টা করছেন সবাই। এ দলে রবু শেঠকেও রাখা চলে। রবু‘র একটি কবিতা উদ্ধৃতি করি:
গাঁয়ের ভিতর জন্ম যারা শহরে ওঠে
তারা ভুল করে:
ফুলের পিছনে ছোটে,
তোমার নিকটে আমার তেমন ভুল আছে
গাঁও খুব সরল শিক্ষক
ভুলেরা তার বিনম্র ছেলে
(গাঁও: রবু শেঠ)
ঐতিহ্য থেকে সরে আসা মানে নিজেকে অসহায় করে রাখা। এসময়ের কবিরা যেন পূর্বপাঠ থেকে এই শিক্ষা খুব ভালো করে আত্মস্থ করেছে। তাই বারবার তাদের চেতনায় ঢেউয়ের মতো আছড়ে পরে আমাদের সময়, স্বকাল। সময়ের অস্থিরতা, সাম্প্রতিকতা কিছুই উপক্ষেয় নয় আর কবিতায়। তবে নিজের মনকে বশে এনে উপস্থাপনেই আগ্রহী এ সময়ের কবিরা। এক্ষেত্রে কাব্য সত্তায় পূর্ববর্তী অগ্রজরাও হানা দেন চুপিসারে। তাদের আচ্ছন্ন করে রাখেন চেতনে, অবচতেনে। পূর্বজের সর্বগ্রাসী প্রভাব সন্তর্পণে কাটিয়ে তারা জ্বলে উঠতে চান নিজস্বতায়। নিজেদের গল্প, নিজেদের ভাষা নির্মাণ, প্রতিভার চর্চা, সময়ের অস্থিরতার ভেতর থেকেই ফুটিয়ে তুলতে প্রয়াসী। আজকের কবিমন।
এ সময়ের প্রতিনিধি জাহানারা পারভীনও নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছেব সাধনায়, গোপন সংকেত পাবার আশায়—
মানুষের শরীরেও নাকি ঘ্রাণ থাকে!
অথচ আমি ঘামের গন্ধ ছাড়া কিছুই পাইনি।
পরিপাটি শরীরের কাছাকাছি হেঁটে যেতে যেতে বহুবার
নাকে এসে বিঁধেছে পরিচিত পারফিউম,
মানুষ নয় শিশুদেরই ঘ্রাণ আছে শুধু;
প্রতিটি মানুষ ঘুমের মধ্যে কী চমৎকার শিশু হয়ে যায়!
(ঘ্রাণ: জাহানারা পারভীন)
দেখা অদেখা জগৎ এর রহস্য উন্মোচনে আমরা বিভাজিত হয়ে যাই দু‘দলে। আস্তিক এবং নাস্তিক এই দুই বিশ্বাসের ভেতর থেকে একদিকে যেমন চরম হতাশার সুর অন্যদিকে তেমনি জীবনের মৌল উপাদানগুলো খুঁজে ফেরার তালাশও চলে। তার ভেতর দিয়েই ফুটে ওঠে জীবনের বহুমাত্রিক ছবি। কারণ জীবনকে বাদ দিয়ে কোনো কিছুই নয়। জীবনকে খোঁজার, বোঝার ভেতর দিয়েই মহৎ সাহিত্য সৃষ্টির পথে এগিয়ে যান কবি। যুক্তির, অতীতের, বিশ্বাসের, আস্তিকতার মধ্য দিয়ে দূর সময়ের, নিজের মনোজগৎ চেনানোর প্রয়োজনেই নিজেকে উন্মোচন করেন কেউ কেউ। ফেরদৌস মাহমুদ কবিতার প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রেখেই নিজেকে মেলে ধরতে প্রয়াসী হয়েছে কবিতায়। অদৃশ্য শক্তির প্রতি আস্থা রেখেই ফেরদৌস মাহমুদ কবিতার অনন্ত যাত্রায় সামিল করেন নিজেকে:
বাতাসে সবকিছু নিশ্চয় থেকে যায়, তা-না হলে
আমাদের অনুপস্থিতিতে আমাদের নিয়ে
কথা হয় কিভাবে?
মৃত্যুর পর
নিশ্চয় জেনে ফেলে মানুষ
জীবতদের গোপনীয়।
গত জন্মে আমি কোকিলের ডিম হয়ে কাকের ঘরে জন্মেছিলাম
আগে মানুস হয়ে কাক শিকারের বিরুদ্ধে বলেছি কথা, আমাকে সবাই জানে
কোকিলের মতো কবি বলেই।
(টমাস মানের একটি গল্প পড়ে: ফেরদৌস মাহমুদ)
বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ এরকম কবি দশকে দশকে আসে না। এমন সর্বগ্রাসী প্রতিভার মর্মভেদী উচ্চারণ যদি প্রতি দশকে শোনা যেত? এমন নামের জন্য পাঠক আতীব্র অপেক্ষায় সময় কাটান। তারপরও এরকম নামের দ্যুতিতে আমরা রৌদ্রের ঝলক দেখতে পাই। সংক্রামিত শব্দের মিছিলে যারা এগিয়ে আসে তাদের নিয়ে স্বপ্ন দেখি। যদিও ক্ষমতার অভাবে দশকে দশকে টবে লাগানো স্বপ্নের চারাগাছ রৌদ্রের মুখ দেখে না প্রায়ই। তবু আমরা প্রতি দশকেই স্বপ্নবিদ্ধ হযে উঠি, শব্দের আগ্রাসনে, যেন ক্ষমতার অভাবে কেউ হারিয়ে না যায়। বরং শব্দে শব্দে অসাধারণ সংহতিতে, বাঁধনে, বুননে চমৎকার করে ফুটে উঠুক এক একটি লাল গোলাপ। শব্দের শূন্যতা, নীরবতা ভেঙে জেগে উঠুক আরক্ত গোলাপ। ফাঁকা স্থানগুলো ভরে যাক চমকে, শব্দে থেকে শব্দে।
এ সময়ের কবিদের মধ্যে যাদের কবিতা উল্লিখিতদের পাশাপাশি পঠিত হওয়ার দাবি রাখে, তাদের মধ্যে আরও রয়েছেন এমরান কবির, চাণক্য বাড়ৈ, তুহিন তৌহিদ, শামীম হোসেন, মিঠুন রাকসাম, মনিরুল মনির, অথির চক্রবর্তী, রিঙ্কু অনিমিখ প্রমুখ।