হুটহাট কিছু সংকট কারণ ছাড়াই সামনে আসে। সেগুলোকে কাছে নেওয়া যায় না, দূরেও ঠেলা যায় না। আমরা যখন আগামীর কবিতা নিয়ে কথা বলি, আমরা যখন আগামীর প্রকাশনা নিয়ে কথা বলি, আমরা যখন তরুণ কবিদের পাগলামো নিয়ে কথা বলি, তখন এসব হুটহাট ঝামেলা বিরুক্তির কারণ হয়ে ওঠে। সুখের সময় যে মানুষটি হাসি মুখে এগিয়ে আসে, সংকটে তিনি ফোন ধরেন না, সামনে উপস্থিত হলে মুখের ভাষা বদলে যায়। আবার কেউ কেউ কাজের দোহাই দিয়ে নিজেকে আটকে রাখেন পরদিনের প্রত্যাশা দিয়ে। তবুও আমরা দৃঢ়চিত্তে মুখোমুখি হই সংকটের। কবিতাই আমাদের শক্তি, কবিতার শক্তিতেই আমরা শক্তিমান। তাই কিছু চেনা মুখ আর কবিতার শক্তি আমাদের বাঁচিয়ে দেয়।
সব বাঁচা, বাঁচা নয়। ফলে আমরা নির্জনতা খুঁজি। কখনো কখনো নির্জনতাকে বড় আপন মনে হয়। নির্জন পথ কিংবা নির্জন ঘর তখন খুব কাছের মনে হয়, খুব প্রিয় মনে হয়। আসলে কান্নারও জায়গা লাগে, লাগে উপযুক্ত সময়। নির্জনতার জন্য আমরা ভাগ হয়ে যাই, কবিতার জন্য আমরা ভাগ হয়ে যাই। নির্জনতা যখন ভিজে যায়, তখনই তো কবিতার জন্ম হয়। আহা, কবিতা !
০২.
কবিতার জন্য একজন সার্বক্ষণিক সঙ্গী খুব প্রয়োজন। যিনি কবিতার প্রথম পাঠক কিংবা কবিতার প্রথম সমালোচক। আমাদের প্রত্যেকের ঘরে ঘরে কেউ না কেউ আছেন, কিন্ত পাঠক কিংবা পাঠিকার পরিমাণ খুবই কম। অন্ততঃ আমার লেখার প্রথম কোন পাঠক ঘরে নাই। মনটা খারাপ হয়ে যায়। রাতে যখন পড়তে বসি কিংবা লিখতে, মনটা চায় কেউ এসে এক কাপ চা বানিয়ে দিক, ন্যূনতম জিজ্ঞেস করুক আজকে কী লিখলে? অধীর আগ্রহে শুনবে কিংবা আগ্রহের ভান করবে। আগ্রহের ভানটা কবিতাকে আরো আশ্রয়ী করে তুলবে, আশা জোগাবে। কিন্তু তা তো হয়ে ওঠে না। ফলে কবিতা পরকীয়া হয়ে ওঠে, নতুন পাঠিকা খোঁজে। ফলে আমার পাঠিকা থাকে দূরে, নিরালা রোডে।
০৩.
মন খারাপ করে থাকে ছেলেটা। খারাপের কারণটা বলে না, চুপচাপ থাকতেই পছন্দ করে। নিজের মতো করে নিজেকে সে গুছিয়ে নেয়, মনে মনে কষ্ট লালন করে, মনে মনে কবিতা লালন করে। মনে মনে জমে থাকা কষ্টগুলো গোছানো কবিতা হয়ে ওঠে। এসব পুষে থাকা কষ্ট কিংবা বাতাসে ভেসে আসা কথাগুলো যখন বেদনা হয়ে আসে, তখন ছেলেটি কবিতা লেখে, ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়।
সেই জন্য কবির উচ্চারণ, ‘আমি চাই প্রিয় মুখ/কাছে এসে বেদনা দেখুক’- কবি মামুন রশীদের এই উচ্চারণ তখন সব কবির উচ্চারণ হয়ে ওঠে।
কবিতা তার কাছে বেদনার আশ্রয়, কবিতা তার কাছে কান্নার আশ্রয়, কবিতা তার কাছে বাঁচার আশ্রয়। এসব বেদনা আর কবিতার কষ্ট নিয়ে ছেলেটা পুরো শহরময় ঘুরে বেড়ায় আর কবিতাগুলো ফেরি করে মানুষ হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে যায়। কেননা একদিন কষ্টগুলো কবিতা হয়ে ওঠবে।
০৪.
কবিতা আসলে কবির দুঃখের বর্ণনা। মাঝে মাঝে তো এই রকমই মনে হয়। কিংবা কবিতা হলো ভালবাসার পরকীয়া। নিজের দুঃখ বেদনা, অপ্রাপ্তি আর বঞ্চনার কথা কাউকে বলতে না পারা, বলার মতো কোনো মাধ্যম না পাওয়া কিংবা সমাধানের কোনো রাস্তা না পাওয়া, তখনই তো সেগুলো কবিতা হয়ে ওঠে। ফলে কবিতা হচ্ছে কবির দুঃখের আশ্রয়, বেদনার আশ্রয়। সব কবির মধ্যে আমির যে নির্জনতা বাস করে সেই আমির বহিঃপ্রকাশই তো কবিতা।
০৫.
কবিমন সবসময় লালন করে, তার প্রিয় কবিতাগুলো, তার প্রিয় মানুষ পড়ুক। শুধুই পড়বে না সেখান থেকে তুলে নেবে কবির দুঃখ। আর সেই দুঃখ তুলে নিয়ে প্রিয় মানুষটি কবির দুঃখের সমব্যথী হবে। না হলে কবির কথা মিথ্যে হয়ে যাবে? না মিথ্যা হবে না। সেই চিরকালীন কথা, সেই চিরকালীন দুঃখ, সেই চিরকালীন প্রেম কিংবা বিরহ পাঠক গ্রহণ করে পাঠকও কবির দুঃখে দুঃখী হয়ে ওঠে। তাই কবিতা হয়ে যায় চিরকালীন, কবিতা হয়ে যায় সময়ের প্রতিচ্ছবি। সেই জন্য কবির উচ্চারণ, ‘আমি চাই প্রিয় মুখ/কাছে এসে বেদনা দেখুক’- কবি মামুন রশীদের এই উচ্চারণ তখন সব কবির উচ্চারণ হয়ে ওঠে।