বাঙালির চার ট্র্যাজিক নায়ক: পাঠ-পরিক্রমা


একটি জাতির সংগ্রাম-সংঘর্ষ ও বিপ্লবগাথা রক্ষিত হয় ইতিহাসের পাতায়। আর সাহিত্যে স্থান করে নেয় সমাজ-মানুষ-প্রকৃতি ও জীবনের নানাবিধ ঘটনার চালচিত্র। সমাজ সত্য থেকে যা ঐতিহাসিক সত্যে রূপ নেয়, তা-ই আবার সাহিত্যিক পরিমণ্ডলে নতুন করে সৃজিত হয়। সেই সৃজনকলার অংশী হয় সাহিত্যিক-রাজনীতিবিদের মতো বোদ্ধামহলও। তাদের জীবনের গতিবিধি-কর্মপন্থা-বিপ্লব-দ্রোহ-সংগ্রাম-সংঘর্ষ হয়ে ওঠে সাধরণের অনুপ্রেরণার অংশ। গবেষক-প্রাবন্ধিক রকিবুল হাসানের ‘বাঙালির ট্র্যাজিক নায়ক’ গ্রন্থে স্থান পেয়েছে এমনই চারজন ট্র্যাজিক নায়ক। যাঁরা সমাজ-রাষ্ট্রিক-সাহিত্যিক পর্যায় পর্যন্ত নিজেদের সীমানাকে বর্ধিত করেছেন। জীবনের পরতে পরতে যে সংগ্রাম-সংঘর্ষ ও বিপ্লবের রূপ নেয়, তা ছড়িয়ে দিয়েছেন জগৎময়। কখনো সেই সংগ্রামের কাহিনি চোখে জল এনে দেয়, কখনো তা সাহস সঞ্চার করে বাংলা ও বাঙালি জাতিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য। বাঙালির চার ট্র্যাজিক নায়ক গ্রন্থে স্থান পাওয়া চার জন হলেন—আধুনিক কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, বিপ্লবী বাঘা যতীন ও বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

ড. রকিবুল হাসান বাঙালির এই চার ট্র্যাজিক নায়কের কথা তুলে ধরতেই গ্রন্থটিতে চারটি অধ্যায়ের সংযোজন করেছেন। প্রথমেই তিনি আলোচনা করেছেন মাইকেল মধুসূদন দত্তকে নিয়ে। এখানে লেখক মধুসূদনের ট্র্যাজেডি ও মধুসূদনের জীবনে নারী নিয়ে আলোচনা করেছেন। আমরা জানি, মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩) বাংলা সাহিত্যের এক যুগান্তকারী প্রতিভার নাম। যিনি একাই বাংলা সাহিত্যকে বহুদূর পর্যন্ত সুপ্রসারিত করেছেন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত আধুনিক বাংলা কবিতার জনক, মাত্র ঊনপঞ্চাশ বছরের স্বল্প জীবনে কেবল সাত বছর সাহিত্যের জন্য ব্যয় করেছিলেন। তাঁর এই ক্ষণস্থায়ী জীবনে দুঃখ-দারিদ্র্য-সাংসারিক জটিলতা ও টিকে থাকার লড়াই সবই স্থান পেয়েছে এই গ্রন্থে। ড. রকিবুল হাসান তুলে ধরেছেন বাংলা সাহিত্যের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী প্রতিভা মাইকেল মধুসূদন দত্ত কিভাবে একক প্রচেষ্টায় বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বের আসনে মর্যাদার সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন, সে-সব বিস্তৃত বিষয়।

বায়রন, গুস্ত্যাব, ফ্লাবের, শেলি, কিটস, বদলেয়ার, রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল ইসলাম সবার জীবনই রহস্যাবৃত। কারোর জীবনই সমান্তরাল রেখায় যাপিত হয়নি। পৃথিবীর যত জ্ঞানী-গুণী ও সফল মানুষ সবাই জীবনের পথে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করেছেন। তাদের সেই সংগ্রাম ও সংঘর্ষের পথ ধরেই সাফল্য রচিত হয়েছে। মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনেও হানা দিয়েছে ঘটনার ঘনঘটা। তবু তিনি সাহিত্যের পথ থেকে ছিটকে পড়েননি। বরং জীবনই তাকে ধোঁকা দিয়েছে। ঊনপঞ্চাশ বছরের জীবনের সাতটি বছর তাঁকে আজাবধি সাহিত্য জগতে সমাসীন করে রেখেছে। এই আলোকোজ্জ্বল নক্ষত্রের ব্যক্তিজীবনে একচিলতে আলোও ছিল না বলেই ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। জীবনকে যখনই সুখের মহিমায় ধরতে চেয়েছেন তখনই জীবন চরমতম পরিহাস করেছে। বাল্যকাল থেকেই দ্রোহী মধুসূদন জীবনের মারপ্যাঁচে শেষপর্যন্ত পর্যদুস্ত।

রকিবুল হাসান ‘বাঙালির ট্র্যাজিক নায়ক’ গ্রন্থে তুলে ধরেছেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত কিভাবে পারিবারিকভাবে বিয়ের ঝক্কিঝামেলা থেকে বাঁচতে গিয়ে আরও গুরুতর সংকটে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন। প্রসঙ্গক্রমে ‘মধুসূদন নিজেও জানতেন পিতার ইচ্ছের বিরুদ্ধে যাওয়ার পরিণতি কতোটা কঠিন হতে পারে! আর একটা ব্যাপার, তিনি নিজেও বুঝতে পারছিলেন, কোন পন্থায় এ পরিস্থিতি থেকে নিস্তার পাবেন! এরকম সংকট থেকে বাঁচার জন্য তিনি খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণের কথা ভাবেন। কারণ খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করলে কোনো হিন্দু ভদ্রলোক তাঁর সঙ্গে মেয়ে বিয়ে দিতে রাজি হবেন না। ফলে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করলে এ অবস্থা থেকে যেমন মুক্তি ঘটবে, তেমনি খ্রিষ্টান সমাজ ও ইংরেজ-কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক তৈরি হবে।’ ফলে মধুসূদন দত্ত ব্যক্তিসমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে ও সুবিধা লাভের আশায় খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেন। যা তার জীবনকে চরমভাবে বিপর্যস্ত করে!

খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেই মধুসূদন ক্ষান্ত থাকেননি। তিনি মাদ্রাজে যাওয়ার পরে সেখানে অরফ্যান অ্যাসাইলামের স্কুলে শিক্ষকতা করার সময়ে রেবেকার সঙ্গে পরিচয় ঘটে। পরিচয় থেকে তাদের মধ্যে প্রেম এবং পরবর্তীকালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ১৮৪৮ সালের ৩১ জুলাই । রেবেকা ও মধুসূদন চার সন্তানের জনক-জননী। রেবেকার ভালোবাসায় পরিপূর্ণ সুখী মানুষ মাইকেল মধুসূদন দত্ত আবারও এমিলি হেনরিয়েটা সোফিয়ার প্রেমে পড়েন! ১৮৫৬ সালে মাদ্রাজ থেকে কলকাতায় পাড়ি জমালে তিনি রেবেকা ও সন্তানদের কাছে আর ফিরে আসেননি! সেখানেই হেনরিয়েটার সঙ্গে বাস করতে শুরু করেন। ধর্মীয় বিধিনিষেধের বেড়া টপকে তারা একে অন্যের আশ্রয় হয়ে ওঠেন। এই দম্পতির জন্ম নেয় চার সন্তান। এর মধ্যে দুজন বেঁচে ছিলেন। হেনরিয়েটাকে বিয়ে করার পর ১৮৫৮ সালের দিকে নতুনভাবে সৃষ্টিশীলতায় মেতে উঠেছিলেন। একের পর এক সৃষ্টি করেন শিল্পসফল সাহিত্য। এ প্রসঙ্গে রকিবুল হাসান উল্লেখ করেছেন, ‘মধুসূদন তাঁর সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে যত হিসেবী ছিলেন, সংসার জীবনে ঠিক তার উল্টো ছিলেন। সংসার তিনি কোনোদিনই বোঝেননি। সংসারের হিসাবও বোঝেননি।’

প্রাবন্ধিক ড. রকিবুল হাসান এই গ্রন্থে মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনসংগ্রামকে যেভাবে তুলে ধরেছেন, তা তাঁর বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি। তিনি সাহিত্যের হিসেব ঠিকঠাক কষলেও জীবনের বেলায় অন্তঃসারশূন্যই থেকেছেন! জীবন তাঁকে শেষমেশ ট্র্যাজিক নায়কে পরিণত করেছে! মাইকেল মধুসূদন দত্তের মতোই বাঙালির আরেক ট্র্যাজিক নায়ক বিপ্লবী বাঘা যতীন। রকিবুল হাসান দ্বিতীয় পর্বে এই বিপ্লবীকে নিয়ে আলোচনা করেছেন। যার জীবনের পুরোটাই বিপ্লব-সংগ্রাম ও সংঘর্ষ দিয়ে পূর্ণ৷ তিনি নিজেকে কখনো পেছনের সারিতে রাখেননি বরং বাঙালির অধিকার আদায়ে তিনি সবসময় বদ্ধ পরিকর থেকেছেন। জীবনকে বাজি রেখে অধিকার আদায়ের পথে সোচ্চার হয়েছেন। ব্রিটিশরা যখন ভারতবর্ষকে জোঁকের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে গ্রাস করছিল ঠিক তখনই এদেশের সূর্যসন্তান বাঘাযতীনের মতো বীরেরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তাঁদের উদ্যোমী শক্তি শত্রুর হিংস্রতাকে রুখতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল।

রকিবুল হাসান তাঁর ‘বাঙালির চার ট্র্যাজিক নায়ক’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন, ব্রিটিশ শাসকের শাসন ব্যবস্থার ভিত কাঁপিয়ে দিতে সক্ষম হন ভারতের স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীরা। যারা পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে জাতিকে মুক্তি দিতে জীবন বাজি রেখেছে। ‘স্বদেশী আন্দোলন’-এর পথে হেঁটে ভারতমুক্তির জন্য হাসতে হাসতে মৃত্যুর সোপানে জীবন লিখে দিয়েছেন। ক্ষুদিরাম, সুভাষচন্দ্র বসু, চিত্তপ্রিয় রায় চৌধুরী, প্রীতিলতা, ব্রজেন সেন, সূর্য সেনের মতো অসংখ্য বিপ্লবী। ‘ব্রিটিশ-শাসিত ভারতবর্ষের বৈপ্লবিক ইতিহাসের দ্বিতীয় পর্বের সর্বপ্রধান নায়ক ছিলেন যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (বাঘা যতীন)। তিনি বিচ্ছিন্ন বিভিন্ন বিপ্লবী সংগঠনকে একত্রিত করে, তার নেতৃত্ব নিজে গ্রহণ করে, ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে সংগঠনকে একত্রিত করে, তার নেতৃত্ব নিজে গ্রহণ করে, ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে সংগঠিত সশস্ত্র বিপ্লবের নতুন ধারা সৃষ্টি করেন। নিজের পারিবারিক জীবম, উচ্চশিক্ষা লাভ সব তুচ্ছ করে দেশের মুক্তিই তাঁর কাছে সর্ববৃহৎ স্বার্থে পরিণত হয়।’

বিপ্লবী বাঘা যতীনের প্রাগাঢ় দেশপ্রেমই তাঁকে দেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করতে প্রেরণা জুগিয়েছে। যতীন্দ্রনাথ কিভাবে বাঘা যতীন হয়ে উঠলেন, তারও বিশদ আলোচনা এই গ্রন্থে রয়েছে। মূলত বাঘের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়েই একা যতীন বাঘ মারতে উদ্যোত হন। তিনি সফল হন। পরবর্তীকালে সাধারণ মানুষ তাকে বাঘা যতীন নামে ডাকতে শুরু করেন। বাঘ-মারার ভেতর দিয়েই বিপ্লব নতুন মোড় নেয়। বাঘা যতীন ব্রিটিশ নিধনে নতুনভাবে উদীপ্ত হন। তিনি অনুভব করেন, ইংরেজদের বিতাড়িত করতে অস্ত্রের প্রয়োজন নানা করিৎকর্মা করে সেই অস্ত্রও জোগাড় করেন। জ্যোতিষ, চিত্তপ্রিয়, নরেন্দ্র, মনোরঞ্জন মাত্র চারজন বিপ্লবীকে নিয়ে বাঘা যতীন বালেশ্বরের দিকে রওয়ানা দেন। এ সময় ব্রিটিশদের অপপ্রচারের মুখে বাঘা যতীন ও তাঁর সহকর্মীদের কাপ্তিপোদায় পৌঁছানো অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে৷ জনতা তাঁদের ডাকাত মনে করে পেছন পেছন চিৎকার শুরু করে। গ্রামবাসীর মারমুখী ধাওয়া খেয়ে, দীর্ঘ বুড়িবালাম নদী সাঁতরে পার হয়ে তারপর বাঘা যতীন তাঁর সহকর্মীদের নিয়প চাষাখণ্ডের একটা বনের মধ্যে পৌঁছান। তখনো বিপ্লবীদের আক্রমণ থেমে যায়নি। তারা ব্রিটিশদের প্রতিরোধের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে চলেছে কিন্তু গ্রামবাসীর তোপের মুখে তারা পর্যদুস্ত হয়ে পড়ে! বাঘা-যতীন মাত্র চার জন সহকর্মী নিয়ে ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে তিব ঘণ্টা যুদ্ধ করে৷ গুলি শেষ হলেও ব্রিটিশদের সঙ্গে আপোষ করেননি। প্রাবন্ধিক রকিবুল হাসান তুলে ধরেছেন, ‘বাঘা যতীন যখন ধরা পড়লেন, তখন ব্রিটিশ অফিসাররা তাঁর রণকৌশলে বিস্মিত হন। বিস্ময় প্রকাশ করে ব্রিটিশবাহিনীর প্রধান টেগার্ট বলেই ফেললেন, ‘আমরা এতক্ষণ মাত্র পাঁচজনের সঙ্গে যুদ্ধ করলাম’!’’

পরে গুলিবিদ্ধ বাঘা-যতীনকে বালেশ্বর গভর্নমেন্ট হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অসংখ্য পুলিশ, অশ্বারোহী আর মিলিটারি দিয়ে হাসপাতাল ঘিরে রাখা হয়। পুলিশের বড় কর্মকর্তার অনুমতি ছাড়া কেউ সেখানে প্রবেশ করতে পারেনি। তবে বাঘা-যতীন শেষপর্যন্ত দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করেন। ‘চার্লস টেগার্ট এবং তার সঙ্গী সাহেবেরা বের হয়ে যাবার পরই বাঘা যতীন নিজেই তাঁর ব্যান্ডেজ, অপারেশনের সেলাই ছিঁড়ে ফেললেন। ফিনকি দিয়ে তীব্রবেগে ছুটে বেরিয়ে এলো রক্তস্রোত। […] তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন, ১৯১৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর৷ আর তখনই রচিত হলো ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক মহাকাব্য।’ রকিবুল হাসান ইতিহাসের এই মহানায়কের ট্র্যাজিক জীবনকে তাঁর গ্রন্থভুক্ত করেছেন পরম যত্নে ও শ্রদ্ধায়।

মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বিপ্লবী বাঘা যতীনের মতো রকিবুল হাসানের বাঙালির চার ট্র্যাজিক নায়ক গ্রন্থে স্থান করে নিয়েছেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর জীবনই তাঁকে এই স্তরে স্থান দিয়েছে। শৈশব-কৈশোর থেকেই যিনি লড়াই করেছেন জীবনের পরতে পরতে সেই লড়াই চলেছে মৃত্যুাবধি! কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কবি। বাংলা কবিতার মাইলফলক তাঁর হাত ধরে সৃষ্ট। তিনি বাংলা সাহিত্যের বিদ্রোহী কবি, ব্রিটিশ রাজ যার গলার ঝঙ্কারে কেঁপে কেঁপে উঠেছে বারবার! সেই অদম্য সাহসী, লড়াকু সৈনিক কাজী নজরুল ইসলাম। কিন্তু জীবন তাঁকেও বঞ্চনা করেছে। স্বল্পায়ু জীবনে প্রতিনিয়ত লড়াই ছিল তাঁর ভাগ্যের লিখন৷ মাত্র নয় বছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে জীবনের ঘূর্ণিপাকে বারবার নিজের অস্তিত্ব খুঁজে ফিরেছেন। দারিদ্র্যের নির্মম কষাঘাত, অভিভাবকহীনতা, ছন্নছাড়া এলোমেলো জীবন ছিল নজরুল। একমুঠো ভাতের নিশ্চয়তা ছিল না যার সেই হয়ে উঠেছিলেন কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক, গীতিকার, সুরকার! ঝড়োজীবনের হাওয়ায় ভেসে না গিয়ে মাত্র তেইশ বছরে সৃষ্টি করেন এত এত বিস্ময়ের!

দুঃখে-দারিদ্র্য-সংগ্রামের মাঝেই জীবনে আসে কয়েকজন নারী! প্রথমজীবনে বিয়ে হয় সৈয়দা খাতুনের সঙ্গে যাকে নার্গিস নামেই অভিহিত করা হয়েছে। ছলনাময়ী বিয়ের হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে কবি পালিয়ে বাঁচেন। যদিও এ নিয়ে নানা তর্ক-বিবাদ আছে। এরপর কবি বিয়ে করেন প্রমীলা দেবীকে। এই বিয়েতেও ঘোরতর সমস্যার মধ্যে দিয়ে দুজনকে যাপন করতে হয়। হিন্দু-মুসলিম বিবাদ কাটিয়ে এলসময় তাঁরা সংসারী হয়েছিলেন। এরপর ১৯৪২ সালের ৯ জুলাই কলকাতা বেতারে শিশুদের একটি অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠের সময় বাকরুদ্ধ হয়ে যান কবি! ১৯৬২ সালের ৩০ জুন প্রমীলা দেবীর মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে নজরুলের জীবনের ইতিহাস খণ্ডিত হয় আরেকবার! ভগ্ন নজরুল বারবার করে ভেঙেছেন! জীবন পাড়ে কখনোই যেন তার তরী ভেড়েনি! প্রবল জোয়ারের মুখে পাড় ভাঙা নদীর মতো নির্বাকভাবে জীবনকে বইয়ে দিয়েছেন। একের পর এক মৃত্যু, জীবনে না পাওয়ার হাহাকার, দুঃখ-দারিদ্র্যের যাতনা সবমিলিয়ে নজরুল এক ট্রাজিক নায়ক। দীর্ঘ চৌত্রিশ বছর বাকরুদ্ধ জীবনযাপন করার পর ট্র্যাজিক নায়কের প্রস্থান ঘটে! বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল জীবনে বেদনার বালুচরে হাঁটলেও মাত্র তেইশ বছরে বাংলা সাহিত্যকে দুহাত ভরে দিয়ে গিয়েছেন। তিনি সুস্থ থাকলে হয়তো বাঙালি জাতির ইতিহাসে সঞ্চিত হতো আরও শতসহস্র মণিমাণিক্যের!

মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বিপ্লবী বাঘা-যতীন, কাজী নজরুল ইসলামের মতো বাংলার আরেক ট্র্যাজিক নায়ক স্থান করে নিয়েছেন এই গ্রন্থে! তিনি হলেন বাংলার অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর জীবন শেষ হয়েছে এক ট্র্যাজিক পরিণতির ভেতর দিয়ে। জীবন পথে হাঁটতে গিয়ে যিনি এক সেকেন্ড নিজের ও তাঁর পরিবারের কথা ভাবতে কালক্ষেপণ করেননি। বরং দেশমাতৃকার জন্য নিজের জীবনকে অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন। সাধারণ মানুষকে শোষণ-নিপীড়ন ও বঞ্চনার হাত থেকে রক্ষা করতে তিনি জীবন পণ করেছেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর সারা জীবন অন্যায় ও অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে গেছেন। কখনোই তিনি প্রতিবাদী চেতনা থেকে সরে আসেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায় চর্তুথ শ্রেণীর কর্মচারীদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায়ের জন্য ছাত্রত্ব হারিয়েছেন। জীবনভর অসংখ্যবার কারাবরণ করেছেন বাংলার মানুষকে রক্ষার তাগিদে। পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে তিনি বাঙালি জাতিকে সাহস সঞ্চার করেছেন। একাই সাত কোটি মানুষকে স্বাধীনতার চেতনায় উদীপ্ত করেছেন। সেই মহান নেতা বাঙালির বন্ধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যিনি নিজে ট্র্যাজিক জীবনের শিকার হয়েও বাংলার মানুষের মুখে হাসি ফেটাতে চেষ্টা করেছেন। তাদের ভাগ্যলিপি পরিবর্তনের ডাক দিয়েছেন।

প্রাবন্ধিক রকিবুল হাসান তাঁর বাঙালির ট্র্যাজিক নায়ক গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ট্র্যাজিক জীবনকে তুলে ধরেছেন। সেইসঙ্গে স্থান দিয়েছেন কারাগারে বসে লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থের আলোচনা তথা লেখক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর পারদর্শী ভূমিকার কথা। সবিশেষ এ গ্রন্থে স্থান পেয়েছে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের কথা, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ‘বাঘা যতীন মিলিটারি অ্যাকাডেমি’।

গ্রামের ছোট্ট খোকা কিভাবে বাংলার অবিসংবাদিত নেতা হয়ে উঠলেন তাঁর আদ্যোপান্ত আলোচনা রয়েছে এই গ্রন্থে এছাড়া লেখক তুলে ধরেছেন বঙ্গবন্ধুর বিয়ে, নেতা হয়ে ওঠা, ১৯৭৫ সালের আগস্টে সপরিবারে নিহত হওয়ার ঘটনা! একের পর এক চোখের সামনে যেন পর্দা পড়ে জীবনের! প্রাবন্ধিক রকিবুল হাসান তুলে ধরেছেন, ‘‘শেখ মুজিব হঠাৎ আর্বিভূত কোনো নেতা ছিলেন না। দীর্ঘ পথপরিক্রমায় ইতিহাসের সোপান বেয়ে বাঙালির ভালোবাসা থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়েছিলেন।’’

শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থের আলোকে রকিবুল হাসান তুলে ধরেছেন বঙ্গবন্ধুর কারাগারের জীবনের দুর্বিষহ বর্ণনার অংশ। এখানে স্থান পেয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শৈশব-কৈশোরস্মৃতি, বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের দেশের জন্য আত্মত্যাগ, শেখ মুজিবুর রহমানের জেলজীবন, বাংলার নেতা হয়ে ওঠা প্রভৃতি। প্রাবন্ধিক রকিবুল হাসান গ্রন্থটি শেষ করেছেন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বার্তা দিয়ে। বিপ্লবী বাঘা যতীন দ্বারা তিনি বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত ছিলেন। সেই অনুপ্রেরণা এবং শ্রদ্ধার জায়গা থেকে বাঘা-যতীনের স্মৃতিরক্ষার্থে নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন ‘বাঘা-যতীন মিলিটারি অ্যাকাডেমি’ কিন্তু সেই প্রয়াস ব্যর্থই থেকে গেছে জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের ভেতর দিয়ে! রকিবুল হাসানের জাতির সম্মুখে নতুনভাবে তিনি বাঘা-যতীনকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন তাঁর এই গ্রন্থের মাধ্যমে। এবং শেষপর্যন্ত এও স্বপ্ন দেখেছেন যদি জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা দেশনেত্রী শেখ হাসিনা ‘বাঘা-যতীন মিলিটারি অ্যাকাডেমি’ প্রতিষ্ঠার প্রতি নজর দেন তাহলে দেশ তার বীর সন্তানদের সঠিক মর্যাদায় আসীন করতে পারবে!

রকিবুল হাসান গ্রন্থটির আদ্যোপান্ত নিরেট বর্ণনা করেছেন। মেদহীন একটি তথ্যবহুল বই। জ্ঞান আহরণের বাইরে এসে বাঙালিকে পথ দেখাতে এ গ্রন্থটি মোটিভেশনাল বইয়ের মতোও কার্যকরী বলে আশা রাখছি! বইটি গ্রাফোসম্যান পাবলিশকেশন থেকে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারির একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে। রকিবুল হাসান গ্রন্থটির মধ্যে দিয়ে জাতিকে যে বার্তা প্রদান করেছেন তা এদেশের মানুষকে আলোকিত করুক। পরিশেষে বলাই যায়, জীবন ট্র্যাজেডির। সেই ট্র্যাজেডি কারও কম কারও-বা বেশি। তবু মাথা তুলে দাঁড়াতে হয় আপন শক্তিতে। কোনো অপশক্তির কাছে মাথা নত করা বাহাদুরি নয় বরং জীবন পথে সংগ্রাম করে টিকে থাকার মন্ত্রই প্রকৃত মানুষের লক্ষণ। তাই বাঙালির চার ট্র্যাজিক নায়কের মতো সংগ্রাম ও সংঘর্ষের জীবন হলেও সে জীবনকে করে তুলতে হবে অনুপ্রেরণার, অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় করে!