লঙ্কাপুরী


সূর্যটা নুয়ে পড়েছে ক্লান্তিতে। জারুলের তীর্যক ছায়া নিকোনো ছোট্ট উঠোনটাকে গিলে ফেলেছে প্রায়। রান্নাঘরের পাশের পাটকাঠির বেড়ার আড়ালে নিজের লম্বা চুলগুলোকে গামছা দিয়ে ঝেড়ে জল ঝরাচ্ছিল আলেয়া। শীতের এই পড়ন্ত বেলায় স্নানসিক্ত চুল সহজে শুকায় না, তাতে ঠাণ্ডা লেগে যায়। এমনিতেই ঠাণ্ডার ধাত তার, তায় আবার পোয়াতি, এসময়ে একটুতেই নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসে, কফ জমে যায় বুকে, রাতে কষ্ট হয় ঘুমোতে। স্নানসিক্ত চুল থেকে তাই যতটা সম্ভব জল ঝরাতে চেষ্টা করে আলেয়া। শরীরটাকে বড় একটা নোয়ানো যায় না এ সময়, ভরা পেটে নিচু হতে গেলে শরীর অবশ হয়ে আসতে চায়। সংসারের হরেক কাজ সারতে বেলা যায়, শীতের বেলার সঙ্গে দৌড়ে আজকাল আর পেরে ওঠে না আলেয়া। ফলে স্নান সারতে বেলা যায় তার, ঠাণ্ডাও পিছু ছাড়ে না।

—মা!
—কওছে মা!
—আমিও বাজানের লগে যাইয়াম!
—কীতা কও তুমি, মা? বাজানের লগে কই যাইবায় তুমি? বাজান কুনহানে যাইবো, কুনহানে ঘুমাইবো তার কুনু দিশা আছেনি? আর বাজান যাইব কামে, তুমি তার লগে যাইয়া করবায় কী?

চুলে সজোরে গামছার বাড়ি দিতে দিতেই পাঁচ বছরের মেয়ে টুম্পাকে যথাসাধ্য ছবক দেওয়ার চেষ্টা করে আলেয়া। মেয়েটা বাপ-ন্যাওটা খুব। বাপের সঙ্গে আঠাসদৃশ লেগে থাকে। আলেয়াকে বড় একটা পাত্তা দেয় না। আলেয়াও টুম্পার থেকে খানিকটা নিরাপদ দূরত্ব রেখেই চলার চেষ্টা করে আজকাল। টুম্পার বড় মারকুটে স্বভাব। হাত-পা চালায় সমানে। ডরে বুক ধড়ফড় করে আলেয়ার। পেটে হাত দিয়ে ভেতরের প্রাণটাকে অনুভব করার চেষ্টা করে সে। সাতমাসে পড়েছে। এখনই বাইরে আসার আকুলিবিকুলিতে ব্যস্ত প্রাণটা। ছেলে। কদিন আগে মোখলেস থানা শহরে নিয়ে গিয়ে আল্ট্রাসনোগ্রাম করিয়ে এনেছে আলেয়ার। ডাক্তার বলেছে, ছেলে, ভালো আছে, সুস্থ আছে। মনে মনে সেই কবে থেকে একটা পুত্র সন্তানের জন্য প্রতীক্ষার জাল বিছিয়ে রেখেছে তারা। আলেয়ার শরীর ভারী হয়েছে ঢের, আজকাল স্বাভাবিক কাজ-কর্মেও ভীষণ কষ্ট তার। হাঁটা-চলায় শরীর ভেঙে পড়তে চায়। এ সময় টুম্পাকে তাই খানিকটা দূরে দূরেই রাখে সে। টুম্পার এখন অধিকাংশ সময় কাটে দাদি নবীরন নেসার সঙ্গে, খিদে পেলে আলেয়ার কাছে আসে, খেয়ে-দেয়ে আবার সে দাদির জিম্মায় চলে যায়। শুধু রাতের বেলা মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে তার চুলের রাজ্যে নাক না ডুবোলে ঘুম আসে না আলেয়ার। দিনে মেয়ে মা থেকে দূরে দূরে থাকলেও রাতে মাকে জড়িয়ে না ঘুমোলে চলে না মেয়েরও। মায়ের কোলের মধ্যে শুয়ে রূপকথার রাজ্যে না হারালে চোখে ঘুম নামে না তার। দিনে মোখলেস বাড়িতে থাকাকালে আলেয়া বা দাদি নবীরন নেসার ধারে-কাছেও ভেড়ে না টুম্পা। বাপের সঙ্গে কী যে এত পুটুর পুটুর গল্প মেয়ের কে জানে! মোখলেসও মেয়ে অন্ত প্রাণ। মেয়েকে মুহূর্তমাত্রও চোখের আড়াল করতে চায় না সে। সকালে মুরগির ঝাঁকা কাঁধে সেই যে বের হয় মোখলেস, ফিরতে ফিরতে বিকেল গড়িয়ে যায়, কোনো কোনোদিন রাত নামে গ্রামে। এসেই মেয়েকে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে তোলে সে। আলেয়া এত রাগ করে, বকে, তবু মোখলেস নির্বিকার, নিরুদ্বেগ। মা নবীরন নেসা মাঝে মাঝে রাগ করে বলেন, লাগে য্যান আমি তোর সৎ মা রে মোখলেস, অহন নিজের মা পাইছস তুই! আমারে অহন আর চিনোসই না মুটে!

উপায়ন্তর না পেয়ে মোখলেস শেষে বলে, আইচ্চা ঠিক আছে মা। তরে লইয়া যাইয়াম। অহন তুই খাওন-দাওন সাইরা ঘুম যাছে।

শুনে মোখলেস হাসে। বলে, কী যে কস তুই, মা! এই মাইয়া হইছে আমার দিলের একহান টুকরা! এরে লইয়া কুনু কতা কইস না তরা। এরে আমি চউক্ষের আড়াল করতে চাই না মুটেও। শুনে বাড়িসুদ্ধ মানুষ হাসে। মেয়েকে অত ভালোবাসতে নেই, কষ্ট বাড়ে, বাড়ে যন্ত্রণা, বলেন মুরুব্বিরা। মোখলেস থোড়াই কেয়ার করে সেসবে। সে নিজের মনে থাকে। অতি ভোরে বেরিয়ে পড়ে খালি ঝাঁকা নিয়ে। গাঁয়ের জনহীন পথে সাতসকালে বেরিয়ে ভাগ্যের চাবি খুঁজে ফেরে সে। আশেপাশের সব পাড়া-গাঁ ঘুরে ঘুরে দেশি মুরগি সংগ্রহ করে সারা সকাল। তারপর বাড়ি ফিরে স্নান সেরে, নাকে-মুখে দুটো গুঁজে আবার বেরিয়ে পড়ে গঞ্জের পথে। সারাদিন গঞ্জের হাটে মুরগি বেচে মোখলেস, সাঁঝনাগাদ ফিরে আসে বাড়িতে। তার সংসারে অভাব আছে বটে, তবে অ-সুখ নেই। সুদিনের অপেক্ষা করে সে, অপেক্ষা করে অভাব নামক দৈত্যটাকে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া জাদুর কাঠিটা হস্তগত করার। আলেয়া তার ভালো বউ, শ্বাশুড়ি নবীরন নেসার সঙ্গে তার পড়ন-পড়তা ভালো, অভাবের সংসারে আন-আন খাই-খাই ভাব নেই তার স্বভাবে। মোখলেসের গলায় পাঁড়া দিয়ে নিজের শখ মেটানোর খাসলত একদমই নেই। সেদিক দিয়ে নিজেকে দারুণ সুখি ভাবে মোখলেস। অহেতুক অ-সুখ তাকে পীড়িত করে না নিত্যদিন। কিন্তু কদিন যাবৎ উটকো এক ঝামেলা এসে আছড়ে পড়েছে তার দারুণ ছন্দিত সংসারের পেলব শরীরে। খানিকটা ছন্দপতন ঘটেছে তার চেনা সুরে। মোখলেসের বন্ধু হবিবর ঢাকায় গার্মেন্টসে চাকরি করে, সে সম্প্রতি বিয়ে করেছে নিজের পছন্দে। কদিন যাবৎ দিনের মধ্যে তিনবেলা ফোন করে সে মোখলেসের গৎবাঁধা, মাপা জীবনে হালকা ঢেউ তুলেছে ব্যস্ততার। হবিবরের বাড়ির কেউ বউকে মেনে নেবে না, সাফ জানিয়ে দিয়েছে। বউ নিয়ে হবি পড়েছে মহাফ্যাসাদে। ঢাকায় বউ নিয়ে আপাতত তার থাকার জো নেই, কারণ বউয়ের বাপের বাড়ির লোক নাকি পাত্তা পেলেই বগলদাবা করে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে আটকে দেবে তাদের মেয়েকে, ইহজন্মে হবির আর বউয়ের মুখদর্শনের সুযোগ হবে না। এমন উভয়সংকট অবস্থায় অতঃপর বন্ধুর শরণ নিয়েছে হবি। মোখলেসকে সে বলেছে, দোস্ত, আমারে তুই বাঁচাছে!

মোখলেস ভেবে পায়নি এমন সংকটে সে কী করে পরিত্রাতা হতে পারে! তার কি আর অত সাধ্যি আছে! সে বড়জোর একদঙ্গল সোনালি মুরগির মধ্য থেকে খুঁজে-পেতে একটা দেশি মুরগি বের করার সক্ষমতা রাখে। এমন অন্ধকারে থেকে হবিই পরিত্রাণ দেয়। বলে, দোস্ত, আমার বউডারে কয়দিন তর বাইত লুকায়া রাখছে, ভাবির লগে থাহক কয়ডা দিন। এইদিকে পরিস্থিতি শান্ত হইলে আমি তারে আমার কাছে নিয়া আয়ামনে আবার।

শুনে হো হো হাসে মোখলেস। বন্ধুর সঙ্গে আদিম রসিকতার এই মোক্ষম সুযোগ সে লুফে নেয় অনায়াসে। হবিও হাসে। বলে, শালা! বদমাইসি করস আমার লগে! অহন আমার হাছাহাছিই বিপদ রে দোস্ত! আমারে তুই এই বিপদেত্থন বাঁচাছে!
মোখলেস আশস্ত করে বন্ধুকে, নির্ভার করে। বলে, চিন্তা না করছযে দোস্ত। তর বউরে আমার ধারে পাঠায়া দেগাছে। আলেয়া তারে যত্নেই রাখব, ভাবিস নাছে।
—না রে দোস্ত। অরে একলা যাইতে দেওন যাইতো না, তুই আইসা অরে নিয়া যা লগে কইরা। তরার লগে থাকলে অয় বিনাডরে থাকব, সেইডা আমি জানি।

অগত্যা রাজি হয় মোখলেস। ঢাকায় যাবে সে। নিয়ে আসবে হবির বউকে। কিন্তু যাব বললেই যাওয়া যায় না, ফুরসত মেলে না, মওকা জোটে না। তার দিন আনি দিন খাই ব্যবসা। একবেলার জন্য ব্যবসা ফেলে গেলেই রোজগার বন্ধ, ঘরে অভাবের হামাগুড়ি। তবু সেটাও মানিয়ে নিতে রাজি হল মোখলেস। কিন্তু সামনে নির্বাচন। যে-কোনো পরিস্থিতিতে নির্বাচন করতে সরকার বদ্ধপরিকর। ওদিকে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি বর্তমান সরকার না মানায় নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে বিরোধীদল। তারা হরতাল ডাকছে দুদিন পর পর। হরতালে বাস বন্ধ। বাসযাত্রা নিরাপদও না এ সময়ে। যখন-তখন বাসে আগুন দেওয়ার আতঙ্ক, ককটেল বিস্ফোরণের ভয়। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য জনগণকে জিম্মি করে কোন অধিকার আদায় করতে চায় বিরোধীদল, কে জানে বাপু! মোখলেসের মোটা মাথায় রাজনীতির মতো কঠিন ব্যাপার ঢোকে না। সে শুধু চায় সারাদিন পরিশ্রম করে দুবেলা দুমুঠো অন্নের সংস্থান করতে, নিরাপদে কাজে যেতে আর কাজ থেকে ফিরতে। রাজনৈতিক ব্যাপার নিয়ে তার মাথাব্যথা নাই। ওসব রাজনীতিবীদেরাই বুঝুক বাপু! সে শুধু জানে, যে যায় লঙ্কায়, সে-ই হয় রাবণ। আর রাবণ হওয়ার জন্যই তো এতসব তালবাহানা বিরোধীদলের! ক্ষমতায় গেলেই আবার যেই লাউ সেই কদু। নিজেদের আখের গোছানোর কারসাজিতে মেতে ওঠা পুনরায়। ক্ষমতার দাপটে পুনরায় অন্ধ হয়ে ওঠা। এসব মোখলেসদের মতো প্রান্তিক শ্রেণির মানুষ বুঝে গেছে ঢের আগে, তাই তারা আর মাথা ঘামায় না এসব নিয়ে। গ্রামে অবশ্য এসব হরতাল ফরতাল নিয়ে বিশেষ তোলপাড় নাই। কোনো হাউকাউও নেই এসব নিয়ে। শহরেই যত হুজ্জত। কখন কোন বিপদ আসে তার ঠিক কী! তবু বাসযাত্রাটাই অধিকতর সুবিধাজনক তার জন্য। তাতে দিনে দিনে ফিরে পরদিনই আবার লেগে পড়া যায় ব্যবসায়। কিন্তু সে আশার গুড়েবালি আপাতত। হরতালে বাস বন্ধ। অগত্যা ট্রেনের টিকেটই করে নিরুপায় মোখলেস, মনে মনে স্বস্তির বড় একটা শ্বাসও ছাড়ে সে। আর যাই হোক, ট্রেন জার্নিটা নিরাপদ। হরতালেও দিব্যি চলে। আগুন টাগুন দেওয়ার ভয় নেই অন্তত। কিন্তু টুম্পাটা ছাড়তে চায় না মোটেই। সেঁটে থাকে আঠার মতো। সেই যে মোখলেস ঢাকা যাবে শুনেছে মেয়ে, সেই থেকে বায়না জুড়েছে, বাপের সঙ্গে ঢাকায় যাবে সে। কারো কোনো কথা আমলেই নিচ্ছে না টুম্পা। আলেয়া যতই বোঝায় ততই বেঁকে বসে মেয়ে, ততই জিদ বাড়ে তার। তার এক গোঁ, বাপের সঙ্গে ট্রেনে চড়ে ঢাকায় যাবে।

দিনশেষে ক্লান্ত, অবসন্ন মোখলেস খালি ঝাঁকা কাঁধে বাড়ি ফেরে ধীরে। তখন সন্ধ্যা নামে ঝুপ করে। শীতের বেলা হুট করে পড়ে গিয়ে দ্রুত সন্ধ্যা নামায়। ঘন অন্ধকারে মুখ ঢেকে কুয়াশার চাদর জড়িয়ে নেয় রাত্রির শরীর। আলেয়া এ সময়ে হাঁস-মুরগি ঘরে তোলায়, রান্না-বান্নায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে খুব। মেয়ের দিকে তার নজর দেওয়ার ফুরসত মেলে না এ বেলা। মেয়েও এ সময় নবীরন বানুর কোলের মধ্যে ঢুকে রূপকথার গল্পে বুঁদ হয়ে থাকে। আজ মোখলেস ফিরতেই আলেয়া রান্নাঘর থেকে মুখ বাড়িয়ে দেখে একনজর। উঠোনে জ্বলা নিয়ন লাইটের আলোয় উঠোনটা স্পষ্ট চোখে ভাসে। জারুলের ছায়া নিয়নের আলো ভেদ করে উঠোনময় দারুণ স্বপ্ন এঁকে চলে কুয়াশা মাড়িয়ে। সেই স্বপ্নের শরীর ডিঙিয়ে দাদির কোল থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসে মেয়ে। এসেই মোখলেসকে জড়িয়ে ধরে বায়না জোরে, বাপের সঙ্গে সে ঢাকায় যাবেই যাবে। মোখলেস যত তাকে ভুলিয়ে রাখতে চায়, মেয়ে ততই বেপরোয়া হয়ে ওঠে, ততই চড়া হয় তার ইচ্ছের সুর। উপায়ন্তর না পেয়ে মোখলেস শেষে বলে, আইচ্চা ঠিক আছে মা। তরে লইয়া যাইয়াম। অহন তুই খাওন-দাওন সাইরা ঘুম যাছে। আমি তো রাইতে যাইয়াম, তরে লইয়া যাইয়ামনে তহন।

টুম্পার হাতে হাত রেখে সে নিশ্চিন্তে উড়াল দেয় ভোরের আকাশে। আকাশ তখন ঘন কুয়াশায় ঢাকা। ভোরের আলো সে কুয়াশা ভেদ করে ম্লানমুখে তাকিয়ে থাকে ট্রেনের জ্বলতে থাকা বগিগুলোর দিকে।

রাতে ভুলিয়ে ভালিয়ে মেয়েকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয় সে। আলেয়া অনুযোগের সুরে বলে, মাইয়াডারে মিছা বইলা ডাহায় যাইবার লাগছুইন, মাইয়া তো ঘুম ভাইঙ্গাই খুঁজব আফনেরে! কাইন্দা বাড়ি মাথায় কইরা হালাইব! তারে কেমনে সামলাইয়াম আমি তহন, কইনছে?
—ভুলাইয়া-ভালাইয়া দিনডা কুনোমতো রাইখছে। আমি তো রাইতের ট্রেনেই ফিরা আইয়াম! একটা দিনের ব্যাফার মুটে!

অতঃপর ঘুমন্ত মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে, আলেয়ার পেটে মাথা রেখে আগত প্রাণটাকে অনুভব করে, নিজের বাপ-মাকে সাবধানে থাকার ছবক দিয়ে বিদায় নেয় মোখলেস। শীতে ঠকঠক কাঁপতে কাঁপতে স্টেশনের দিকে এগোয় অগত্যা। জমানো কিছু টাকা নেয় সঙ্গোপনে। বড্ড শীত পড়েছে এবার। টুম্পার জন্য লাল টুকটুকে একটা সোয়েটার কিনবে সে, বুড়ো বাপ-মায়ের জন্য বঙ্গবাজারের পুরোনো কাপড়ের দোকান থেকে পছন্দসই দুটো উলের চাদর কিনবে, আলেয়ার জন্য একটা বাহারি শাল আর আসছে পুঁচকেটার জন্য কিছু কাপড়চোপড় কিনবে। নিজের জন্য কিছু কিনবে না মোখলেস। নবাবী করার মতো পয়সা নাই তার। সংসারে তার একলা উপার্জনে অভাব চোখ রাঙায় নিত্যদিন। নিজের জন্য কিছু কিনে নষ্ট করার মতো পয়সা কোথায় তার! এই যে ঢাকায় যাচ্ছে সে, যেতে আসতেই কতগুলো থোক টাকা বেরিয়ে যাবে গাঁট থেকে। আর হবি বন্ধু মানুষ, যতই অভাব থাকুক মোখলেসের, হবির বউয়ের আসার ভাড়া তো তাকেই গুনতে হবে, কতদিন থাকবে হবির বউ সেটাও অনির্ধারিত, তাতেও পয়সা যাবে বিস্তর, সেসব খরচ কি আর নেওয়া যাবে বন্ধুর কাছ থেকে! কাজেই হিসেব করে চলতে হবে মোখলেসকে। ট্রেনে বসে এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে দুলুনিতে ঘুম পেয়ে যায় তার। মাথার কাছের কাচের জানালাটা খানিকটা ভাঙা। হু হু হাওয়া আসে। ঠাণ্ডা। মাথায় মাফলার পেঁচিয়ে গায়ে চাদরটা ভালোমতো জড়িয়ে সিটে পা তুলে গুটিসুটি বসে ঘুমোনোর চেষ্টা করে মোখলেস। টুম্পার মুখটা চোখে ভাসে। ঘুম ঘুম অবস্থায় মোখলেসের মনে হয়, অভিমানী মেয়েটা তার দিকে তাকিয়ে ছলছল চোখে চেয়ে থাকে। ঠোঁট ফুলিয়ে বলে, আমারে তুমি নিলাই না বাজান লগে? নিবা কইয়া আমারে ফালাইয়া চইলা গেলা? মিছা কইলা আমারে?

মোখলেস ঘুমে ঢুলুঢুলু হয়ে জড়ানো গলায় বলে, তরার সক্কলডিরে নিয়া ঢাকা শহরত বেড়ায়াম মা! আর কয়ডা দিন যাউক, তরার বেবাকরে নিয়া ঢাকা শহরত বেড়ায়াম।

হঠাৎ কেমন গরম লাগে মোখলেসের। জানালা দিয়ে উড়ে আসা ঠান্ডা হাওয়া সে গরম তাড়াতে পারে না। তীব্র ঝাঁকুনি লাগে ট্রেনে। ঘুমের মধ্যে সহসা তীব্র একঝলক আলো এসে চোখে লাগে তার। লকলকে আগুনে ঝলসে যায় তার শরীর। হরতাল সফল করতে ট্রেনে আগুন দিয়েছে কেউ। ধোঁয়ায় ছেয়ে গেছে পুরো বগি। যে যেভাবে পারছে নামার চেষ্টা করছে দ্রুত। এক মা তার শিশু সন্তানকে বুকে জড়িয়ে নামতে গিয়ে ধোঁয়ার কুণ্ডলির মধ্যে পাক খেয়ে পড়ে যায়। তাদের দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে মোখলেস। আগুনের দাউদাউ শিখা দ্রুত গিলে ফেলে তাকে। সে অবাক হয়ে দেখে টুম্পা দুহাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসছে তার দিকে। হাত বাড়িয়ে দেয় মোখলেস। টুম্পার হাতে হাত রেখে সে নিশ্চিন্তে উড়াল দেয় ভোরের আকাশে। আকাশ তখন ঘন কুয়াশায় ঢাকা। ভোরের আলো সে কুয়াশা ভেদ করে ম্লানমুখে তাকিয়ে থাকে ট্রেনের জ্বলতে থাকা বগিগুলোর দিকে।