গন্তব্যের দিকে


এ-গল্প মায়াঘন এক গোধূলির। ডানপাশে সবুজ চর, বামপাশে প্রবহমান প্রশস্ত নদীর। নদীর ভেতর সূর্যটা গড়াচ্ছে আগুনের বলের মতো। ঢেউয়ের দোলায় ভেঙে ভেঙে স্নিগ্ধ আলোকের বিকিরণ ঘটাচ্ছে চারপাশে। গোধূলির নরম আলোতে কারও চোখ ঝলসে ওঠে না। বিরক্তির উদ্রেকও ঘটায় না কারও মনে। এভাবেই, পৃথিবীতে দিনের শেষ মায়া জাগিয়ে সূর্যটা তার গন্তব্যে চলে যায়। রূপমের মনে হয়, সারাদিনের সমস্ত আনন্দ-বেদনা নিয়ে ক্লান্ত সূর্যটা বিশ্রামে যায়। যেমন সে-ও মাঝে মধ্যে এখানে আসে সারাদিনের ক্লান্তি মুছে ফেলতে। চরের সবুজ ঘাসের ওপর বসে অপলক তাকিয়ে থাকে দিনের শেষ অঙ্কে। নদীপারের সবুজ ঘাসের সঙ্গেই যেন তার আমরণ সখ্য! রূপম একদিন এমনই সখ্য মেনেছিল তিতলিকে। নামটি মনে পড়লে, অন্ধকারে হারিয়ে যায় সে। ঘুটঘুটে, তীব্র সেই আঁধার। আজও রূপমকে খুঁচিয়ে আহত করে গুরুগম্ভীর সেই হর্ষনাদ-‘বিশ্বাস করেছিলাম, অথচ…’। বাক্যটি শেষ হওয়ার আগেই চলমান দৃশ্যের ওপর পর্দা নেমে গিয়েছিল। সেদিন রূপমকে ওরকম একটা পরীক্ষার মুখে ঠেলে দেয়ার কী প্রয়োজন ছিল? এ প্রশ্নের উত্তর আজও মেলেনি। মিলবে, এমন প্রত্যাশা আছে বলেও মনে করে না সে। একে অপরের ১০০% নিখুঁত জুটি থাকা সত্ত্বেও ‘বিশ্বাসের শক্তি’ জানা তাদের কারও পক্ষে এখন আর সম্ভব নয়, যখন অযাচিত দৃশ্যে বন্দি হয়ে আছে দু’জন! নিয়তির উন্মাতাল ঢেউ এসে শূন্যে ছুঁড়ে দিয়েছে তাদের, বলতে গেলে নির্দয়ভাবে। তিতলির ভাবনা গ্রাস করলে রূপম বুঝতে পারে, তার মাথার ভেতরের পুরোটাই ফাঁকা।

0২.
নীলক্ষেতের ফুটপাথে সারি সারি বইয়ের দোকানে চোখ আটকে যায় তিতলির। বিশেষ করে রশিদের ‘বিউটি বুক শপ’ তাকে খুব টানে। কোচিং শেষ করে এ পথেই তাকে টিউশনে যেতে হয়। পড়ার নেশা তীব্র। সহপাঠীরা যেখানে ফেসবুক, ইনস্ট্রগ্রাম, টুইটার নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মশগুল; তিতলির পড়ার অভ্যেসটা সেখানে ঈর্ষণীয়। পছন্দমতো বই কেনাও রুটিনের মধ্যে। বই সংগ্রহ শুধু বুকসেলফের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্যই নয়, তিতলি মনে করে, মেনেও চলে। নিজেকে পাঠে ব্যস্ত রাখে। পাঠ্যবইয়ের বাইরে তার চিন্তাজগৎ সৃজনশীলতার সন্ধানে ব্যাপ্ত। বই কেনা হোক বা না হোক, রশিদের দোকানে প্রায়ই সে থামে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে বই দেখে। আজও শরতের ঠাঁ ঠাঁ রোদ মাথায় নিয়ে রশিদের দোকানের সামনে দাঁড়ায়। রশিদ মামা হেসে বলেন-
– আজও কবিতার বই নেবেন?
– হ্যাঁ মামা, কেন বলেন তো!
– সব সময় নেন, তাই…
– নতুন বই এসেছে?

দোকানি তার সংরক্ষিত ব্যাগ থেকে একটি বই বের করে তিতলির হাতে দিয়ে বলেন,  চারদিন ধরে লুকায়া রাখছি। ভাবছি আপনি আইলে দিমু। কিন্তু আসেন নাই।

রশিদ মামার কাস্টমার প্রীতি দেখে তিতলি বেশ খুশি হয়, তবে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে না। মৃদু হেসে বইটা হাতে নিয়ে উল্টে-পাল্টে দেখে। বইটির নাম ‘সব দুঃখ দুঃখ নয়’, লেখকের নাম হিসেবে রূপম আদিত্য মুদ্রিত। তিতলির অভ্যেস বই হাতে নিয়ে প্রথমেই লেখক পরিচিতি অংশে চোখ বুলানো। সে দেখে আর ভাবে, এই নামে কোনও কবির কবিতা আগে তার পড়া হয়নি। সে কিছুটা উৎসাহী হয়। পাতা উল্টিয়ে তার চোখ গিয়ে থামে ‘অনুরাগ যতটুকু পোড়ায়/ তারও অধিক জ্বলেছি শ্রাবণে/ কিছু ছিল ঐশ্বর্যকাতর/ বাকিটুকু সন্ধ্যার চুম্বনে’ উৎসর্গপত্রে। কাব্যময় লেখাটুকু তিতলিকে টানে। সে ভাবে, নাম না জানা অনেক কবির কবিতাও ভালো হতে পারে। তা ছাড়া কতজনের কবিতাই বা পড়া যায়!

মৃতদেহ উদ্ধারে গিয়ে একটি চিরকূট পেয়েছে পুলিশ। তাতে লেখা-‘গন্তব্যের দিকে’।

তিতলি দোকানি মামার প্রশংসা করবে কিনা ভেবে পায় না। তবে রশিদ মামা যে কবিতা পছন্দ করে, সে ব্যাপারে তার সন্দেহ নেই। এই পথে টিউশনে যাওয়ার সময় বার কয়েক রশিদের হাতে জীবনানন্দের কবিতা সমগ্র দেখেছে সে। একদিন জিজ্ঞেসও করেছে, কোন কবির কবিতা ভালো লাগে। রশিদের স্পষ্ট উত্তর ছিল, ‘জীবনানন্দীয় ঘোর অতিক্রম করা সহজ না’। দোকানি হলেও তিনি একজন দীক্ষিত পাঠক। আর নিবিষ্ট পাঠক পেলে তিতলিরও ভালো লাগে। শ্রদ্ধায় নুয়ে আসে তার সত্তা। এখন রশিদ মামার বক্তব্যের সপক্ষের প্রমাণ তিতলির হাতে। ‘সব দুঃখ দুঃখ নয়’ কবিতাগ্রন্থটির দাম মিটিয়ে সে রশিদ মামার উদ্দেশে মৃদু স্বরে থ্যাংকস উচ্চারণ করে কাঁটাবন মোড়ের পথে পা বাড়ায়।

0৩.
রাজধানীর সারি সারি অট্টালিকার ফাঁক-ফোকরের সরু রাস্তা বেয়ে, কাজ শেষে প্রতিদিন সন্ধ্যার আগে হোস্টেলে ফিরে আসে তিতলি। গ্রামের দুরন্ত মেয়েটি ঢাকায় লেখাপড়া করতে এসে নিয়মের বেড়াজালে বন্দি এখন। প্রকৃতি টানলেও বের হওয়ার অবসর নেই। একদিকে পিতা-মাতার দায়িত্ব; অন্যদিকে নিজের লেখাপড়া আর ভবিষ্যৎ জীবনের কথা ভাবতে গেলে অযথা সময় নষ্ট করার কোনো মানেই হয় না। তিতলি মনকে সান্ত্বনা দেয়। সে রুটিন ওয়ার্ক শেষে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে টেবিল থেকে ‘সব দুঃখ দুঃখ নয়’ টেনে নেয়। তারপর পাঠ করতে থাকে।

বইয়ের কবিতাগুলো তিতলির মননে সঞ্চারিত হয়। সে ভাবে, নেতিবাচকতা জীবনেরই অংশ, তাই বলে হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। যদিও চারিপাশের নানান অসঙ্গতির মধ্যে তার ইতিবাচক ভাবনা প্রশংসনীয়, সহপাঠীরা প্রায়ই বলে এই কথা। বইয়ের কবিতা-ভাবনার সঙ্গে যেন সে তার জীবনের সাযুজ্য খুঁজে পায়। কবিতাগুলো যেন তার জন্যই লেখা! লেখকের সঙ্গে বিষয়টি শেয়ার করবে কিনা, এক মিনিট ভাবনার পরই বইয়ের ব্লার্ব থেকে ফোন নাম্বার নিয়ে কল করে। রূপমের সঙ্গে সম্পর্কের সে-ই শুরু, আর পেছনে সরে আসা হয়নি। তিতলি হয়তো সরে আসতে চায়নি। অনেক কিছুই হতে পারে। তারপর পেরিয়ে গেছে তিনটি বছর। এতদিনে একে অন্যকে ধারণ এবং লালন করেছে। প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসে এগিয়ে গেছে জীবনের পথে। সত্য ও সুন্দরের প্রার্থনায়, মার্জিত মননে।

০৪.
অধ্যবসায়, বন্ধুত্ব আর কবিতার রথে চেপে রূপম ও তিতলি যখন আগামীর স্বপ্নে বিভোর; তখনই বিনামেঘে বজ্রাঘাতের মতো দানবীয় এক ছোবল নেমে আসে তাদের জীবনে। বৈশাখী আয়োজনে হাজারও মানুষের মতো তারাও ছিল দর্শক। প্রচণ্ড দাবদাহে ছিল পিপাসার্ত। তারা সিদ্ধান্ত নেয়, অনুষ্ঠান থেকে বেরিয়ে তারা হাজির হবে রাজধানীর অদূরে সেই নদীটির কাছে। দু’চোখ ভরে উপভোগ করবে নদীর সৌন্দর্য, যে-নদী রূপমের কবিতায় নানান রূপে, নানান ব্যঞ্জনায় উদ্ভাসিত। চেয়েছে নদীর কাছে জীবনের গল্প বলে নির্ভার হতে। এক সময় তারা পৌঁছে যায় নদীপারের সবুজ ঘাসের গালিচায়।

সূর্যটা তখন অস্ত যেতে শুরু করেছে। প্রকৃতিজুড়ে গোধূলির নরম আলো। স্নিগ্ধ আলোক ছড়ানো সূর্যের গন্তব্যের দিকে চোখ রাখে তারা। সন্ধ্যায় ঘরে ফেরা পাখিদের ওড়াউড়ি দেখে আর তাদের কলকাকলি শুনতে শুনতে হারিয়ে যায় অন্য কোনো পৃথিবীতে। প্রকৃতিই তো মানুষের প্রকৃত শিক্ষক! রূপমের অভিব্যক্তি ও বোধের ওপর আরও আস্থাশীল হয়ে পড়ে তিতলি। তারা মুখোমুখী দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। এভাবে প্রকৃতিতে মুখচেনা আঁধার নেমে আসতেই তাদের ঘিরে ধরে কয়েকজন যুবক।

‘নষ্টামি করতে আইছোস খানকির পুত’-অশালীন বাক্য উদগীরণের সঙ্গে সঙ্গেই রূপমের কানপেঁচিয়ে কেউ একজন সজোরে থাপ্পর দেয়। প্রচণ্ড আঘাতে রূপম কয়েক মিনিট বধির হয়ে পড়ে। নদী থেকে সূর্যটা যেন রূপমের চোখের ভেতর উঠে আসে! ধীরে ধীরে সে তলিয়ে যেতে থাকে।
যুবকদের মধ্যে কেউ একজন তিতলির উদ্দেশে বলে- ‘ওর লগে তোর কী! ওই পুলাই তো তার জীবন থাইকা তোরে সরাইতে কল কইরা আনছে। বোঝোস নাই মাগি!’

রূপম অস্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে, তিতলি বলছে-‘বিশ্বাস করেছিলাম, অথচ…’। রূপম তলিয়ে যাচ্ছে, বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে, সরে যাচ্ছে অন্য কোনো ঘুমের দেশে।

জ্ঞান ফিরে এলে রূপম শুনতে পায় চারিপাশে ঝিঁঝির একটানা শব্দ। গভীর রাত। মোবাইলের আলো জ্বেলে সে আশেপাশে কোথাও তিতলিকে খুঁজে পায় না। সে কল করে তিতলিকে। কিন্তু তার ফোন বন্ধ। প্রবল এক আর্তনাদে ডুবে যায় রূপম। সে কখন বাসায় ফিরেছিল, তা এখন আর মনে পড়ে না। পরদিন সে খবরের কাগজে দেখেছিল, হোস্টেলে ফ্যানের সঙ্গে ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছে তিতলি। মৃতদেহ উদ্ধারে গিয়ে একটি চিরকূট পেয়েছে পুলিশ। তাতে লেখা-‘গন্তব্যের দিকে’।