সাহিত্য সমালোচনায় সাহিত্যতত্ত্ব ও দর্শন


সাহিত্য সমালোচনা একটি জটিল ও গভীর শৈল্পিক পদ্ধতি, যা সাহিত্যকর্মের মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে তাদের প্রকৃত গভীরতা ও তাৎপর্য উদ্ঘাটন করে। সাহিত্য সমালোচনার ভেতরকার এই যাত্রায় দুটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি হলো সাহিত্যতত্ত্ব ও দর্শন। সাহিত্যতত্ত্ব যখন একটি সাহিত্যকর্মের গঠন, ভাষা, রূপ এবং শৈলীর ওপর নির্ভর করে তার অর্থ ও প্রভাব বিশ্লেষণ করে, তখন দর্শন সাহিত্যকর্মের গভীরতর অর্থ, নৈতিকতা, মানব অস্তিত্ব এবং সমাজের সঙ্গে এর সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন তোলে। দর্শন ও সাহিত্যতত্ত্বের সম্মিলন সাহিত্যের গভীরতর দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে। যখন আমরা একটি সাহিত্যকর্মকে বিশ্লেষণ করি, তখন আমরা কেবল তার পৃষ্ঠতলের সৌন্দর্য ও বিনোদনমূলক দিকগুলো বিবেচনা করি না, বরং তার ভেতরকার গভীরতা, মানব অভিজ্ঞতা এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটেরও অনুসন্ধান করি। দর্শন আমাদের সাহিত্যকর্মের মধ্যে লুকানো সত্য, জীবনের উদ্দেশ্য এবং মানবতার জটিলতার বিষয়ে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে। এভাবে, সাহিত্য সমালোচনায় সাহিত্যতত্ত্ব ও দর্শনের সম্মিলিত প্রয়োগ পাঠক এবং সমালোচকদের জন্য নতুন দৃষ্টিভঙ্গি উন্মোচিত করে, যা কেবল সাহিত্যকর্মের প্রকৃত মর্মার্থ উদ্ঘাটনেই সহায়ক নয়, বরং তাদের জীবনের বৃহত্তর প্রশ্নগুলোর সন্ধানে পথপ্রদর্শক হয়।

সাহিত্য কী
সাহিত্য সমাজের খুব গুরুত্বপূণ একট অংশ। মানব অভিজ্ঞতা, আবেগ, চিন্তা এবং কল্পনাকে শিল্পসম্মত ও সৃজনশীল উপায়ে ভাষায় প্রকাশ করার নামই সাহিত্য। সাহিত্য গল্প, কবিতা, নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধ এবং অন্যান্য রচনার মাধ্যমে মানুষের মনন, সমাজ এবং সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক তুলে ধরে। শৈল্পিকতা ও সৃজনশীলতা, সাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য; যা লেখক-পাঠককে নতুন করে চিন্তা করতে, অনুভব করতে, ‌অনুভূতির গভীরে প্রবেশ করতে এবং কল্পনা করতে উদ্বুদ্ধ করে। সেই সাহিত্যের সঙ্গে সমালোচনা নিবিড়ভাবে জড়িত। সাহিত্য বা কাব্যবিচারে রস আসে হৃদয় থেকে। আর সমালোচনা আসে মস্তিষ্ক থেকে। সমালোচকরা সাহিত্যের সেই রস আস্বাদনের মাধ্যমেই সাহিত্যে উৎকর্ষ বা অপকর্ষ বিচারমূলক আলোচনায় সমালোচনা করেন। যে কেউ একটি বই সম্পর্কে বা কারও লেখা সম্পর্কে নিজের দৃঢ় অনুভূতি বা অভিমত প্রকাশ করতে পারেন। যেমন, তার লেখা বা বইটি চমৎকার লেগেছে কিংবা বিরক্তিকর বা সম্পূর্ণরূপে অরুচিকর মনে হয়েছে। তবে, এই অভিমত অনুভূতিগুলোকে প্রমাণ করা এবং মূল্যায়ন করা হলো সাহিত্য সমালোচনার কাজ।

সাহিত্য সমালোচনা কী
সাহিত্য সমালোচনা অর্থাৎ Literary Criticism হলো সাহিত্যকর্মের অধ্যয়ন, মূল্যায়ন এবং ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের একটি প্রক্রিয়া, যা সাহিত্যকর্মের বিভিন্ন দিক, যেমন, বিষয়বস্তু, কাঠামো, ভাষা, চরিত্রায়ণ এবং কাহিনিকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে তার মান, উদ্দেশ্য ও প্রভাব সম্পর্কে ধারণা বা সিদ্ধান্ত দেয়। সাহিত্য সমালোচনার উদ্দেশ্য হলো লেখকের কাজের সারসংক্ষেপ আরও ভালোভাবে বোঝা, সাহিত্যকর্মের মান, সৌন্দর্য এবং শৈল্পিকতার মূল্যায়ন করা, বিশ্লেষণের মাধ্যমে সাহিত্যকর্মের বিভিন্ন উপাদান ও দিকগুলোর গভীরভাবে পরীক্ষা করা, সাহিত্যকর্মের ভুলত্রুটি, সঠিকতা, প্রাসঙ্গিকতা এবং সামাজিক বা নৈতিক দিকগুলো বিশ্লেষণ করা, কোনো একটি নির্দিষ্ট সাহিত্যকর্মকে বিভিন্ন সাহিত্যকর্মের মধ্যে তুলনা করে তাদের বৈশিষ্ট্য এবং গুরুত্ব নির্ধারণ করা যা পাঠকদের একটি সমৃদ্ধ ও গভীর পাঠের অভিজ্ঞতা প্রদান করা। সাহিত্য সমালোচনা সাহিত্যকে বিশ্লেষণ করার জন্য একটি বিস্তৃত দার্শনিক কাঠামো প্রদান করে এবং লেখক ও পাঠকদের লেখকের কাজ বোঝার জন্য নতুন উপায় সরবরাহ করে। একজন ভালো সমালোচক অন্তত কী নিয়ে সমালোচনা করছেন এবং কেন করছেন, তা তিনি জানেন। যে কোনো লেখাকে একটি নিবিড় পাঠ দেওয়ার পরে, একজন ভালো সমালোচক একটি বিস্তৃত সাহিত্য বিশ্লেষণ তৈরি করতে পারেন যা পাঠ্য সম্পর্কে অন্য পাঠককেও বোঝার বিষয়ে অবহিত করতে পারে।

এভাবেই অ্যারিস্টটল সাহিত্যকে তৃপ্তিদায়ক করে তোলেন এবং মানুষের আবেগকে প্রদাহের পরিবর্তে নিয়ন্ত্রিত হিসাবে চিত্রিত করতে সফল হন।

যেহেতু, সমালোচনা একটি বিষয় বা ধারণাকে সমর্থন বা বিরোধিতা করার জন্য নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি, পর্যবেক্ষণ, যুক্তি, প্রমাণ ও উদাহরণ অন্তর্ভুক্ত করে, তাই সাহিত্য সমালোচনা একটি প্লট বা লেখার সংক্ষিপ্তসার হওয়াই উপযুক্ত হতে পারে; লেখকের জীবনী, বা সাহিত্যের সঙ্গে ব্যক্তির ত্রুটি খুঁজে বের করা নয়। কবি, প্রাবন্ধিক, প্রকাশক, নাট্যকার, সাহিত্য সমালোচক টি.এস. এলিয়ট, এরিস্টটলকেই ‘নিখুঁত সমালোচক’ বলে অভিহিত করেছিলেন। একজন ভালো সমালোচক সম্পর্কে টি.এস. এলিয়ট বলেছিলেন, ‘একজন বস্তুনিষ্ঠ সমালোচক আবেগপ্রবণ হতে পারেন না। তাকে অবশ্যই সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যমূলক হতে হবে। তাকে অবশ্যই তার ব্যক্তিগত কুসংস্কার এবং নিজ ইচ্ছাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করার চেষ্টা করতে হবে। তার অবশ্যই একটি ব্যতিক্রমীভাবে যুক্তিযুক্ততা থাকতে হবে এবং কাঠামোগত নীতিগুলোর ধারণা থাকা উচিত; অস্পষ্ট, গভীর ইমপ্রেশনে খুশি হওয়া উচিত নয়।’

সাহিত্যের উপাদানগুলোর লক্ষ্য, পাঠকদের কাছে নৈতিক গুণাবলির ওপর নির্ভর করার একটি মৌলিক উদ্দেশ্য। তবে, সাহিত্য উপাদান থেকে নৈতিক পাঠের প্রত্যাশা করা সুস্পষ্ট বলে মনে হলেও, সাহিত্যিক উপাদানের সমালোচনা বিশ্লেষণে নেতিবাচক প্রভাবগুলোরও রয়েছে; যা অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। সমালোচনা ইতিবাচক এবং নেতিবাচক উভয় পয়েন্টের মূল্যায়ন করে এবং এটি সাহিত্যের একটি পৃথক অংশ। অন্যদিকে সমালোচক একজন ব্যক্তি, যিনি শিল্পের বিচার বা মূল্যায়ন করেন এবং কখনো কখনো তিনিই এমন একজন ব্যক্তি হয়ে ওঠেন, যিনি শুধু একটি সাহিত্যকর্মের দোষ খুঁজে পেতে পারেন। যেহেতু লেখক হিসাবে আমরা নিজ কাজের সঙ্গে চিহ্নিত হই, তাই আমাদের কোনো লেখা প্রত্যাখ্যান হওয়া মানে মানুষ হিসাবে আমাদের প্রত্যাখ্যান বেধ করি। যেমন ফ্রান্স নোভেলিস্ট গুস্তাভ ফ্লোবেয়া্ বলেছিলেন, “আমরা আমাদের অভ্যন্তরের একটি অংশ পরিবেশন করি কিন্তু সমালোচকরা আমাদের সমগ্রটা দোয়ারুপ করতে, শাস্তি দিতে প্রস্তুত থাকে।”

যাইহোক, সাহিত্য-সমালোচনার গবেষণা, পড়া এবং লেখার কাজগুলোর আমাদের নিজেদের কাজগুলোর সম্পর্কে আরও ভাল ধারণা তৈরি করে। সাহিত্য সম্পর্কে বিচার করতে, বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ধারণাগুলোর অধ্যয়ন করতে এবং একটি সাহিত্যিক কাজ পড়ার যোগ্য কিনা, তা পৃথক স্তরে নির্ধারণ করতে সমালোচনা সহায়তা করে। সাহিত্যের সমালোচনা শুধুমাত্র কোনো একটি কাজকে প্রচার করা নয় কিংবা লেখকদের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর একটি উপায় নয়, এটি আমাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি এবং অভিজ্ঞতাকে প্রয়োগ করার একটি মাধ্যম এবং তথ্য ধারণা ভাগ করার একটি উপায়।

সাহিত্য সমালোচনায় অনেক ধরনের সমালোচনা রয়েছে। যেমন, ঐতিহাসিক-জীবনীমূলক সমালোচনা, নৈতিক-দার্শনিক সমালোচনা, সমাজতাত্ত্বিক সমালোচনা, মনস্তাত্ত্বিক সমালোচনা, ব্যবহারিক সমালোচনা, ফর্মালিজম সমালোচনা, পাঠক-প্রতিক্রিয়া সমালোচনা, নতুন সমালোচনা, পোস্ট-স্ট্রাকচারালিজম সমালোচনা, ডিকনস্ট্রাকশন সমালোচনা, নারীবাদী সমালোচনা… আরো অনেক। সাহিত্য-সমালোচনার চর্চা পাঠকদের সাহিত্যের মাধ্যমে পৃথিবীর সৌন্দর্য ও জটিলতাকে আরও ভালোভাবে বোঝার জায়গা তৈরি করে দিতে পারে।

শুরু থেকে আজকের সাহিত্য সমালোচনা
যদিও প্রায় সমস্ত সমালোচনাই বিংশ শতাব্দী থেকে লেখা হয়েছে, তবে প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলের উত্থাপিত প্রশ্নগুলোর এখনো মৌলিক রয়ে গেছে। সাহিত্য সমালোচনার সূচনা প্রাচীন গ্রিসে খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতাব্দীতে হয়। প্লেটো (৪২৭-৩৪৭ খ্রিস্টপূর্ব) তার “রিপাবলিক” গ্রন্থে কবি এবং সাহিত্য সম্পর্কে তার দর্শন ব্যাখ্যা করেছেন। যেকোন সমালোচক যিনি সাহিত্যের সামাজিক মূল্যকে ন্যায্যতা দিতে চেষ্টা করেছেন তাকে প্যেটোর দ্বারা “দ্য রিপাকলিক” এর পাল্টা যুক্তির মুখোমুখি হতে হয়েছে। একজন মানুষ হিসেবে কবি এবং বিবৃতির রূপ হিসেবে কবিতা উভয়ই প্লেটোর কাছে অবিশ্বস্ত বলে মনে হয়েছিল, যিনি ভৌত ​​জগৎকে অতীন্দ্রিয় ধারণার একটি অপূর্ণ অনুলিপি এবং কবিতাকে অনুলিপির একটি নিছক অনুলিপি হিসাবে চিত্রিত করেছিলেন। প্লেটোর মতে, সাহিত্য কেবল সত্য সন্ধানকারীকে বিভ্রান্ত করতে পারে। তিনি কবিতা এবং শিল্পকে বাস্তবতার অনুকরণ (mimesis) হিসেবে দেখেছেন এবং নৈতিক এবং সামাজিক প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেছেন। প্লেটো বিশ্বাস করতেন যে কবিতা এবং শিল্প সমাজের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে কারণ তারা আবেগকে উত্তেজিত করতে পারে যা যুক্তির উপর ভিত্তি করে নয় বরং অনুভূতির উপর ভিত্তি করে কাজ করে। প্লেটো যদিও কবির ঐশ্বরিক অনুপ্রেরণাকে স্বীকার করেছিলেন, কিন্তু এটিও তার উদ্বেগের কারণ ছিল কারণ তিনি মনে করতেন, একজন মানুষ এতটাই উন্মাদ হয়ে চালিত হতে পারে যা তার লক্ষ্যগুলোরকে দুর্বল করে দিতে পারে।

অন্যদিকে অ্যারিস্টটল (৩৮৪-৩২২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) বাস্তবতার প্রকৃতি সম্পর্কে প্লেটোর কিছু বিশ্বাসকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন কারণ তিনি ভৌত ​​জগতের সাথে বেশি উদ্বিগ্ন ছিলেন। এরিস্টটল, সাহিত্য শিল্পের স্বাভাবিক এবং দরকারী জিনিসগুলোর কী, তার উপর জোর দিয়ে প্লেটোর অভিযোগের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন। সাহিত্যের অধ্যয়নের জন্য তদন্তে অ্যারিস্টটল বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগ করেন এবং কবিতার বিরুদ্ধে প্লেটোর অভিযোগের উত্তর দিয়েছিলেন পোয়েটিক্স নামে পরিচিত বক্তৃতাগুলোরর একটি সিরিজে। সেখানে তিনি কবিতার নৈতিক এবং শিক্ষা মূল্যবোধকে স্বীকার করেছেন এবং কাব্যিক অনুকরণকে মানব অভিজ্ঞতার প্রাকৃতিক এবং মূল্যবান অংশ হিসেবে দেখেছেন। সাহিত্যের বিষয়ে অ্যারিস্টটলের দৃষ্টিভঙ্গি প্লেটোর থেকে ভিন্ন ছিল, তিনি বিশ্বাস করতেন সাহিত্য, বিশেষত ট্র্যাজেডি, সমাজের জন্য শিক্ষাগত এবং ক্যাথার্টিকভাবে উপকারী। এভাবেই অ্যারিস্টটল সাহিত্যকে তৃপ্তিদায়ক করে তোলেন এবং মানুষের আবেগকে প্রদাহের পরিবর্তে নিয়ন্ত্রিত হিসাবে চিত্রিত করতে সফল হন।

প্রাচীন গ্রিসের পর, সাহিত্য সমালোচনার ধারাটি মধ্যযুগে অব্যাহত ছিল এবং রেনেসাঁকালে নবজাগরণের সময় নতুন উদ্যমে বিকশিত হয়। খ্রিস্টীয় মধ্যযুগে প্রায় সমস্ত প্রাচীন সমালোচনামূলক রচনার অন্তর্ধান এবং সাহিত্যিক কল্পনার প্রতি পৌত্তলিক বিরোধী অবিশ্বাসে সমালোচনাকে জর্জরিত করে। মধ্যযুগে, সাহিত্য সমালোচনার মূল ভিত্তি ছিল ধর্মীয় টেক্সট এবং তাদের ব্যাখ্যা। খ্রিস্টীয় পণ্ডিতগণ বাইবেলের ব্যাখ্যা এবং তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে সাহিত্য সমালোচনার চর্চা করতেন। টারটুলিয়ান, অগাস্টিন এবং জেরোমের মতো চার্চ ফাদারদের দ্বারা কবিতার বিরুদ্ধে প্লেটোনিক যুক্তি তখন একটি করণিক আকারে পুনরুজ্জীবিত হয়েছিল। প্রাচীন দেবতা এবং টিকে থাকা ক্ল্যাসিক উভয়ই তাদের মুগ্ধতাকে পুনঃনিশ্চিত করেছিল এবং ধর্মতাত্ত্বিক রূপকগুলোরর আকারে মধ্যযুগীয় সংস্কৃতিতে প্রবেশ করেছিল। ওল্ড টেস্টামেন্ট (খ্রিস্টধর্ম ও ইহুদি ধর্মের ধর্মগ্রন্থগুলোরর একটি সংগ্রহ, যা প্রধানত হিব্রু বাইবেল নামে পরিচিত) এবং প্রাক-খ্রিস্টীয় লেখাগুলোরর কথিতভাবে খ্রিষ্টীয় পদার্থ বিশ্বকোষবিদ এবং পাঠ্য ভাষ্যকারদের দ্বারা স্পষ্ট করা হয়েছিল। সাহিত্যিক চরিত্রগুলোরর যথাযথ ব্যবহার নির্ধারণের জন্য অলঙ্কারবিদরা উপলব্ধ থাকলেও ফ্যাবলিয়াউ এবং শিভ্যালিক রোম্যান্সের মতো উদীয়মান ধারাগুলোর থেকে সমালোচনামূলক নীতিগুলোর বের করার জন্য কোন প্রচেষ্টা করা হয়নি। এমনকি দান্তের মতো ১৪ শতকের একজন আদি স্থানীয় কবিও তার

ডিভাইন কমেডিকে শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যার নিয়ম অনুসারে ব্যাখ্যা করার আশা করেছিলেন বলে মনে করা হয়। ধর্মতত্ত্ব দ্বারা ব্যাখ্যা করা মহাবিশ্বের সঠিক সম্পূর্ণতা সমালোচনাকে বাধা দেয়। রেনেসাঁকালে, সাহিত্য সমালোচনায় মানবতাবাদ এবং ধ্রুপদী সাহিত্যিক মূল্যবোধের পুনরুজ্জীবন ঘটে। এরিস্টটল এবং হোরেসের মতো প্রাচীন গ্রিক এবং রোমান সমালোচকদের কাজগুলোর নতুন আলোকে ধরা পড়ে এবং মূল্যায়ন করা হয়।

আধুনিক যুগের সাহিত্য সমালোচনা বিভিন্ন তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ এবং পদ্ধতির মাধ্যমে সাহিত্যকর্মের বিশ্লেষণ এবং মূল্যায়নকে আরও সমৃদ্ধ করে তোলে। ১৮ ও ১৯ শতকের রোমান্টিক যুগে স্যামুয়েল টেলর কোলরিজ (১৭৭২-১৮৩৪) এবং উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ (১৭৭০-১৮৫০) তাদের “লিরিক্যাল ব্যালাডস্” এবং অন্যান্য রচনায় কবিতার স্বাভাবিক এবং স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ প্রকাশের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেন। রোমান্টিক যুগের সমালোচকরা সাহিত্যকর্মের আত্মপ্রকাশ এবং সৃষ্টিশীলতার মূল্য দেয়। ভিক্টোরিয়ান যুগে ম্যাথিউ আর্নল্ড (১৮২২-১৮৮৮) তার “The Function of Criticism at the Present Time” প্রবন্ধে, সাহিত্যের সামাজিক ভূমিকা এবং সমালোচকের দায়িত্ব নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি সাহিত্য সমালোচনায় সংস্কৃতির গুরুত্ব তুলে ধরেন।

২০ শতকের আধুনিকতাবাদে টি এস এলিয়টের সমালোচনা এবং কবিতা উভয়েরই গভীর প্রভাব ছিল। তার কাজগুলোর নতুন সাহিত্যিক রীতিনীতি এবং কৌশলের প্রবর্তন করেছে এবং আধুনিকতাবাদের ধারাকে সমৃদ্ধ করেছে। এলিয়টের সমালোচনায় ঐতিহ্য এবং ব্যক্তিগত প্রতিভার সংমিশ্রণ, কবির নিঃস্বার্থতা এবং সমালোচনার ভূমিকা নিয়ে আলোচনা, আধুনিক সাহিত্য সমালোচনায় একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করেছে। টি এস এলিয়টের তার “Tradition and the Individual Talent” প্রবন্ধে, সাহিত্য সমালোচনায় ঐতিহ্য এবং সৃষ্টিশীলতার সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি সমালোচনার জন্য একটি ঐতিহ্যগত এবং তাত্ত্বিক পদ্ধতির প্রস্তাব দেন। এলিয়ট বিশ্বাস করেন যে কোনো কবির কাজ সম্পূর্ণভাবে স্বতন্ত্র নয়; বরং তা একটি বৃহত্তর সাহিত্যিক ঐতিহ্যের অংশ এবং কবির ব্যক্তিগত প্রতিভা তার পূর্বসূরিদের কাজের সাথে একটি সম্পর্ক গড়ে তুলে এবং সেই ঐতিহ্যের অংশ হয়ে ওঠে। এলিয়টের মতে, একজন কবি তার ব্যক্তিগত অনুভূতি এবং অভিজ্ঞতা সরাসরি কবিতায় প্রকাশ করেন না; বরং তিনি শিল্পের মাধ্যমে তা রূপান্তরিত করেন। তার মতে, ‘Poetry is not a turning loose of emotion, but an escape from emotion; it is not the expression of personality, but an escape from personality.’ এলিয়েটের মতে, সমালোচনা কেবল সাহিত্যিক কাজের মূল্যায়ন নয়; বরং এটি সাহিত্যিক ঐতিহ্যের পুনর্বিন্যাস এবং নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে সাহিত্যকে বোঝার প্রচেষ্টা। এলিয়ট বিশ্বাস করতেন যে, একজন সমালোচকের দায়িত্ব হলো পূর্ববর্তী সাহিত্যিক কাজের মূল্যায়ন করা এবং তা আধুনিক প্রেক্ষাপটে পুনর্বিবেচনা করা।

গ্রামোফোন, মোটরকার, টাইপিস্ট, জ্যাজ মিউজিক এবং ক্যানফুড খাবারের প্রতি কবিতার ইঙ্গিতও এটিকে অসাধারণভাবে সমসাময়িক করে তোলে।

আজকের সাহিত্য সমালোচনা বহুমাত্রিক এবং বৈচিত্র্যময়। আজকের সাহিত্য সমালোচনা বিভিন্ন তাত্ত্বিক পদ্ধতি এবং দৃষ্টিকোণের সমন্বয়ে গঠিত, যা সাহিত্যকর্মের গভীর বিশ্লেষণ এবং মূল্যায়ন করে। যেমন উত্তর-কাঠামোবাদ, উত্তর-ঔপনিবেশিক সমালোচনা, নারীবাদী সমালোচনা, মনোবিশ্লেষণ এবং সাংস্কৃতিক সমালোচনা ও অধ্যয়ন। আজকের দিনে সাহিত্য সমালোচনা শুধুমাত্র টেক্সটের অভ্যন্তরীণ গঠন বা লেখকের জীবনী নিয়ে সীমাবদ্ধ নয়। বরং এটি বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে সাহিত্যকর্মের গভীর বিশ্লেষণ করে। সমালোচকেরা টেক্সটের বহুমাত্রিকতা এবং বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তার মূল্যায়ন করেন।

সমালোচনা অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য নয় কেন?
সমালোচনা শব্দটাকে আমরা প্রায়শই নেতিবাচক ভাবে গ্রহণ করে থাকি। অনেকেই সাহিত্যের ক্ষেত্রে সমালোচনাকে গ্রহণ করতে পারেন না। এর কারণও আছে। প্রথমত, আমাদের ব্যক্তিগত অহংবোধ ও আত্মমর্যাদায় আঘাত। সমালোচনা অনেক সময় আমাদের আত্মমর্যাদাকে আঘাত করে এবং এর ফলে আমরা নিজেকে অপর্যাপ্ত বা অসম্পূর্ণ মনে করি। আমরা সমালোচনার চাইতে প্রশংসা বেশি আশা করি। সমালোচনা গ্রহণ না করার আরেকটি কারণ হতে পারে পরিবর্তনের ভয়। সমালোচনা গ্রহণ করা মানেই আমাদের কাজগুলোরর কিছুটা পরিবর্তন করতে হবে এবং সেটার জন্য অধ্যয়ন করতে হবে, যা আমরা অনেকসময় করতে প্রস্তুত নই। সমালোচনা গ্রহণ না করার খুব স্বাভাবিক আরেকটি কারণ হলো, অযৌক্তিক ও আক্রমনাত্বক সমালোচনা। সমালোচনা যদি যৌক্তিক বা বাস্তবসম্মত না হয় এবং পক্ষপাতিত্বের কারণে কেবল অন্যকে হেয় করার উদ্দেশ্যে হয়, তবে তা গ্রহণ করা কঠিন হয়ে উঠে। সমালোচনা করতে গিয়ে আমরা অনেক সময় বিরূপভাবে কথা বলি, অযৌক্তিকভাবে চাটুকারিতা করি, কটাক্ষ করি যা অন্যকে আঘাত করে। যে কোনো সমালোচনাই হতে হয় গঠনমূল এবং তথ্য-যুক্তি নির্ভর। লেখকের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ রেখেই সমালোচনায় যুক্তি, প্রমাণ ও উদাহরণ টানতে হয়।

সাহিত্যে সাহিত্যতত্ত্ব ও দর্শন কী
সাহিত্যতত্ত্ব অর্থাৎ Literary of Theory হলো সাহিত্যের মূল উপাদানগুলোকে বিশ্লেষণ এবং ব্যাখ্যা করার জন্য ব্যবহৃত তত্ত্বসমূহের সংকলন। সাহিত্যতত্ত্বের মাধ্যমে সাহিত্যকর্মকে নানান দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা হয়। একটি শিল্পকর্মকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যবেক্ষণ করতে, গভীর বিশ্লেষণ ও তুলনামূলক মূল্যায়ন করতে এবং নতুন তত্ত্বের উদ্ভব ঘটাতে সাহিত্য সমালোচনায়, সাহিত্য তত্ত্বের দরকার হয়।

উদাহরণস্বরূপ- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গোরা’ উপন্যাস, যা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এক অনন্য সৃষ্টি। উপন্যাসে তৎকালীণ সমাজ, ধর্ম, দর্শন, সংস্কার-কুসংস্কার, ব্যক্তিগত পরিচয়ের সংকট, দেশপ্রেম, রাষ্ট্রনীতি, নতুন ধারার যৌক্তিক আহ্বান চমৎকারভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র, গোরা, একজন উচ্চবর্ণের হিন্দু হিসেবে বড় হয়, কিন্তু পরে জানতে পারে যে সে আসলে একজন আইরিশ দম্পতির সন্তান, যারা ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল।

“গোরা” উপন্যাসে উত্তর-ঔপনিবেশিক তত্ত্বের ব্যবহার করা যেতে পারে। চরিত্রটি ভারতীয় জাতীয়তাবাদ এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের মধ্যে একটি দ্বন্দ্বের প্রতীক। গোরা নিজেকে একজন ভারতীয় বলে মনে করে, কিন্তু তার জন্ম এবং আসল পরিচয় ঔপনিবেশিক শক্তির সাথে জড়িত। উপন্যাসে হিন্দু এবং ব্রাহ্ম সমাজের মধ্যে দ্বন্দ্ব উপনিবেশবাদের প্রভাব এবং ভারতীয় সমাজের পরিবর্তনের প্রতিফলন। এই দ্বন্দ্বগুলোর উত্তর-ঔপনিবেশিক তত্ত্বের আলোকে বিশ্লেষণ করে দেখা যেতে পারে কিভাবে ঔপনিবেশিক শাসন ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়ে প্রভাব ফেলেছে। আবার গোরা যখন জানতে পারে তার আসল পরিচয়, তখন তার ভেতরে একটি গভীর সংকট তৈরি হয়। এটি উত্তর-ঔপনিবেশিক তত্ত্বের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে দেখা যেতে পারে কিভাবে ঔপনিবেশিক প্রভাব একজন ব্যক্তির পরিচয় এবং তার আত্মপরিচয়ের বোধকে প্রভাবিত করতে পারে।

বিভিন্ন সাহিত্য তত্ত্বের মধ্যে রয়েছে, ফরমালিজম, কাঠামোবাদ (Structuralism), উত্তর-কাঠামোবাদ (Post-structuralism), মনোবিশ্লেষণ (Psychoanalytic Criticism), নারীবাদী সমালোচনা (Feminist Criticism), উত্তর-ঔপনিবেশিক সমালোচনা (Post-colonial Criticism), মার্কসবাদী সমালোচনা (Marxist Criticism), সাংস্কৃতিক সমালোচনা (Cultural Criticism), ঐতিহাসিক সমালোচনা (Historical Criticism), প্রাচীন তত্ত্ব (Archetypal Criticism)। এই বিভিন্ন তত্ত্বগুলোর সাহিত্যের বহুমাত্রিকতা এবং জটিলতা বোঝার জন্য ব্যবহৃত হয়। একজন সমালোচক সাহিত্য বিশ্লেষণ করতে এক বা একাধিক তত্ত্ব ব্যবহার করতে পারেন।

অন্যদিকে, দর্শন অর্থাৎ Philosophy সাহিত্যের নৈতিক, দার্শনিক, এবং সামাজিক মূল্যবোধের বিশ্লেষণ করে। এটি সাহিত্যের গভীরে প্রবেশ করে সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে জীবনের গভীর সত্য ও নীতিগুলোর অনুসন্ধান করে। উদাহরণস্বরূপঃ আলবেয়ার কামুর “লা পেস্ত” (The Plague) উপন্যাসের সমালোচনায় অস্তিত্ববাদী দর্শনের প্রয়োগ করা যেতে পারে।

আলবেয়ার কামুর “The Plague” ১৯৪১ সালের এপ্রিলে প্লেগ জীবাণু নিয়ে কাহিনি শুরু হয়। একটি জীবাণু ইঁদুর থেকে মানুষের মধ্যে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ছড়িয়ে পড়ে যা আলজেরিয়ার সমুদ্র উপকূলের ওরান নামক একটি সাধারণ শহরের অর্ধেক জনসংখ্যাকে ধ্বংস করে দেয়। প্লেগ মহামারির প্রাদুর্ভাবের সময় ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোরকে কেন্দ্র করে রচিত উপন্যাসটি। উপন্যাসের মূল চরিত্র, ডক্টর রিও, মহামারির বিরুদ্ধে মানুষের জন্য লড়াই করেন এবং এই প্রেক্ষাপটে মানব অস্তিত্ব, দুর্ভোগ এবং নৈতিকতার প্রশ্নগুলোর উঠে আসে।

ডক্টর রিও’র কর্মকাণ্ড এবং মহামারির মধ্যে মানুষের সংগ্রাম অস্তিত্ববাদী দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা যায়। মহামারি এখানে জীবনের অযৌক্তিকতা এবং অনিশ্চয়তার প্রতীক। কামু উপন্যাসের মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে, মানুষের জীবন অর্থহীন হলেও, তাদের উচিত নিজের জীবনের অর্থ তৈরি করা এবং নৈতিকভাবে কাজ করা। অস্তিত্ববাদী দৃষ্টিকোণ থেকে, মানুষের স্বাধীনতা এবং দায়িত্বের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। ডক্টর রিও এবং অন্যান্য চরিত্ররা মহামারির সময় নিজেদের দায়িত্ব পালন করেন, যা তাদের স্বাধীন ইচ্ছা এবং নৈতিকতার প্রতিফলন। অস্তিত্ববাদের একটি মূল ধারণা হলো নৈরাশ্য থেকে বিদ্রোহ। মহামারির সময় ডক্টর রিও’র বিদ্রোহ এবং সংগ্রাম অস্তিত্ববাদী দর্শনের একটি উদাহরণ হতে পারে যা দেখায় কিভাবে নৈরাশ্যের মাঝেও মানুষ বিদ্রোহ করে এবং নিজেদের অস্তিত্বের জন্য লড়াই করে, অবশেষে জীবনের অর্থ খুঁজে পায়।

সাহিত্য সমালোচনায় সাহিত্যতত্ত্ব এবং দর্শনের গুরুত্ব
সাহিত্য সমালোচনায় সাহিত্যতত্ত্ব এবং দর্শনের গুরুত্ব অপরিসীম। লেখার কাঠামো, শৈলী, এবং সাহিত্যকর্মের গভীর বিশ্লেষণ করে-সাহিত্যতত্ত্ব। এটি আমাদের সাহিত্যের বিভিন্ন রীতি, ধারা, এবং ইতিহাস বোঝার সুযোগ করে দেয়। সাহিত্যতত্ত্বের মাধ্যমেই আমরা জানতে পারি একটি সাহিত্যকর্মের অন্তর্নিহিত মান কি, লেখকের উদ্দেশ্য কি এবং সমাজে তার প্রভাব কি হতে পারে। আধুনিক সাহিত্য সমালোচনা প্রায়ই সাহিত্য তত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত হয়, যা সাহিত্যের লক্ষ্য এবং পদ্ধতির একটি দার্শনিক বিশ্লেষণ। অনেক লেখক, কবি, পণ্ডিতরা সাহিত্য তত্ত্বের মাধ্যমে সাহিত্যের শিল্পকর্মকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে থাকেন। সাহিত্য সমালেচনা এবং সাহিত্য তত্ত্বের ক্রিয়াকলাপ ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত, তবে সাহিত্য সমালোচকরা সর্বদা তাত্ত্বিক নন এবং ছিলেনও না। সাহিত্য সমালোচনাকে সাহিত্য তত্ত্ব থেকে অনুসন্ধানের একটি পৃথক ক্ষেত্র হিসাবে বিবেচনা করা উচিত কিনা -তা এখনো একটি বিতর্কের বিষয়। যেমন,’দ্য জনস হপকিন্স গাইড টু লিটারারি থিওরি অ্যান্ড ক্রিটিসিজম’ সাহিত্য তত্ত্ব এবং সাহিত্য সমালোচনার মধ্যে কোন পার্থক্য করে না। বরং প্রায় সবসময় একই ধারণা বর্ণনা করার জন্য একত্রে দুটোকে ব্যবহার করে। আবার কিছু সমালোচক সাহিত্য সমালোচনাকে সাহিত্য তত্ত্বের একটি ব্যবহারিক প্রয়োগ বলে মনে করেন, কারণ সমালোচনা সবসময় নির্দিষ্ট সাহিত্যকর্মের সাথে সরাসরি কাজ করে, যখন সাহিত্য তত্ত্ব আরও বিমূর্ত হতে পারে।

অন্যদিকে, সাহিত্য সমালোচনা এবং দর্শন পৃথক ক্ষেত্র হলেও তারা পরস্পর সম্পর্কিত এবং একে অপরকে সমৃদ্ধ করতে পারে। দর্শন সাহিত্যকে ভাববাদী এবং তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ করে। মানুষের অস্তিত্ব, নৈতিকতা, জ্ঞান, এবং বাস্তবতার প্রশ্নগুলোর সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে অন্বেষণ করে-দর্শন। দর্শনের সাহায্যে সাহিত্য সমালোচকরা সাহিত্যকর্মের মধ্যে গভীর মানসিক এবং নৈতিক প্রশ্নগুলোরর অনুসন্ধান করতে পারেন। সাহিত্যের প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য জানতে, মূল্যায়নের মানদণ্ড বিচারে, মার্জিত বিশ্লেষণ এবং অভিজ্ঞতার অনুসন্ধানে সাহিত্য সমালোচনায় সাহিত্য দর্শনের দরকার আছে। এই দুইয়ের সংমিশ্রণে সাহিত্য সমালোচনা আরো গভীর, সমৃদ্ধ এবং অর্থবহ হয়ে উঠে।

সাহিত্য সমালোচনা এবং সাহিত্য তত্ত্ব কীভাবে একসঙ্গে কাজ করে?
সাহিত্য সমালোচনা এবং সাহিত্য তত্ত্ব -উভয়ই সাহিত্য অধ্যয়নের দুটি মৌলিক দিক। এরা পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত তবে কাজের উদ্দেশ্য ও কার্যপ্রণালী নিয়ে এরা ভিন্নভাবে কাজ করে। সাহিত্য সমালোচনা যখন সাহিত্যের নির্দিষ্ট কাজের মূল্যায়ন, বিশ্লেষণ, এবং ব্যাখ্যা করতে চায়, তখন সাহিত্য তত্ত্ব সাহিত্যকে বোঝার জন্য ব্যবহৃত মৌলিক নীতিগুলোর এবং কাঠামোগুলোর নিয়ে গবেষণা করে, একাধিক পাঠ্য এবং শৈলীর প্রয়োগ করা ধারণা এবং কাঠামোর সাথে একটি দার্শনিক স্তরে সাহিত্যের সাথে সম্পর্কিত হতে চায়।

কারো শিল্পকর্ম নিয়ে সমালোচনায় একটি প্রশ্ন আসতে পারে, “লেখক এই বইটির দ্বারা কী বোঝাতে চাচ্ছেন? অন্যদিকে তত্ত্বের প্রশ্নটি হতে পারে, “এই সাহিত্যের মূল লক্ষ্য কী?” অর্থাৎ, দুটোর মাঝে পার্থক্যটা হলো- সাহিত্য সমালোচনা একটি নির্দিষ্ট বই নিয়ে কাজ করছে, অন্যদিকে সাহিত্য তত্ত্ব বইটি সম্পর্কে বিস্তৃত ধারণা নিয়ে কাজ করছে। দুটি ক্ষেত্র প্রায়ই সমাপতিত; সাহিত্য তত্ত্ব, সাহিত্য সমালোচনাকে সমর্থন করতে ব্যবহৃত হয় এবং সাহিত্য সমালোচনা সাহিত্য তত্ত্বকে প্রভাবিত করে অনেক ক্ষেত্রে।

ইতিহাসের পণ্ডিতরা সাহিত্য সমালোচনা মূলত সাহিত্য তত্ত্বের ভিত্তিতেই তৈরি করতেন। কেননা সমালোচনায়, সাহিত্য তত্ত্ব বিভিন্ন ধারণা এবং পদ্ধতি উপস্থাপন করে যা সমালোচকদের সাহিত্যের কাজ নিয়ে আরো বিস্তৃত বিশ্লেষণ করতে সাহায্য করে। যেমন, সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মনঃসমীক্ষণ তত্ত্ব ব্যবহার করে একজন সমালোচক যে কোনো একটি উপন্যাসের চরিত্রগুলোরর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করতে পারবেন। সাহিত্য তত্ত্ব, সমালোচকদের জন্য একটি কাঠামো তৈরি করে যা দ্বারা তারা বিভিন্ন পাঠ্য বিশ্লেষণ করতে পারেন। যেমন-নারীবাদী তত্ত্ব ব্যবহার করে একজন সমালোচক একটি গল্পের নারী চরিত্রগুলোরর চিত্রায়ণ করতে পারবেন এবং তাদের সামাজিক অবস্থান নিয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হবেন।

সমালোচকদের সাহিত্যকর্মের গভীরতর অর্থ খুঁজে বের করতে সাহিত্য তত্ত্ব বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ প্রদান করে। যেমন, পোস্ট-স্ট্রাকচারালিজম তত্ত্ব ব্যবহার করে একজন সমালোচক একটি কবিতার ভাষাগত কাঠামো এবং এর মধ্যে লুকিয়ে থাকা বৈপরীত্যকে অনায়াসে বিশ্লেষণ করতে পারবেন। উদাহরণস্বরূপঃ টিএস এলিয়টের “The Waste Land” পোস্ট-স্ট্রাকচারালিজম তত্ত্ব প্রয়োগ করার জন্য একটি উপযুক্ত কবিতা হতে পারে। এটি এলিয়টের একটি বিখ্যাত আধুনিকতাবাদী কবিতা, যা ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল।

কবিতাটি পাঁচটি বিভাগে বিভক্ত এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে লন্ডনের জীবনকে অন্বেষণ করে রচিত। তবে এতে সমুদ্র, মরুভূমির দৃশ্য এবং আলোড়নপূর্ণ মহানগর অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কবিতাটি তার স্বতন্ত্র শৈলীতে বিভিন্ন সাহিত্যের ধারা এবং ঐতিহ্যকে মিশ্রিত করেছে। এলিয়ট বাইবেল, শেক্সপিয়র, সেন্ট অগাস্টিন, হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থের পাশাপাশি ফরাসি কবিতা, ওয়াগনেরিয়ান অপেরা এবং হলি গ্রেইলকে ঘিরে আর্থারিয়ান কিংবদন্তি সহ সাহিত্যের অসংখ্য কাজের প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন। গ্রামোফোন, মোটরকার, টাইপিস্ট, জ্যাজ মিউজিক এবং ক্যানফুড খাবারের প্রতি কবিতার ইঙ্গিতও এটিকে অসাধারণভাবে সমসাময়িক করে তোলে।

নন্দনতত্ত্ব বিবেচনা করে কেন লোকেরা শিল্পের কিছু কাজ পছন্দ করে এবং কিছু কাজ অপছন্দ রয়ে যায়।

“The Waste Land” কবিতাটি বহুস্তর বিশিষ্ট এবং এর বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন অর্থ লুকানো রয়েছে। পোস্ট-স্ট্রাকচারালিজমের একটি মূল ধারণা হলো, একটি পাঠের নির্দিষ্ট অর্থ নেই কিংবা এর বাইরে অনেকগুলো অর্থ থাকতে পারে। এই কবিতার বিভিন্ন অংশ এবং ভাষার ব্যবহারের মাধ্যমে এলিয়ট এমন একটি জগত সৃষ্টি করেছেন যেখানে বিভিন্ন পাঠক বিভিন্ন অর্থ খুঁজে পাবেন। পোস্ট-স্ট্রাকচারালিজমে, একটি টেক্সটকে তার নিজস্ব সীমানায় সীমাবদ্ধ না রেখে অন্যান্য টেক্সটের সাথে সংযুক্ত করে। “The Waste Land” কবিতায় এলিয়ট প্রচুর সংখ্যক সাহিত্য, ধর্ম, এবং সাংস্কৃতিক রেফারেন্স ব্যবহার করেছেন, যা পোস্ট-স্ট্রাকচারালিজমের আন্তঃসম্পর্কের ধারণার সাথে মিলে যায়। পোস্ট-স্ট্রাকচারালিজম ভাষার অর্থ নির্ধারণের পরিবর্তে ভাষার খেলার ওপর জোর দেয়। “The Waste Land” কবিতায় এলিয়ট বিভিন্ন ভাষা, শৈলী, এবং ছন্দ ব্যবহার করেছেন, যা পোস্ট-স্ট্রাকচারালিজমের ভাষার খেলার ধারণাকে প্রতিফলিত করে। যখন পোস্ট-স্ট্রাকচারালিজম অর্থের অনিশ্চয়তা এবং অস্থায়িত্বকে গুরুত্ব দেয়, তখন “The Waste Land” কবিতায় এলিয়ট এমন একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত এবং অস্পষ্ট জগত সৃষ্টি করেছেন, যেখানে স্থায়ী এবং নির্দিষ্ট অর্থ খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।

সাহিত্য তত্ত্ব সম্পর্কে চিন্তাভাবনার একটি খুব প্রাথমিক উপায় হলো, সমসাময়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে ধারণাগুলোর বিভিন্ন সমালোচকদের শিল্প, সাহিত্য এবং এমনকি সংস্কৃতি দেখার জন্য এবং কথা বলার জন্য ব্যবহার করা। সাহিত্য তত্ত্ব, সমালোচকদের তাত্ত্বিক ভিত্তি প্রদান করে যা দ্বারা তারা সাহিত্যের বিভিন্ন শৈলী এবং প্রেক্ষাপট বুঝতে সক্ষম হোন।

উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো সমালোচক মার্ক্সবাদী তত্ত্বের সাথে কাজ করেন, তবে তিনি গল্পের চরিত্রগুলোর কীভাবে তাদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে মিথস্ক্রিয়া করবে, তার উপর মনোনিবেশ করতে পারবেন। যদি কোনও সমালোচক উত্তর-ঔপনিবেশিক তত্ত্ব নিয়ে কাজ করে থাকেন তবে তিনি সমালোচনার জন্য একই গল্পটি বিবেচনা করতে পারবেন, তবে সেখানে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর (ব্রিটেন, ফ্রান্স, এমনকী আমেরিকা) কিভাবে আফ্রিকা বা ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের চরিত্রগুলোররর সাথে মিথস্ক্রিয়া করবে, তা দেখবেন।

সাহিত্য সমালোচনা এবং দর্শন কিভাবে একসঙ্গে কাজ করে
সাহিত্য সমালোচনায় দর্শন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কারণ দর্শন সমালোচকদের জন্য একটি নৈতিক, দার্শনিক এবং নান্দনিক ভিত্তি প্রদান করে। দর্শন চিন্তার একটি কার্যকলাপ, চিন্তার সবচেয়ে জটিল এবং ব্যাপক পদ্ধতি যা মানুষ এখনও আবিস্কার করে চলেছে। দর্শন এবং সাহিত্য উভয়ই মানুষের অভিজ্ঞতা, চিন্তা, এবং আবেগ-অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। সাহিত্য সমালোচনায় দর্শনের তত্ত্ব এবং পদ্ধতিগুলো প্রয়োগের মাধ্যমেই পণ্ডিতরা সাহিত্যকর্মের গভীরতর বিশ্লেষণ করে থাকেন। প্রশ্ন উঠতে পারে, সাহিত্যে দর্শন কেন থাকবে? সাহিত্যের ভাষা আর দর্শনের ভাষা তো এক নয়। অবশ্যয়ই তা এক নয়। তবে আমাদের জানতে হবে সাহিত্যে আসলে দর্শনের স্থানটা কোথায়।

সাহিত্য এবং দর্শনের ভাষা ভিন্ন হলেও, তারা একে অপরের সাথে মিলিতভাবে কাজ করে। সাহিত্য যখন মানুষের অভিজ্ঞতা, চিন্তা এবং আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ করে তখন দর্শন মানুষের জীবনের মৌলিক প্রশ্নগুলো নিয়ে আলোচনা করে। বিভিন্ন সাহিত্যিকরা দর্শন তত্ত্ব প্রয়োগের মাধ্যমেই চরিত্রের নৈতিকতা, মানবিকতা এবং এর প্রভাব সম্পর্কে বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হোন। কাজেই সাহিত্য, দর্শনের মাধ্যমেই মানুষের জীবনের গভীর প্রশ্ন, দ্বন্ধ এবং সমস্যাগুলোর নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে পারে। সাহিত্যকে শিল্প হিসেবে সম্বোধন করা হয় সাহিত্যের দর্শনে। দর্শনের বেশ কিছু শাখা রয়েছে যা সাহিত্যকর্মের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, অনুসন্ধান এবং সাহিত্যকর্মের মধ্যে প্রাধান্য পাওয়া মূল্যবোধ এবং নীতিগুলোরর বিশ্লেষণ করার জন্য প্রয়োগ করা হয়।

নীতিশাস্ত্র বা নৈতিক দর্শন হলো দর্শনের একটি শাখা যা সঠিক-ভুল, ভাল-মন্দ এবং ন্যায়-অন্যায় এর বিষয়গুলোকে সংজ্ঞায়িত ও সুশৃঙ্খল করার মাধ্যমে মানুষের নৈতিকতা নিয়ে নানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে। সাহিত্য, নৈতিক দ্বন্দ্ব এবং মূল্যবোধ নিয়ে আলোচনা করে যা দর্শনের নীতিশাস্ত্রের অংশ।

উদাহরণস্বরূপঃ রাশিয়ান লেখক ফিওদর দস্তইয়েভ্‌স্কি এর ‘ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট’। এটি একটি ক্লাসিক উপন্যাস যা মানব প্রকৃতি ও সমাজের জটিলতাগুলোরকে গভীরভাবে তুলে ধরে। রাসকোলনিকভ নামক এক যুবকের গল্প এটি, যে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে একজন বয়স্ক প্যানব্রোকার এবং তার বোনকে হত্যা করে। নৈতিকতা উপন্যাসটির অন্যতম প্রধান বিষয়। প্রধান চরিত্র, রাসকোলনিকভি, নিজেকে সমাজের একজন উচ্চতর সত্তা মনে করে যে সাধারণত নৈতিক আইন থেকে নিজ্কে মুক্ত মনে করে। সমাজের বৃহত্তর মঙ্গলের জন্য সে হত্যা করছে, এই যুক্তি দিয়ে সে তার অপরাধকে ন্যায্যতা দেয়। রাসকোলনিকভি নিজেকে এক ধরনের সুপারম্যান হিসাবে দেখে যে মানবতার সাধারণ পালের ঊর্ধ্বে। কিন্তু গল্প যত সামনে এগোয়, অপরাধবোধ এবং উদ্বেগ তাকে গ্রাস করতে শুরু করে। সে আরও বেশি একাকিত্ব বোধ করতে শুরু করে এবং অপরাধবোধে জর্জরিত হয়ে অবশেষে তার অপরাধ স্বীকার করে। উপন্যাসটি নৈতিকতা, ন্যায়বিচার, মুক্তি, দারিদ্র্য এবং মানসিক অসুস্থতা সহ বিভিন্ন বিষয়কে অন্বেষণ করে।

একটি উপন্যাসে মানবতার চিত্র ন্যায় সঙ্গত কিনা এবং সেখানে সাহসিকতার বিষয়গুলোর কিভাবে তুলে ধরা হয়েছে, তা দর্শনের মাধ্যমে একজন সমালোচক বিশ্লেষণ করতে পারেন। দর্শনের নীতিশাস্ত্র এবং অধিবিদ্যার মতো দার্শনিক তত্ত্বগুলোর ব্যবহারের মাধমেই সাহিত্যকর্মের নৈতিক দ্বন্দ্ব, চরিত্রের আধ্যাত্মিক অনুসন্ধান এবং নৈতিক সিদ্ধান্ত বিশ্লেষণ করা হয়।

দার্শনিক এবং আধ্যাতিক উপন্যাসে মানবতা, লড়াই ও সাহসিকতার বিষয়গুলোর আধ্যাত্মিক এবং দার্শনিক প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ করা হয়। যেমন-জার্মান লেখক হারমেন হেসের ‘সিদ্ধার্থ’ আধ্যাত্মিক অনুসন্ধান এবং জীবনের অর্থ নিয়ে আলোচনা করে। ফিওদর দস্তয়েভস্কির “দ্য ব্রাদার্স কারামাজভ”: নৈতিক দ্বন্দ্ব, ধর্মীয় বিশ্বাস এবং মানবতার নানা দিক তুলে ধরে। ‘দ্য ব্রাদার্স কারামাজভ’ এর মূল বার্তাটি হল মানব প্রকৃতি, নৈতিকতা এবং ঈশ্বরের অস্তিত্বের একটি দার্শনিক অনুসন্ধান। এটি মানব অস্তিত্বের গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক প্রশ্নের দস্তয়েভস্কির গভীরতম এবং সবচেয়ে জটিল একটি পরীক্ষা। এতে তিনি বিশ্বাস এবং সন্দেহের মধ্যে দ্বন্দ্ব, স্বাধীন ইচ্ছার সমস্যা এবং নৈতিক দায়িত্বের প্রশ্নকে সম্বোধন করেছেন। এই ধরনের উপন্যাসগুলোর নিয়ে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ বা সমালোচনা করতে দর্শনের দরকার পড়ে।

সাহিত্যকর্মের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করার জন্য মার্কসবাদ, নারীবাদ, উত্তর-ঔপনিবেশিকতাবাদ-এই দার্শনিক তত্ত্বগুলোর প্রয়োগ করা হয়।

উদাহরণস্বরূপঃ চার্লস ডিকেন্সের “হার্ড টাইমস”-উপন্যাসটি ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের সময়কার সমাজের প্রতিফলন। “হার্ড টাইমস”-এ শ্রেণী সংঘাতের থিম একটি কেন্দ্রীয় উপাদান যা ভিক্টোরিয়ান যুগে শ্রমিক শ্রেণী এবং শিল্প অভিজাতদের মধ্যে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং নৈতিক বৈষম্যকে আন্ডারস্কোর করে। উপন্যাসের চরিত্রগুলোর, যেমন লুইজা গ্র্যাডগ্রাইন্ড এবং স্টিফেন ব্ল্যাকপুল, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে, এবং তাদের জীবন কিভাবে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দ্বারা প্রভাবিত হয় তা ফুটে উঠেছে। মার্কসবাদী বিশ্লেষণে উপন্যাসের অর্থনৈতিক দিকগুলো গুরুত্বপূর্ণ। “Hard Times” উপন্যাসে ডিকেন্স শ্রমিক শ্রেণীর জীবন সংগ্রাম এবং তাদের অর্থনৈতিক দুর্দশা তুলে ধরেছেন। কারখানার মালিকদের এবং শ্রমিকদের মধ্যে সম্পর্ক এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য উপন্যাসের মূল থিম হিসেবে উঠে এসেছে। এটি স্পষ্টভাবে দেখায় কিভাবে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা শ্রমিক শ্রেণীর উপর প্রভাব ফেলে। উপন্যাসের সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটও মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ। “Hard Times” এ ডিকেন্স শিক্ষাব্যবস্থা এবং প্রগাঢ় যৌক্তিকতার বিরুদ্ধে তার সমালোচনা প্রকাশ করেছেন। উপন্যাসে দেখানো হয়েছে কিভাবে শিক্ষাব্যবস্থা এবং সংস্কৃতিগত মানদণ্ড সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে বৈষম্য তৈরি করে এবং তাদেরকে শোষিত করে রাখে।

দর্শনের কাঠামোবাদ এবং পোস্ট-স্ট্রাকচারালিজমের (যা সাহিত্যতত্ত্ব এবং দর্শনের সংমিশ্রণ) তত্ত্বগুলোর সাহিত্যকর্মের গঠন, প্রতীক এবং রূপক বিশ্লেষণ করতে ব্যবহৃত হয়।

সাহিত্যকর্মে একটি চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা, অভিজ্ঞতা এবং অস্তিত্বের সংকট বিশ্লেষণ করতে ফ্রয়েডের মনস্তত্ত্ব এবং সার্ত্রে বা কামুর অস্তিত্ববাদী তত্ত্ব প্রয়োগ করা যায়। যেমন-ফ্রান্জ কাফকার “দ্য মেটামরফোসিস”তে চরিত্রের অস্তিত্ব সংকট এবং মানসিক অবস্থার বিশ্লেষণ। আখ্যানের নায়ক, গ্রেগর সামসা, একটি বিশাল পোকায় পরিবর্তিত হয় এবং এইভাবে তার চারপাশের লোকদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কাফকা আমাদের ভাবতে বাধ্য করে যে, আমরা যে কাজ করি এবং আমরা যে সঙ্গ বা সম্পর্ক ধরে রাখি, তা দ্বারা আমরা আমাদের মানবতাকে কতটা সংজ্ঞায়িত করতে পারি।

বিচ্ছিন্নতার বিষয়টি মেটামরফোসিসের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত থিম। কাফকা শুধুমাত্র আখ্যানের নায়ক, গ্রেগর সামসার উপর নয়, বরং তার পরিবারের উপরও বিচ্ছিন্নতার প্রভাব অন্বেষণ করেন, সম্পর্কের মধ্যে যে ফাটল দেখা দেয় তা তুলে ধরেন। ‘দ্য মেটামরফোসিস’-পরিচয় এবং আত্ম-উপলব্ধির জটিলতা তুলে ধরে।

আবার নন্দনতত্ত্ব, দর্শনের নিজস্ব ক্ষেত্র যা নান্দনিকতা থেকে বেরিয়ে আসে এবং প্রকৃতির সৃষ্টি, সৌন্দর্য এবং শিল্পের শিল্পকে মধুরাদি রস আস্বাদন ও দর্শনের মাধ্যমে বিচার করে। নন্দনতত্ত্বের মাধ্যমে সাহিত্যকর্মের শৈল্পিক গঠন, রূপ এবং শৈলী বিশ্লেষণ করা হয়। নন্দনতত্ত্ব- সৌন্দর্যের দর্শন এবং শিল্পের উপর তার প্রভাব নিয়ে আলোচনা করে। সাহিত্যকর্মের শৈল্পিক মান এবং তার মূল্যায়ন নন্দনতত্ত্বের মাধ্যমে করা হয়। একটি সাহিত্যকর্মকে কিভাবে একটি উৎকৃষ্ট শিল্পকর্ম হিসেবে চিহ্নিত করা যায় তা নির্ধারণ করে নন্দনতত্ত্ব। নন্দনতত্ত্ব-এক সুগভীর চেতনা। অনন্য উপলব্ধি নন্দনতত্ত্বের অন্তরাত্মায় সুন্দরের রূপময় উপস্থিতি দেয়, ভাবের সুগভীর পরিপূর্ণতা দেয়, শিল্প মানবমনের আনন্দিত উপলব্ধির বহিঃপ্রকাশ ঘটায় এবং সেই শিল্পকে সৌন্দর্যের নানান দৃষ্টিকোণ থেকে পরীক্ষা বা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করার নামই ‘নন্দনতত্ত্ব’। নন্দনতত্ত্বের সেই ‘আনন্দিত উপলব্ধি’ কে সৌন্দর্যের সাথে মঙ্গলভাবনা ও মানবীয় গুণগুলোরতেই ‘সুন্দরের অভিমুখী’ করে তোলা যায়। কাজেই সাহিত্যের রস আস্বাদনে নন্দনতত্ত্বের ব্যবহার রয়েছে। নন্দনতত্ত্ব বিবেচনা করে কেন লোকেরা শিল্পের কিছু কাজ পছন্দ করে এবং কিছু কাজ অপছন্দ রয়ে যায়। সেইসাথে শিল্প কীভাবে মেজাজ বা আমাদের বিশ্বাসকে প্রভাবিত করতে পারে।

প্রকৃতির শিল্পকে অ্যারিস্টটল প্রথম যোগ্য করে তোলেন যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এবং আধ্যাত্মিক জগতের মধ্যে শূন্যতা পূরণ করে। অ্যারিস্টটলীয় নন্দনতত্ত্ব রচনা, আবেগের হ্রাস এবং নির্বাচনের ধারণাকে দেখায়। যেমন-উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ! তিনি রোমান্টিক আন্দোলনের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব, যিনি তাঁর “Lines Composed a Few Miles above Tintern Abbey” কবিতায় প্রকৃতির পুনরুদ্ধারের ক্ষমতা নিয়ে কথা বলেছেন। প্রকৃতির সাথে মানুষের সংযোগ সম্পর্কে বলেছেন। ওয়ার্ডসওয়ার্থের এই কবিতায় তিনি মানুষের আত্মার উপর প্রকৃতির পুনরুদ্ধারকারী শক্তির অন্বেষণ করেছেন। প্রকৃতির সাথে তাঁর সংযোগের অনুভূতি তাকে কীভাবে মানবতার সাথে আরও সংযুক্ত বোধ করতে সাহায্য করেছে, সে কথাই বলেছেন। তিনি মনের অবস্থার সংবেদনকে বৈপরীত্য করেছেন যখন তিনি তৃণভূমি এবং পর্বতমালার বিপরীতে থাকা দুঃসাহসিক অভিজ্ঞতাগুলোর নিয়ে চিন্তা করতে গিয়ে হতাশাজনক এবং অস্থির অবস্থায় থাকেন।

এই দৃষ্টিভঙ্গি আমাদেরকে কেবল সাহিত্যকর্মের প্রকৃত মর্মার্থ উপলব্ধি করতে নয়, বরং আমাদের নিজস্ব জীবন এবং সমাজের জটিলতাগুলোরও বুঝতে সাহায্য করে।

আবার, জন কিটস, যিনি সংবেদনশীল এবং প্রাণবন্ত কবিতার জন্য পরিচিত, প্রায়ই বিশ্বের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অন্বেষণ করতেন। তাঁর বিখ্যাত কবিতা “Ode to a Nightingale”-এ তিনি প্রকৃতির সৌন্দর্যের অতীন্দ্রিয় এবং নিরবধি গুণের কথা তুলে ধরেছেন। এই কবিতাটি মূলত দুটি ভিন্ন ধরনের সৌন্দর্যের মধ্যে সম্পর্ক অন্বেষণ করে; মানবজাতির দ্বারা নির্মিত শিল্পের জগত এবং প্রকৃতির দ্বারা সৃষ্ট সমৃদ্ধ বৈচিত্র্যময় জীবন।

দর্শনের আরেকটি শাখা হলো মেটাফিজিক্স, বা অধিবিদ্যা, যা অস্তিত্ব, বাস্তবতা, সত্তা এবং জগতের মৌলিক প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করে। জগৎ ও জীবনের নিহিত তত্ত্ব বা সত্তার স্বরূপ নির্ধারণের চেষ্টা করে মেটাফিজিক্স। সাহিত্যকর্মে চরিত্রের পরিচয়, চরিত্রের অস্তিত্ব, সত্তার গভীরতা এবং বাস্তবতার বিশ্লেষণে মেটাফিজিক্স প্রশ্নগুলোর বিশ্লেষণ করে। সাহিত্য সমালোচনায় মেটাফিজিক্স, সাহিত্যের গভীর এবং বিমূর্ত প্রশ্নগুলোরর বিশ্লেষণে সহায়ক হয়। মেটাফিজিক্স চরিত্রের মানসিক, সামাজিক এবং আধ্যাত্মিক দিকগুলোরও অনুসন্ধান করে।

যেমন-রাল্ফ এলিসনের ‘Invisible Man!’ এটি রাল্ফ এলিসনের একটি ক্লাসিক যা ১৯৪০ এর দশকের শেষের দিকে লেখা। এটি একজন আফ্রিকান আমেরিকান তরুণের গল্প বলে যে রেনেসাঁর সময় হার্লেম থেকে উত্তরে চলে যায় এবং সমাজে তার স্থান খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করার সময় অনেক পরীক্ষার সম্মুখীন হয়। ‘Invisible Man” এর প্রধান থিম হল পরিচয় এবং জাতি। কথক, যিনি একজন আফ্রেনিকান আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ, তার অদৃশ্যতা অনুভব করেন যেভাবে সমাজ তাকে দেখতে অস্বীকার করে সে কৃষ্ণাঙ্গ বলে। কাজেই ‘Invisible Man’ সত্তার অদৃশ্যতা এবং সামাজিক পরিচয় নিয়ে মেটাফিজিক্যাল একটি অনুসন্ধান নিঃসন্দেহে।

মূলত, মানুষের প্রতিটা সৃষ্টি বা কাজের পিছনেই একটা নিজস্ব চিন্তা থাকে। নিত্যদিনের স্বাভাবিক বা সাধারণ কাজগুলো-সবকিছুর মধ্যেই মানুষের চিন্তা নিজেকে মূর্ত করে। এসবই ব্যক্তির নিজস্ব দর্শন। আমরা দর্শন ধরে রাখি বলেই কোনো শিল্প, গল্প, উপন্যাস, কবিতায়-কীভাবে কাজটি কল্পনা করা হয়েছিল তার বর্ণনা পাই, কীভাবে সংসর্গ বা আবেগ উদ্ভূত হয়েছে, গল্পের ঘটনা সম্পর্কিত অনুমান, গল্পের ঘটনাগুলোরর সম্প্রসারণ এবং গল্পের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কিত পূর্বাভাস পাই। দর্শন আমাদের এসবই চিন্তা করতে বাধ্য করে এবং সাহিত্যের মধ্যে লুকিয়ে থাকা চিন্তাকে খুঁজে বের করে।

পরিশেষে বলা যায়, সাহিত্য সমালোচনার মাধ্যমেই আমাদের বিশ্বদর্শন প্রসারিত হয় এবং বিভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমে আমরা সাহিত্যের কাজগুলোর পর্যবেক্ষণ করে, চারপাশের বিশ্ব সম্পর্কে আরও শিখতে পারি। প্রতিটি সাহিত্যশৈলী লেখক এবং পাঠককে তাদের নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গিতে বিবেচনা করার ক্ষমতা দেয়। সাহিত্য সমালোচনার সাহায্যেই আমরা কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস এবং ছোট গল্পের মতো সাহিত্যকর্মগুলোরর অধ্যয়ন, মূল্যায়ন এবং ব্যাখ্যা করতে শিখি। সাহিত্য সমালোচনার অন্যান্য উদাহরণ পড়া মানে আমরা সাহিত্যের একটি নির্দিষ্ট অংশ সম্পর্কে জানতে পারি এবং সমালোচনামূলক প্রবন্ধ বা বই পর্যালোচনা করতে বা লিখতে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে শিখি। এবং এখানেই সাহিত্য সমালোচনায় সাহিত্যতত্ত্ব ও দর্শনের সম্মিলিত প্রয়োগ আমাদের সাহিত্যকর্মের গভীরতা ও তাৎপর্য উদ্ঘাটনের জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠে। কেননা, সাহিত্যতত্ত্বের মাধ্যমে আমরা সাহিত্যকর্মের গঠন, ভাষা, শৈলী এবং রূপ বিশ্লেষণ করতে পারি, যা আমাদেরকে কাজটির শৈল্পিক সৌন্দর্য এবং নান্দনিক মান উপলব্ধি করতে সহায়তা করে। অন্যদিকে, একই কাজে দর্শন আমাদেরকে সাহিত্যকর্মের গভীরতর অর্থ, নৈতিকতা, মানব অস্তিত্ব এবং সামাজিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে প্রশ্ন তোলার সুযোগ দেয়, যা পাঠকদেরও মানসিক ও বৌদ্ধিকভাবে সমৃদ্ধ করে। সাহিত্যতত্ত্ব ও দর্শনের এই মেলবন্ধন সাহিত্যের জগতে একটি পূর্ণাঙ্গ এবং সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে। এই দৃষ্টিভঙ্গি আমাদেরকে কেবল সাহিত্যকর্মের প্রকৃত মর্মার্থ উপলব্ধি করতে নয়, বরং আমাদের নিজস্ব জীবন এবং সমাজের জটিলতাগুলোরও বুঝতে সাহায্য করে।

সর্বোপরি, সাহিত্য সমালোচনায় সাহিত্যতত্ত্ব ও দর্শনের সম্মিলিত প্রয়োগ আমাদেরকে সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে মানবতার গভীরতর সত্য এবং অভিজ্ঞতার সন্ধানে এগিয়ে নিয়ে যায়, যা সাহিত্যকে একটি জীবন্ত, শ্বাসপ্রশ্বাসমূলক এবং পরিবর্তনশীল শিল্পমাধ্যম হিসেবে প্রমাণ করে।