কবিতা লেখার চেষ্টা একসময় ছিল আমার সেরা বদভ্যাসগুলোর একটি। অন্তত বন্ধুরা তাই বলতো। সেই আমি এখন চেষ্টা করে যাচ্ছি গল্প লিখিয়ে হওয়ার। নিজেকে কখনো কবি বা গল্পকার হিসেবে দাবি করার মতো কলিজা-গুর্দা যে আমার নেই তা আমি অকপটেই সবসময় সবার কাছে স্বীকার করি। পরিচিত যারা এ নিয়ে আপত্তি তোলেন তাদের বিনয়ের সঙ্গে বলি, আমি আসলে দুর্বল মনের মানুষ। এই গড়পড়তা জ্ঞান সামর্থে নিজেকে লেখক ভাবতে আমার সাহস হয় না। অবশ্য যে-কোনো মূল্যে নিজের লেখক পরিচয় জাহিরের ইচ্ছেও আমার নেই। গল্প উপন্যাসের দুটি বই বেরিয়েছে, সেগুলার সার্থকতা নিয়েও আমি সন্দিহান।
হাজার হাজার লেখকের মূল্যবান বইয়ের ফাঁকে আমার কায়া সাদৃশ্য দুটি বই পাঠকবিনা অথর্ব অপেক্ষা করে রয়েছে যুগের পর যুগ। কিংবা কোনো এক নিভৃত কোণে তা চমৎকার ব্যবস্থা করেছে উই-ইঁদুরের অন্নসংস্থানের, এ কথা মনে হলেই আমার কলজে শুকিয়ে আসে। প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন, ‘মুদ্রণযন্ত্র সহজলভ্য হওয়ায় এখন এমন অনেক কিছুই ছাপা হইতেছে, যা ছাপা হওয়ার যোগ্য নয়। তাই বইয়ের কথা, পাঠকের কথা ভাবলেই আমার বুক দুরুদুরু করে।’ শেষে না কেউ প্রমথ চৌধুরীর কথাটাই আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে বসে।
যাই হোক, নিজেকে লেখক বা কবি বলে পরিচয় না দিলেও কাকতালীয়ভাবে হঠাৎ করেই কিছুদিন থেকে যেন পড়ে গেছি কবির মহাসমুদ্রে। বাড়ির পাশে কবি, অফিসে কবি, আড্ডায় কবি, যেদিকে তাকাই আমার চারপাশে এখন কেবল কবি আর কবি। লাল কবি, নীল কবি, সতেজ কবি, নিস্তেজ কবি, লম্বা, বেঁটে, ভালো, খারাপ; সব ধরনের কবিরা যেন ঘিরে দাঁড়িয়েছে আমাকে। একসময় খোঁচা মেরে অনেকে বলতেন, বাংলাদেশে নাকি কাকের চেয়ে কবির সংখ্যা বেশি। এখন যেন কেউ তা আমাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। এই ভিড়ে পড়ে আমি খানিকটা হতবিহ্বল; একইসঙ্গে বিব্রতও বোধ করি। কিন্তু অসংখ্য কনফিডেন্ট কবির মধ্যে আমার মতো নিস্তেজ মানুষের কথা কে আর চিন্তা করে বলুন।
তিনি দাবি করেন, দেশের মানুষ এখনো গুণী লোকের কদর বোঝে না বলেই তাকে এখনো সাহিত্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কার বা একুশে পদক দেওয়া হচ্ছে না।
প্রায় বছর দশেক বছর আগে একটি মাসিক পত্রিকায় কাজের সূত্রে আমার দিনের অনেকটা সময় কেটে যেতো শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে। এই মার্কেটের আড্ডা, গাল-গল্পের কথা আগে কেবল শুনতাম লোকজনের মুখে। তবে আমাকেও যে কখনো সেখানেই খুঁটি গাঁড়তে হবে, তখনো এমনটা ভাবিনি। সেখানে আমি সহকর্মী হিসেবে পাই লেখক ও কবি শফিক হাসানকে। মজার এই মানুষটি কৌতুকচ্ছলে সে সময় প্রতিদিন আমাকে নানাভাবে কবিপাঠ দিতেন। কারণ প্রতিদিনই অফিসে ঘটতো কোনো না কোনো কবির আগমন। প্রতিদিনই নতুন নতুন কবির গাল-গল্প। শফিক নিজে লেখক কিন্তু আশ্চর্যরকম দক্ষতায় আপনাকে বাঁচিয়ে চমৎকার হিউমারাস কথাবার্তায় অফিসে আসা এমন কোনো কবি নেই, যাকে নিয়ে তিনি বিদ্রূপ করতেন না।
অদ্ভুত বিষয় হলো, যাকে নিয়ে বিদ্রূপ করা হচ্ছে, সে মোটেও বুঝতে পারতো না শফিকের এসব হিউমার। দেখতাম, শফিকের তীব্র তির্যক কথাবার্তায়ও আগত কবিটি যেন নিজের পদবির আনন্দে অভ্রভেদী হয়ে উঠতে চাইতো মাথা। শফিকের এ বড় মহাগুণ। মাঝে মধ্যে শফিক যে আমার দিকেও দুই-একটা স্প্রিন্টার ছুড়ে দিতেন না, এমন নয়। তবু সে-ই আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতো প্রতিদিন কবিদের ওই আশ্চর্য ভাবের জগতের সঙ্গে।
মার্কেট ঘিরে প্রতিদিনই দেখতাম অসংখ্য লিটল ম্যাগের আনাগোনা। নতুন নতুন কবিদের উত্থান, পুরনোদের নিন্দা মন্দ, ঝগড়া-ফ্যাসাদ, কাদা ছোড়াছুড়ি; কোনো কিছুই তখন আর আমার চোখ এড়াতো না। এমনও দেখেছি, কবিতা বা লেখা হোক না কিছু একটা লিখেই কেউ কেউ নিজেদের নামের পেছনে কবি পদবি জুড়ে দিচ্ছে। শফিক আমাকে দেখাতো, মার্কেটের দারোয়ান থেকে শুরু করে ড্রাইভার, দোকানদার, চাওয়ালা, মিস্ত্রিসহ সবাই নাকি এখানে কবি। এমনকি আমি যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করছি, সেটার মালিক থেকে শুরু করে তার বাড়ির রাঁধুনিটিও নাকি কবিতা লেখেন। কবিতা আর কবির এমন পসরা, ভাবা যায়! কোনো কোনো কবি আসছে কবিতা কিনতে, কেউ আসছে মার্কেটের আট দশটি প্রকাশনী ঘিরে কবিতা বিকোতে। ভালো, খারাপ, মোটামুটি, জঘন্যসহ সব জাতের কবিতাই নাকি এ মার্কেটে কিনতে পাওয়া যায়।
আছে কবিদের নাম বিভ্রাটও। আশ্চর্য হয়ে দেখতাম, অনন্ত স্বপ্ন নিয়ে দুই-একটি পঙ্ক্তি লেখার পরই নবকবি রূপে দিক্ষিত মানুষটি পাল্টে ফেলছে তার জন্মগত নাম। নতুন নামটি বলতে বা লিখতে যত কঠিন হবে, এ ক্ষত্রে মনে হয় সেটিই ওই ব্যক্তিটির কবিত্ব পরিমাপের মানদণ্ড হিসেবে কাজ করে। আমার নিজের পরিচিত কয়েকজনের কথাই তো নতুন করে শুনেছি আর অবাক হয়েছি। পরিবর্তিত নামের এসব কবিরা কী অবলিলায় না খাপ খাইয়ে গেছেন তাদের নতুন নামে! পুরনো নাম বড্ড অপাঙ্ক্তেয়, আর সাধারণ। পরিবর্তিত নামের তেমন একজন কবি আমাকে বলেছিলেন, কবিরা নাকি সাধারণ মানুষ নয়। তারা ঈশ্বরের সেই বিশেষ অভিশপ্ত সৃষ্টি যারা অলৌকিক আন্দের ভার বয়ে বেড়ান। সুতরাং তাহার বক্ষে অপার বেদনাতো থাকবেই। আর এই বেদনাকে শৈল্পিক রূপ দেয় তার পরিবর্তিত নাম। আজ তেমন পরিবর্তিত নামের অনেক কবিকে আমি চিনি, যারা গোষ্ঠীবদ্ধভাবে অদ্ভূত দক্ষতায় নিজেদের নামকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তারা এখন অবলীলায় দেশীয় আধুনিক কবিতার ধারক-বাহক হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেন।
শফিকের কাছে শুনেছি কবিদের অদ্ভুত অদ্ভুত সব কাণ্ডকারখানা। এগুলো ঠিক হাস্যকর, নাকি অন্যকিছু, আমি এখনো বুঝে উঠতে পারিনি। কয়েকটি উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে। মার্কেটের জনৈক এক বিখ্যাত কবি নাকি ভাবছেন, রবীন্দ্রনাথের পর সমসাময়িক সময়ে যদি দুই বাংলায় কেউ শ্রেষ্ঠ কবি থাকেন, সে কেবল তিনিই। শুধু প্রচারের অভাবে তার যোগ্যতার মূল্যায়ন হচ্ছে না। তার মতে, শুধু তিনি ছাড়া ইদানিংকালের সব কবির কবিতা নিক্ষেপযোগ্য। পরিচিত এক মদের আড্ডায় সেই কবির নিবিড় যাতায়াত। সমস্যা হলো, তিনি সেখানে গেলে অন্যরা খুব ভয়ে থাকেন। কারণ কবি, কথা শুরু করলে আর কাউকে কোনো কিছু বলতে দেন না। নিয়ম হলো, গেলাসের পর গেলাস গিলে তিনি শুধু বলেই যাবেন, অন্যদের বাধ্যগতের মতো শুনতে হবে। পাল্টা কোন যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করলে কবি বিরক্ত হয়ে এমন কথা বলবেন যে, মানইজ্জত নিয়ে টানাটানি।
এই কবিটিরই আরেকটি ঘটনা বলা যাক। বিখ্যাত সেই কবি নাকি একবার গেছেন আজিজ মার্কেটের টয়লেটে। মার্কেটের বাইরের লোকেরা টয়লেট ব্যবহার করলে নির্দিষ্ট একটা টাকা দিতে হয়, তা সেই কবি বোধয় জানতেন না। তিনি বাইরে এলে যথারীতি তার কাছে টাকা চাওয়া হলো। এতে কবি যেন বজ্রাহত হলেন। দেশটা কোথায় যাচ্ছে? তিনি একজন কবি, এই দেশে প্রস্রাব করতে গেলেও কবির কাছে টাকা চাওয়া হয় জেনে তিনি দুঃখে কী করবেন ভেবে পেলেন না। এরজন্যই কি কবিরা তাদের কলমকে হাতিয়ার বানিয়ে যুদ্ধ করে দেশটা স্বাধীন করেছিলেন! তিনি ছি ছি ছড়িয়ে দিতে থাকলেন সবদিকে। তার স্তাবকরাও সঙ্গে সঙ্গে বললো, ছি!
এই তো গেলো একজনের কথা। এখন আরেক কবির কথা শোনা যাক। ইনি নিজেকে দাবি করতেন, নব্বই দশকে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ কবিদের একজন বলে। তার ভাষায় যে কবিকে তিনি চেনেন বা যে কবি তাকে চেনে শুধু তারাই কবি উপাধি পাবার যোগ্য। বাকিরা সব ধুলোমাটি। নোয়াখালী অঞ্চলের এই কবি অফিসে এসে বানিয়ে বানিয়ে অনেক কথা বলতেন। বাকপটু শফিক তাকে আরো ফুলিয়ে দিতো। তো সেই জনৈক কবি যেন শফিকের তীব্র রসাত্মক উক্তিতেও হাওয়ায় উড়তে থাকতেন। তিনি দাবি করেন, দেশের মানুষ এখনো গুণী লোকের কদর বোঝে না বলেই তাকে এখনো সাহিত্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কার বা একুশে পদক দেওয়া হচ্ছে না। যেদিন তিনি সাহিত্যে আরও বড় কোনো পুরস্কার পেয়ে যাবেন, তখন কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে এসব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান!
আমি কেবল কৃতজ্ঞ থাকতে পারি, সেই অদৃশ্য এক ক্ষমতার প্রতি। যে আমার মতো ক্ষুদ্র মানুষকে দিয়েও কিছু লিখিয়ে নেয়।
শুধু আমাদের দেশেই যে এই অবস্থা তেমনটা নয়। কবির এই বাম্পার ফলন নিশ্চয়ই পশ্চিমবঙ্গতেও। এই তো করোনাকালে অনুরোধে ঢেঁকি গিলে একটা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে অ্যাড হলাম। সেটা আবার আন্তর্জাতিক কবিদের সম্মেলন। এর মধ্যে একজন আবার পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া থেকে কবিতা পোস্ট করতেন আন্তর্জাতিক স্বভাব কবি নামে। তার কবিতায় থাকতো দেশ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিয়ে তীব্র বিদ্রোহের ছটা। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সমস্যা নিয়েও তিনি ঘণ্টায় ঘণ্টায় একটি কবিতা পোস্ট করতেন গ্রুপে। আরেক কবি নিজেকে দাবি করলেন, বাংলা কবিতায় নতুন ধারার প্রবর্তক হিসেবে। আমাকেও আমন্ত্রণ জানালেন নতুন ধারার অনুসারী হতে। কিন্তু সমস্যা হলো, হাবাগোবা আমি সেই নতুন ধারার মাত্রাবৃত্ত, স্বরবৃত্ত, অক্ষরবৃত্তে হাবুডুবু খেতে খেতে সার্থকতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করতেই, নদে তুমুল গালাগালের বান ডাকলো। সেই বানের তোড়ে অবশেষে আমি নতুন ধারা থেকে ভেসেই গেলাম।
দশফিকের মাধ্যমেই পরিচয় হয়েছিল নেত্রকোনা অঞ্চলের এক কবির সঙ্গে। তিনি পেশায় কৃষক হলেও চমৎকার কবিতা লেখেন। বিভিন্ন গ্রাম্য মারামারিতেও নাকি তিনি সমান পটু। মাঝে মাঝেই মারামারি করে মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে অফিসে আসেন শফিকের কাছে। মুখে বিগলিত হাসি আর পকেটে কবিতা। আবার এমন অনেককেও এ কয় দিনে দেখেছি যারা নিজের বই ছাপতে এসেছেন নিজের টাকা দিয়ে। টাকার কোনো অভাব নেই, চাই শুধু ছাপার অক্ষরে নিজের নাম। মলাট উল্টে এখন সেই বইয়ের ভেতর ছাইপাশ যাই থাক কোন সমস্যা নেই। সব মিলিয়ে আমার সামনে শাহবাগ আর আজিজ মার্কেটটি ছিলো যেন কবিদের হাটবাজার। দেখেছি প্রতিদিন নিত্য নতুন কবি, কবিতা আসছে বন্যার স্রোতের মতো। কিনছে, বিকাচ্ছে, দরদাম করছে, আসলে সব মিলিয়ে পুরো মার্কেটটিতে যেন জমজমাট সাহিত্য সওদার স্থান। এখন আর আজিজে অনেকদিন যাওয়া হয় না। শুনেছি আজিজের সাহিত্য আড্ডা নাকি সড়ে গেছে কাঁটাবনের কনকর্ড টাওয়ারে। তবে সেখানেও যাওয়া হয় না। কিন্তু বিশ্বাস করুন, যেতে ইচ্ছা করে। এই হাটবাজারের কাণ্ডকারখানা আমি কেন যেন উপভোগও করি। আর মিস করি শফিককে।
শফিক হাসান আজ রম্য লেখক হিসেবে বেশ নাম করেছেন। অথচ তার অরম্য গল্পগুলোও যে কত ভালো, তা আমি পড়েছি। একসময় তিনি চমৎকার কবিতাও লিখতেন। সম্পাদনা করতেন ‘প্রকাশ’ নামে একটি লিটল ম্যাগের। এখন শফিক লেখেন কি না, জানি না। তবে দেখা হলে, আজও শফিক হাসিমুখে কবি নিয়ে এমন কোনো একটা কথা বলবেন, যা আমাকে হাসতে হাসতে নস্টালজিক করে তুলবে। আমাকে কবি বা কবিতাবিদ্বেষী ভাবার কারণ নেই। আমি নিজে কবি হতে পারিনি, তাই চারপাশে এত কবি দেখে আসলে আমার হিংসা হয়। কারণ আমি বিশ্বাস করি, যন্ত্রের কলে কিংবা কৌশলে কেউ নিজেকে কবি করে তুলতে পারে না। কবি হয়ে উঠতে হয়। কবিতা শুধু কতগুলো বাক্য সমষ্টি নয়, কবিতা হলো বোধের তোলপাড়, আদর্শের ইঙ্গিতবহ। কবি লেখকরা বিধাতার আমূল আশীর্বাদ ধন্য। তবে হায়, আমার কি আর সেই সামর্থ্য আছে! সাদা খাতার জমিনে নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া আমার কিছুই নেই। আমি কেবল কৃতজ্ঞ থাকতে পারি, সেই অদৃশ্য এক ক্ষমতার প্রতি। যে আমার মতো ক্ষুদ্র মানুষকে দিয়েও কিছু লিখিয়ে নেয়। সে জন্যই আমি অকপটে তার প্রতি হাতজোড় করে বলতে পারি,
আমি অকৃতি অধম বলেওতো মোরে
কম করে কিছু দাওনি
যা দিয়েছ তারি অযোগ্য ভাবিয়া
কেড়েওতো কিছু নাওনি।