জং ধরা রঙের গায়ে আলপনা এঁকে দেওয়ার নাম শিল্প বলি আমি। বরষার উঠোনজুড়ে বুদ্-বুদ বৃষ্টির ফোঁটার সঙ্গে ঢেউ খেলে যাওয়া সাদৃশ্য দেখতে পাওয়ার নামই কবিতা। যদিও কবিতাকে আজো কেউ নির্দিষ্ট সংজ্ঞায় আবদ্ধ করতে পারেনি। না পারার চিত্রে কবিতা এক উচ্চতা সম্পূর্ণ শিল্পের সমাহার। সব রঙের চিত্রালি বহন করেই সে কবিতা হয়ে কবির হাতে ধরা দেয়। কবি কবিতার কাছে প্রীত হয়। নিজেকে সমর্পণ করে কবিতার বিছানায়। প্রত্যেক কবির নিজস্বতা প্রমাণ করে কবিত্ব শক্তির। আর কবিদের হতে হয় প্রেম-ভালোবাসা, হাসিকান্না আর চুপিসারে বহুরূপী। যে রূপের কাছে ধরা দেয় কবিতা আর কবিতার ভেতর আলোড়ন। কবিতার নান্দনিকতা আজও ধরাছোঁয়ার নাগালে এনে কেউ ধরাশায়ী করতে পারেনি। কিন্তু আপনার আলোই আজ কবির পরিচয়। সৃষ্টির মাঝে কবির বেঁচে থাকা। তেমনই একজন কবির সৃষ্টির দরিয়ায় সাঁতার কাটার প্রত্যয়ে দএগোচ্ছি কবিতার শরীর হাতড়িয়ে বেড়াতে। তিনি আর কেউ নন। নব্বই দশকের শক্তিমান কবি জাকির আবু জাফর। কবি জাকির আবু জাফর কখনো প্রকৃতি প্রেম, কখনো মানবপ্রেম, কখনো দেশপ্রমের চাদর গায়ে মেখে মানুষের কথাই বলবার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন।
কবির কবিতা নতুন ঘরে ইতিহাসের খোঁজে পাঠককে ভাবনার অচিন পুরে নিয়েই ছাড়ে। পাঠক মাত্রই পাঠের দৌরাত্বে গিয়ে ইতিহাসের কাছে চোখ ঘসে। কবিতা সেখানে এসে থিতু হয় পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে। কবির ভাষায়,
যে হাটেই হোক আমাদের দিতে হবে সাহসের বিজ্ঞাপন
ভোর থেকে ভোরে বেঁধে দিতে হবে সম্ভাবনার সেতু
সূর্য হেরে যায় এ কথা মানিনি কোনোদিন
আমরা সূর্যকে বুকে চেপে পার হই চেঙ্গিসের সমাধি।
(চেঙ্গিসের মাটির দরোজা: মেঘের মানচিত্র অথবা বনান্তরের দিন)
বর্তমানের চাদরে পা ঘষে অতীতের শিহরণ যেন অনুসরণ করেই চলেছে নিয়ত বর্তমান। নিষ্ঠুর এ পৃথিবীর চোখে রাজ্যের নিষ্ঠুরতা বারবার মানুষের সামনে এসে হাজির হয়। যে সময় যা ঘটুক না কেন, তা ইতিহাসে দালীলিক হয়ে মূর্তমান গ্রহণ করে। একজন কবি বা একজন ইতিহাসবিদের কাজ হলো সময়কে স্মরণে আনতে ইতিহাসের দ্বারস্থ হওয়া। কবি জাকির আবু জাফর এ সময়ের অসঙ্গতিগুলোর মেলবন্ধন দেখতে পাচ্ছেন চেঙ্গিসের শাসনকালের সঙ্গে। কবির ভাষায়,
চেঙ্গিসি খুনের বিরুদ্ধে দলিল হবে মৃত্তিকার মিহিকোষ
এ ছাড়া নিহত স্বপ্নগুলো মাটি ফুঁড়েই বেড়ে উঠবে একদিন
সচিত্র কাহিনী বিবস্ত্র হলে কোথায় পালাবে চেঙ্গিসের চোখ
সকল চোখের রাজত্ব পরাধীনতার যন্ত্রণায় বিদ্ধ হবে সেদিন
(চেঙ্গিসের মাটির দরোজা : মেঘের মানচিত্র অথবা বনান্তরের দিন)
কবি বারবার সময়কে টেনে এনে বর্তমানকে আঘাত করছেন। বর্তমান ক্ষতবিক্ষত না হলে ভবিষ্যতের পথ কিন্তু তৈরি হবে না! কবি তাই রাজত্বের দস্যুতাকে মেনে নিতে পারছেন না বলে পূর্বের দস্যুতার কাছে হাত পেতেছেন! এই দস্যুতার কাছে ইতিহাস অনেক নমস্য,
প্রাসাদের দেহে ঈসা খাঁর আঙুল খুঁজছিলাম আমি
খুঁজছিলাম তার প্রিয় তরবারীর সোনালি আঙটি
যেখানে তিনি গুঁজে দিতেন বীরত্বের মুকুট
স্বাধীন সূর্যের বুক থেকে রোদ কুড়াতেন তিনি
সে রোদেই শুকাতেন সমস্ত রাত্রির হৃদয়
(ঈসা খাঁর আঙুল: তোমাকে ভিজিয়ে দেবো চাঁদের বৃষ্টিতে)
ইতিহাসের আশ্রয় কবিকে নিয়ত পুড়িয়ে মারছে সময়ের অযাচিত কাণ্ড দেখে। কী অসাধারণ উপমায় একজন ঈসা খাঁ-কে টেনে পাঠককে বুঝিয়ে দিলেন ইতিহাসের মর্মকথা, সময়ের প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও বাঁচার উপকরণ। সময়ের প্রয়োজনে জাতি স্বপ্নের চাষাবাদ করে, ভালোবাসে নিজস্বতা। ভালোবাসে বিরহের অঞ্জলিও! কিন্তু যাপিত জীবনের সুখ আর অধিকারের প্রত্যয়ে যে দেশটির জন্ম, তা ভুলুণ্ঠিত হতে দেখলে কবি মাত্রই শিউরে ওঠেন শব্দের মতো বুলেট নিয়ে ম্যাগজিন পূরণ করে বাক্যে ঘটান ব্লাশ্ড। এটার কোনো বিকল্প কবিদের হলেও কবি জাকির আবু জাফর দেশপ্রেমটকেই বুকে আগলে রাখার চেষ্টায় বলেন,
কর্পোরেট সুখ বেঁধে ঝুলিয়েছে গরীবের গলে
স্বপ্ন বিক্রি করে আনে পরাধীন ভোটের বিধান
মহামুক্তি সুখ ভেবে গলে পরে গোলামীর হাত
পূঁজিশক্তি মুক্ত করে জালিমের নিঠুর দুহাত।
(পুঁজিঅন্ধ প্রেম : মেঘের মানচিত্র অথবা বনান্তরের দিন)
নিদারুণ স্বপ্নের চাষে তটস্থ এই কবি পাঠকের কাছে স্বপ্নের ঘুড়ি ওড়ানোকে একটি মাধ্যম মনে করেছেন। কবি মনে করেন বেঁচে থাকতে হলে শক্তের ভক্ত না হয়ে শক্তের যম হওয়ার দৃঢ়তাকে আত্মন্থ করতেই হবে। তাই কবি বলেন,
যাদের সমস্ত হৃদয় জুড়ে ছিলো ছাপ্পান্ন হাজার সবুজ গোলক, তারা তো শহীদ
তারা রক্তমূল্য খরিদ করেছে এই শ্যামলিম প্রান্তর
শহীদের এই স্বপ্নের বাজার লুট করে যারা
আজ তাদের রুখে দেবার দিন
(পূর্ণতা পেয়েছে বাংলাদেশ : মেঘের মানচিত্র অথবা বনান্তরের দিন)
তাজা রক্ত, ইজ্জত সম্ভ্রম এবং জীবন দান করে যারা লাল সবুজের পতাকা হাতে তুলে দিয়ে চির লীন হলেন আজ কিছু দুস্কৃতি জাতির সব অর্জনকে ধুলায় মিশিয়ে দিয়ে ইতিহাস তছনছ করার চেষ্টায় রত। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হুংকার হচ্ছে এ কবিতাটি। কবিতার ভেতর টং টং করে দেখে অশ্রুসিক্ত হৃদয়ের হাহাকারে নির্ভরতার প্রতীক রোপণের প্রত্যয় দেখাতে কোনো ধরণের ভুল করেননি।
কবিরা স্বপ্নবাজ আর স্বপ্ন দ্রষ্টার ভূমিকায় চড়ে এঁকে দেন গ্রাফিকচিত্র। যে চিত্রের কাছে একক স্বপ্নেরা দানা বাঁধলেও কবির উজ্জীবিত স্বপ্নরা এসে সময়কে বাঁচতে শেখায়। কবির ভাষায়,
আমাদের স্বপ্নের ভেতর বেজে উঠলো সেই অহংকার
সেই অনবদ্য রক্তিম সময়ের বিস্ফোরণ
পৃথিবীর মানচিত্রে মুখরিত হলো অজস্র নদীর গুঞ্জন
এবং একটি চির শ্যামল শিহরণ
[…]
নাম লিখে দিলাম বাংলাদেশ
(অতঃপর বাংলাদেশ : মেঘের মানচিত্র অথবা বনান্তরের দিন।
০২.
একজন কবির চোখে কতই না রঙ খেলা করে শব্দের পরতে পরতে। যে শব্দে ভাঙে প্রেমের শরীর। সে শব্দে জোড়া নেয় বিরহীর দুঃখ। চোখের বিরহে যখন পুঁজিবাদের নেংটামো কবিরা তুলে আনেন তখন ভোক্তার চোখে ভাসে বিরংসার চিত্র। ভোক্তা মাত্রই রঙচটা এক কিশোরির বেণীবাঁধা অথবা ফিতায় মুরগের ঝুঁটি তোলার মতো। কবিরা ভেঙে দিয়ে তা দেখান নতুন আগলে। কবির ভাষায়,
বিলবোর্ড আমার তৃষ্ণার্ত দৃষ্টিকে হাতায় খোঁচায় কাতুকুতু দেয়
তাড়ি দিয়ে চাঞ্চল্যের লোভ-পিপাসায় ভোাগাতুর করে
সৌন্দর্যের মসলাপাতি ঢেলে লাবন্যজল আনে আমার ভোগী জিহ্বায়
রুপ মোহে অন্ধ-অন্তর আমার পূঁজিরূপসির হাসির-আঁচলে ঝোলে
দিনভর এবং প্রায় সারারাত
পূঁজিরমণীর বাণিজ্য -বন্দনা প্রতিদিন-
মাখলে সাতদিনেই ফর্সা ত্বক
অথচ হৃদয় ফর্সাকারী ক্রিম বড় বেশী প্রয়োজন
(দিনভর এবং প্রায় সারারাত: মেঘের মানচিত্র অথবা বনান্তরের দিন)
এই সময়ের যাঁতাকলে চড়ে পূঁজিবাদ নিয়ত প্রতারণা করে হাঁতিয়ে নিচ্ছে পকেটের কচকচে মুদ্রা। অথচ বিবেকের সঠিক কর্ষণ নেই বলে অথবা শিল্পের অযাচিত উৎকর্ষের উর্ধ্বগতিশীলতা মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী এসব নির্মমতার স্বীকার হয়ে কাতরায়,পথ হারায়,হননের পথও তরান্বিত করে জানিয়ে দেয় তাদের অসহায়ত্বের কথা! তখন কবির কলম সোচ্চার হয়ে না উঠলে বির কলম নয়,সেটা কবির বিবেক নয়; সেটা হয়ে ওঠে পা চাটা দালালের কবি, লেজুড় কবি, বিবেকশূন্য ভোগীকবির কাজ।
সে ক্ষেত্রে কবি জাকির আবু জাফর তার শব্দ শিল্পের চমৎকার বুননক্রিয়ায় নিয়ে প্রতিবাদের দেয়াল ঠুকে নিজের অবস্থান সাধারণ ও সত্যের পক্ষে পাকাপোক্ত করে কঠিন দৃঢ়তার শক্তি দেখিয়েছেন,
স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে যে রাস্তাটি শাপলার পায়ে এসে
উপুড় হয়ে পড়েছে,এই পথেই হাজার কোটি টাকা
উড়ে গেছে বাংলাদেশ থেকে
আমি অবাক হয়ে রাস্তার কালো দাগ দেখি
দেখি কিভাবে ছিঁড়ে খুড়ে রাস্তার বুক ভেঙে দিলো মাফিয়ারা।
(ডলারের গল্প:রোদেরও আছে অন্ধকার)
আহা! কবি জাকির আবু জাফর শিল্পের চাষে বসে যেন এক অগ্নির কুন্ডলিতে মুখ খসতে আছেন। যে কোনো কবি যখন সুখযাপন ত্যাগ করার চেষ্টারত তখন তার শিল্পের কারখানায় উৎপাদন হবে মজবুতীয় এবং টেকসয়নির্ভর। কবি জাকির আবু জাফর সে বুনিয়াদিতে প্রবেশ করায় তাকেও ঘ্রাস করেছে সেই শিল্পের চাষ। কবির ভাষায়,
বাণিজ্যিক শব্দের ঠোঁটে পুঁজিবাদ লিপস্টিক
ভোগের সকল মাল মসলা এবং বর্গীকাজল পরা মানবাধিকার বুলির সিল সেঁটে
সাফল্যের গল্প এঁকে বসিয়েছে প্রহসনের বাজার
(বহুজাতিক অভিধান: অজস্র বর্ষণে চিরদিন)
৩.
কবি জাকির আবু জাফর খুব সচেতনভাবে তার কাব্যকাননে পদার্পন করার চেষ্টা করেছেন। মেদহীন শব্দ চাষে খুব মনোযোগি হওয়ায় তার উপমা গুলো পাঠকের হৃদয়গ্রস্থ হতে সক্ষম হয়েছে। পাঠক মাত্রই তার উপমাময় বাক্যের নীড়ে ঢুঁ মারতে বাধ্য হয়। বাক্যগুলো পাঠকের হৃদয়ছুঁয়ে মুখরোচকে পরিণত হতে চলেছে। যদিও উপমাময় বাক্যগুলো কখনো প্রেম, কখনো বিরহ, কখনো প্রতিবাদের মন্ত্রের মতো পাঠান্তের শিল্পে রুপ নিয়েছে। সে রকম কয়েকটি বাক্য হলো,
হে আমার প্রেম পাখি ভুলে যদি যাও- যাও
মনে রেখো তবে হৃদয়ের মতো কোনো রাজ্য নেই
(হৃদয়ের মতো রাজ্য নেই: মেঘের মানচিত্র অথবা বনান্তরের দিন)
কোনোদিন ভাবিনি বর্ষার প্রথম বর্ষণ নিয়ে
আমি রমণীর চোখে সাজাবো অশ্রুর উপমা
(কাজল মেঘের সন্ধ্যায়: মেঘের মানচিত্র অথবা বনান্তরের দিন।)
পৃথিবীকে পাশে ঠেলে
অঝর বর্ষণে ভাসিয়ে দাও আমার তৃষ্ণাকাতর নদীর হৃদয়
এই শীতার্ত সন্ধ্যার আর্শিতে দেখে নেবো তোমার হৃদয়
(শীতার্ত সন্ধ্যার আর্শিতে: মেঘের মানচিত্র অথবা বনান্তরের দিন)
রক্তচক্ষু ভক্ত করি কব্জা করি ক্ষমতার হাত
স্বার্থের স্বপক্ষে আছে ক্ষুরধার পুঁজির করাত
(পুঁজির করাত: মেঘের মানচিত্র অথবা বনান্তরের দিন)
সুশীল বাজারে আজ অতি কম বিবেকের দর
আরো ভয়াবহ কম দেশে দেশে খুনের খবর।
(অতীত আগুন: মেঘের মানচিত্র অথবা বনান্তরের দিন)
অবাধ্য চোখের জলে ভাসে যদি নয়নের তীর
ভেবে নিও এ আমার অতিজল অধিক সুখের
(অবাধ্য চোখের জল: মেঘের মানচিত্র অথবা বনান্তরের দিন)
চারিদিকে পূঁজিজ্বর থরোথরো সভ্যকার বুক
প্রেমের নিটোল দেহে ভয়াবহ পুঁজির চাবুক
(পুঁজিঅন্ধ প্রেম : মেঘের মানচিত্র অথবা বনান্তরের দিন)
দীর্ঘমেয়াদাী কিস্তিতে জোছনাও আমার ঘরমুখী
এখন তোমাকে ভিজিয়ে দেবে চাঁদের বৃষ্টিতে
(তোমাকে ভিজিয়ে দেবো চাঁদের বৃষ্টিতে: তোমাকে ভিজিয়ে দেবো চাঁদের বৃষ্টিতে)
আঁধার থেকে কুড়িয়েছি পৃথিবীর মুখ
[…]
রাতের বোতাম খুলে চিরে দেখি জমাট জীবন
(আধার থেকে কুড়িয়েছি পৃথিবীর মুখ: রোদেরও আছে অন্ধকার)
একজন কবি মানে একটা ইতিহাসের ধারক বাহক। ইতিহাসের দায় যে কবি নিতে পারবে না তথা বহন করতে পারবে না সে কবি নিশ্চিত ব্যর্থ। সে কবি অচিরেই হারিয়ে যাবে পাঠকহীন অরণ্যে। যে অরণ্যের দোহায় দিয়ে মানুষ বলে আসছে, “বন্যেরে বনে সুন্দর,শিশুরা মাতৃ কোড়ে”। তদ্রূপ প্রাণহীন কবিতার শরীর নিয়ে কবির যাপন হবে ঐ বনের মাঝে। কবি জাকির আবু জাফর তার রক্তের ঘ্রাণ নিয়ে বেঁচে থাকতে চেয়েছেন কবিতার জমিনে। বাঙালি রক্তের তরী বেয়ে মাতৃভাষার দাবি যেমন পেয়েছে, তেমনি পেয়েছে ভাষার জাতিগত অধিকার তথা স্বাধীনতা। দুটোই আজ বিশ্বের মাঝে সমাদৃত। বাংলাভাষা আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষায় রূপ নিয়ে এ জাতির সম্মান বয়ে বেড়াচ্ছে। আর এ অর্জনগুলোর পেছন বাংলার কবিদের অবদানই বেশি। এ যাত্রায় বাংলাভাষার ব্যবহার্য সারা বিশ্বকে অবাক করে দিয়েছে। বাংলা ভাষার ভেতর মৃত্তিকার ঘ্রাণ রয়েছে। যা অনেকটা আউশ ধানের ভাতের মাড়ের ঘ্রাণের মত। মুগ্ধতা ছড়ায়। শেকড়ে পৌঁছায়। কবির ভাষায়,
আমি এক অন্য উদ্বোধনে ভাসি ভাবি
এখন আমার মাতৃভাষা এই সুকেশিনীর মতো আন্তর্জাতিক
লাল ঠোঁটে শ্যামল উচ্চারণ এক বৈশ্বিক প্রেমের আকাশ
তুলে দিলো আমার আকাশে
আমি পৃথিবীর সব মানুষের ঠোঁটে লেপে দিলাম
আমার মাতৃভাষার কৃষ্ণাচূড়া রঙ
(লালঠোঁটে শ্যামল উচ্ছারণ : তোমাকে ভিজিয়ে দেবো চাঁদের বৃষ্টিতে)
কবিতায় মানুষের বেঁচে থাকার ইচ্ছে জাগানিয়ার রূপ দিতে পারে একমাত্র কবি। কবিরাই স্বপ্নের চাষ বসায়। পাঠক আর সময় তার জোগান দিয়ে দূর বহুদূর নিতে সক্ষমতা খোঁজে। খুঁজে নেওয়া চাবির ভূমিকায় কবি বারবার কখনো স্থান-কাল-পাত্রের কাছে পাঠকে রসদ দেখান আর কখনো সাহসের শোকেসে বসিয়ে দেখান বিজয়ের চিত্র। কবি জাকির আবু জাফর সদ্য প্রয়াত কবি আল মাহমুদের সেই স্বপ্নদ্রষ্টার ভূমিকায় নিজের কলমের চাপ বসাতে কোনো কসুর করেননি। করেননি কার্পণ্য। তার ভাষায়,
আমার বুকে পদ্মা নদীর ভাঙন আছে
বুড়িগঙ্গা নদীর নীরব কান্না আছে
অবাক করা প্রেমের শেয়ার বাজার আছে
আমার কাছে ইতিহাসের দরজা খোলার চাবি আছে।
(প্রেমের শেয়ার বাজার : তোমাকে ভিজিয়ে দেবো চাঁদের বৃষ্টিতে)
ঠিক অন্য কবিতায় সাহসটাকে তুলে ধরে পাঠককে দেখিয়ে দিচ্ছেন সম্মুখে হাঁটার সূত্র। যে সূত্রে মিলে যায় সমাধান। কবির ভাষায়,
মৃত সব স্বপ্নকে দেখাও আকাশ
আশা দিয়ে রুয়ে দাও তাকে
পরমাণু শক্তির পৃথিবী দেখুক
স্বপ্নরা জেগে ওঠে সাহসের ডাকে।
(এই হাতে হাত তুলে দাও : তোমাকে ভিজিয়ে দেবো চাঁদের বৃষ্টিতে)
কবিদের প্রেমের চিত্রাবলির শেষ নেই। কবি কখন কোন দৃশ্যের আড়ালে চড়ে এঁকে যান বিদেহী ডুকরে কাঁদার করুন সুর। যে সুরে কবি হয়ে ওঠেন সুরের ঝংকার। কবির এ সুরে থাকে শব্দ, বাক্য আর উপমার মিশলে এক নতুন জগৎ। তেমনি এক চিত্রকর্মের কাছে কবি জাকির আবু জাফরও থিতু হতে বাধ্য হয়ে লিখলেন এক অমরবাক্য তথা অমরকাব্য। যে কাব্যে কবিকে চেনা যায় অন্যরূপে,
লিওনার্দো ভিঞ্চির সেই বিস্ময়কর তুলিটিই আমি খুঁজছি বহুকাল
যে তুলির ঠোঁট এঁকেছিলো মোনালিসার মুখভর্তি যৌবনের উল্লাস
যে তুলির তারুণ্য গড়ে দিলো মোনার বিরল শরীর ও সহাস্য উত্তাল প্রেমের কম্পন
(মোনালিসার ভ্রূ : অজস্র বর্ষণে চিরদিন)
কবি জাকির আবু জাফর একজন রুচিশীল প্রেমিক পুরুষও বটে। প্রেমের রঙ তার কাছে ধরা দিয়েছে শিল্পের হাতল ধরে। কবি যাপিত জীবনের কাছে তার প্রেমের শৈল্পিকতাকে দিয়েছেন বন্ধক। উপমার ব্যবহার তাই প্রমাণ দিয়েছে তার কবিতায়।
এ কবির শিল্পবোধের চরাচরে ছড়া কবিতা,কিশোর কবিতা, উপন্যাস,প্রবন্ধ সব যেনো গন্ধবণিকের ভূমিকায় পতিত। তার গীতিকবিতাগুলো হয়ে উঠছে একেকটা অন্ধকারে আলোর জলক। মুগ্ধতায় ছুঁয়ে যায় গোলাপের পাঁপড়ির মতো অন্ধকারের আকাশ।
কবি জাকির আবু জাফর নিজেকে সচেতনভাবে শব্দ, বাক্য, উপমা, উৎপ্রেক্ষার কাছে সঁপে দিয়ে স্থায়ী আসন গেঁড়ে বসার সাহস দেখিয়েছেন। কবিতার সঙ্গে কোনো ধরনের ছলচাতুরী যেমন করেননি, তেমনি নিজের সঙ্গে করেননি শঠতা। আজকাল থেকে শুরু করে প্রায় কালেই কবিরা কবিতার আড়াল দেহে বসে রঙের নকশী বুনতে গিয়ে হারিয়ে গেছে অনায়াসে। কারণ সময় কাউকে ক্ষমা করে না। কবিতার নিজস্ব চলার গতি আছে, রাস্তা আছে। আছে কবিতার বসবাসের নিজস্ব আশ্রয়স্থল। এ ক্ষেত্রে এ কবির কোনো ত্রুটি তার কবিতার দেহে পড়েনি। খুব সচেতন ভাবে কবি দাগ পড়তে দেয়নি। বরং কবিতাকে নিয়ে স্ট্রাইকারের ভূমিকায় ছোটো ছোটো চালে খেলে নিজে মজা লুটে পাঠকের কাঁধে তুলে দিয়েছেন ভবিষ্যতের সামিয়ানা।