আল মাহমুদের কাছে বাঙালির ঋণ


আল মাহমুদ কবি, মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত। তিনি বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কবিদের একজন। প্রায় ২০ বছর আগে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের একটি অনুষ্ঠানে তাঁর সম্পর্কে বলেছিলাম, তিনি বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ জীবিত কবি। আমি অকপটে মনের কথাটিই বলেছিলাম। ঝুঁকি নিয়েই বলেছিলাম। ১১ জুলাই তাঁর জন্মদিন। তাঁকে অভিনন্দন। তাঁর যে কবিতাটি প্রথম আমাকে আনন্দ দিয়েছিল, পড়ে দেখুন তো কেমন লাগে:

কবিতা বোঝে না এই বাঙলার কেউ আর
দেশের অগণ্য চাষী, চাপরাশি
ডাক্তার উকিল মোক্তার
পুলিশ দারোগা ছাত্র অধ্যাপক সব
কাব্যের ব্যাপারে নীরব!

স্মাগলার আলোচক সম্পাদক তরুণীর দল,
কবিতা বোঝে না কোনো সঙ
অভিনেত্রী নটীনারী নাটের মহল
তার মনে কতোটুকু রঙ?
ও পাড়ার সুন্দরী রোজেনা
সারা অঙ্গে ঢেউ তার, তবু মেয়ে
কবিতা বোঝে না!
কবিতা বোঝে না আর বাঙলার বাঘ,
কুকুর বিড়াল কালো ছাগ
খরগোশ গিরগিটি চতুর বানর,
চক্রদার যত অজগর।
কবিতা বোঝে না এই বাঙলার বনের হরিণী
জঙ্গলের পশু-পাশবিনী।
শকুনি গৃধিনী কাক শালিক চড়ুই
ঘরে ঘরে ছুঁচো আর উই,
বাঙলার আকাশের যতেক খেচর
কবিতা বোঝে না তারা। কবিতা বোঝে না অই
বঙ্গোপাসাগরের কতেক হাঙর!

কবে পড়েছিলাম, ঠিক মনে নেই। সেই বিখ্যাত সমকালেই সম্ভবত পড়েছিলাম। তখনো আমি ছাত্র। মনে হয়, যতটুকু মনোযোগ তিনি প্রত্যাশা করেছিলেন, তা পাননি, তাই তাঁর প্রকাশের মধ্যেও শুধু ঠাট্টা-ইয়ার্কি নয়, অবস্থার পরিবর্তন চান বলেই সেই প্রত্যাশায় এই রচনা। সম্ভবত বিশুদ্ধ কবিতার তালিকায় হালকা মেজাজের এই লেখাটির ঠাঁই হবে না।

বলতে দ্বিধা নেই তখন থেকেই তাঁর কবিতা আমার প্রিয়। তখন খুব তাস খেলতাম। ব্রে অসম্ভব প্রিয় ছিল, এখন বোধ হয় ব্রে ভুলে গেছি। তার ‘ব্রে’ কবিতাটি পড়ে মনে হয়েছিল, এই তো আমার কবি।

আমি যখন ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের, তখনই তাঁর সঙ্গে আমার আলাপ। তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘লোক লোকান্তর’ বের হয় কপোতাক্ষ থেকে। কয়েকজন বন্ধু মিলে গড়া এই প্রতিষ্ঠানটি, কপোতাক্ষ স্মরণীয় হয়ে থাকবে এই বইটি প্রকাশ করার জন্য। আবদুস সাত্তারের ‘আরবী কবিতা’, জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের গল্পের বই ‘রংবাজ ফেরে না’ এই প্রতিষ্ঠান থেকেই বের হয়। রফিক আজাদ, হাশেম খান, শহীদুর রহমান, শাহজাহান সাহেব, হেলাল সাহেব ছাড়াও মুহম্মদ আখতারের মতো মুদ্রণশিল্পে নান্দনিকতার পথিকৃৎ এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এর প্রকাশনা উৎসব হয়েছিল বাংলা একাডেমিতে। সৈয়দ আলী আহসান, সিরাজউদ্দিন হোসেন, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ শুধু নন, ষাটের অধিকাংশ কবিই সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

সোনালি কাবিন সনেট দি সিকোয়েন্স চট্টগ্রাম লেখা। আমি তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া, আমার সৌভাগ্য তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু মোহাম্মদ মুসা আর আমি বোধহয় বেশ কয়েকটি কবিতার প্রথম শ্রোতা। আনন্দে গর্বে বুক ফুলে উঠছিল আমার, আমার সেই অবস্থা দেখে তিনিও খুশি হয়েছিলেন। গোর্কির ওপর একটি অনুষ্ঠান হয়েছিল তিতাস সাহিত্য পরিষদের উদ্যোগে। তিনি টাটকা নতুন কবিতা পড়লেন, প্রথম পঙ্ক্তিটি মনে আছে, ‘ভাতের গন্ধ, নাকে এসে লাগে ভাতের গন্ধ’।

কাজী পাড়ার সেই ছোট ঘরে নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান আর আল মাহমুদ দেশ, সমাজ ও কবিতা নিয়ে আলাপ-আলোচনা তক-বিতর্ক করছেন। আমি গিলছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় হঠাৎ করেই তাঁর সঙ্গে দেখা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একটা চিরকুট আমার কাছে দিয়ে কবিকে নিয়ে মিলগেট প্রেসে যেতে বললেন। আল মাহমুদের হাত একেবারে খালি। মিলগেটের ওই ভদ্রলোক তাঁর হাতে টাকা তুলে দিলেন, সোনালি কাবিন অথবা শ্রেষ্ঠ কবিতা বের হবে। বিজয় অর্জনের পর তিনি গণকণ্ঠের সম্পাদক পদটি গ্রহণ করেন। শুধু আমিই নই, অনেকেই এই পত্রিকায় লিখেছিলাম। গণকণ্ঠকে ঘিরে একটি আড্ডা। দিলওয়ার, নির্মলেন্দু গুণ, আবু কায়সার, মাশুক চৌধুরী। না, কুলুবে না। অনেক হয়েছে। এবার তার একটি কবিতা পড়ুন:

আঘ্রাণ
আজ এই হেমন্তের জলদ বাতাসে
আমার হৃদয় মন মানুষীর গন্ধে ভরে গেছে।
রমণীর প্রেম আর লবণসৌরভে
আমার অহংবোধ ব্যর্থ আত্মতুষ্টির ওপর
বসায় মর্চের দাগ, লাল কালো
কটু ও কষায়।

প্রতিটি বস্তুতে দেখি লেগে আছে চিহ্ন মানবীর
হাওয়ায়, জলের ঢেউয়ে, গুল্মের স্তবকে স্তবকে
বইছে নারী ঘ্রাণ কমনীয় যুগান্তসঞ্চারি।
গণ্ডুষে তুলেছি জল, টলমল—
কার মুখ ভাসে?
কে যেন কিশোরী তুমি আমারি কৈশোরে
নেমেছিলে এ নদীতে। লেগে আছে
তোমারি আতর।

হে বায়ু, বরুণ, হে পর্জন্য দেবতা
তোমাদের অবিরল বর্ষণে ঘর্ষণে
যখন পর্বত নড়ে, পৃথিবীর চামড়া খসে যায়
তবু কেন রমণীয় নুন, কাম, কুয়াশার
প্রকৃতির গন্ধ লেগে থাকে?
হে বরুণ, বৃষ্টির দেবতা।

আল মাহমুদ কত অনায়াসেই বিভিন্ন ধর্মের অনুষঙ্গ কবিতায় গ্রহণ করেছেন। বৃষ্টির দেবতা নয়, তাঁর সোনালি কাবিনের একটি পঙ্ক্তি মনে পড়ে: ‘বৃষ্টির দোহাই বিবি তিল বর্ণ ধানের দোহাই।’ আল মাহমুদের নারীবন্দনা আমার ভীষণ প্রিয়। আরেকটি কবিতা পড়ুন:

প্রতিতুলনা
আমার উদ্ভাবনার টেবিল জুড়ে তোমার আনাগোনা। আঙুল
নড়ছে আর ফুটো হয়ে যাচ্ছে উপমা। আমি পারি না
তবুও চায়ের কাপের সাথে, পারি না, তবুও ফুলদানির কাছে
সিদ্ধ ডিমের সাথে তোমার মুখকে রাখলাম।

মাংস রান্না হচ্ছে, শিশুদের চোখে খুশি। বলবো না যে
গ্যাসের নীলাভ শিখার সাথে তোমাকে এক করা যেতো।
নদীর সাথে? না। পাখি কিংবা গোলাপও নয়।
তার চেয়ে এসো শোকেসে মদিনার কাঁসার কারুময়
পাত্রটিতে তোমার ভেজা মুখকে সাবধানে বসিয়ে দিই।
সমুদ্রের কথা আমি কেন ভাবতে যাবো। কেন বলবো যে
পুঞ্জীভূত মেঘমালা তোমাকে অতিক্রম করে গেলো।
কেন যাবো উত্তরের বাতাস দক্ষিণে ফিরিয়ে আনতে, না।
দেখো একটি বিমান মেঘের নির্লিপ্ততাকে ছাড়িয়ে
রানওয়ের দিকে কাত হয়েছে। তোমার বাঁকানো
গ্রীবাকে এইভাবে বর্ণনা করা যায়। যায় নাকি?

একদিন দিল্লি পুরানো কিল্লার মস্তক ছুঁয়ে
সূর্য ডুবে গেলে আমি খাঁটি বিদেশির মতো আকাশের
লাল আভাকে রক্তের মধ্যে লুকিয়ে ফেললাম।
এখন এই বৈদিক বর্ণচ্ছটাকে কি করে বলি যে
নারীর কণ্ঠদেশ হও?

বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের কবিতায় যে অনুষঙ্গ, তাঁর সঙ্গে মিলবে না, তবে একেবারেই মিলবে না কেমন করে বলি। সেখানকার লেখা ‘প্রতি অঙ্গ লাগি কাঁদে প্রতি অঙ্গ মম’ ভাবুন।

শুধু নারীবন্দনা নয় দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতি গভীরতম শ্রদ্ধা, দেশকে জানার চেষ্টা, অর্থনীতি, বাণিজ্য, রাজনীতি, কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজ, এসব বিষয় তাঁকে আকৃষ্ট করতে থাকে। একসময় কত অবলীলায় গীতাঞ্জলী অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের পূজা-পার্বণের গান থেকে হাফিজ-রুমি, ফার্সি মরমি কবি, আত্মজিজ্ঞাসা, এসবে মুক্তি খোঁজার চেষ্টা। বলা যায়, পুরো ছয়-এর দশকটি শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী, আবদুল মান্নান সৈয়দ, রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, আবুল হাসান; সমাজ ও দেশকে বাতিঘরের মতোই আলো দিচ্ছিলেন। তিনি কখনোই আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভোগেননি। খনা যেমন তাঁর বিষয় হয়ে ওঠে, তেমনি বখতিয়ারের ঘোড়া, মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো। শুধু কবিতায় নয়, গল্প-উপন্যাস এবং গদ্য রচনায় এসব পরিচয় পাওয়া যাবে। হয়েছে, এবার একটু পড়ুন।

কেমন নিবদ্ধ হয়ে থাকে তারা মৃত্তিকা সন্তান আর শস্যের ওপরে
পুরুষের কটিবন্ধ ধরে থাকে কত কোটি ভয়ার্ত যুবতী
ঢাউস উদরে তারা কেবলই কি পেতে চায় অনির্বাণ জন্মের আঘাত।
মাংসের খোড়ল থেকে একে একে উড়ে আসে আত্মার চড়ুই
সমস্ত ভূগোল দ্যাখো কি বিপন্ন শব্দে ভরে যায়
ভরে যায়, পূর্ণ হতে থাকে।
এ বিষয় বর্ণনায় আমি কি অন্তত একটি পঙ্ক্তিও হবো না
হে নীলিমা, হে অবগুণ্ঠন?
লোকালয় থেকে দূরে, ধোঁয়া অগ্নি মশলার গন্ধ থেকে দূরে
এই দলকলসের ঝোপে আমার কাফন পরে আমি কতকাল
কাত হয়ে শুয়ে থেকে দেখে যাবো সোনার কলস আর বৃষের বিবাদ?

সেই সময়ের আরেকটি লেখা পড়ে দেখুন:

শুনুন, রবীন্দ্রনাথ আপনার সমস্ত কবিতা
আমি যদি পুঁতে রেখে দিনরাত পানি ঢালতে থাকি
নিশ্চিত বিশ্বাস এই, একটিও উদ্ভিদ হবে না
আপনার বাংলাদেশ এ রকম নিষ্ফলা, ঠাকুর!

কোথায় ঊনসত্তর আর কোথায় ২০১৫; সৎ সাহিত্যের অভাবে চটুল বিনোদনে দেশ ভরে যাচ্ছে। ফসলের সুষম বণ্টন তাঁর দাবি, আবার নিজেকে তন্ন তন্ন করে জানার চেষ্টা, অধ্যয়ন আর পর্যবেক্ষণ— দেশ ও সমাজের খুঁটিনাটি বিষয় সাংবাদিক হিসেবে খোঁজার পাশাপাশি, বুক ঠুকেই বলতে পারি, তিনি যে আমাদের গ্রাম আর নদী পাঠ করেছেন, ফুল ও পাখি পাঠ করেছেনÑ নীলিমা অধ্যয়ন করেছেনÑ আহ্, বারুদমাখা বর্ণমালায় তারই নান্দনিক প্রকাশ।

কেমন করে একাত্তরে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় বেঢপ মাপের ধর্ম পুস্তকের সাইজে ‘সোনালি কাবিন’ বের করে পকেটে নিয়ে ঘুরতেন। তাঁর তো কাবিনের ঝামেলা বা অভিজ্ঞতা থাকার কথা নয়? তাঁর রিশতাদারি নজরুলের সঙ্গে এখানেই। আর গ্রামীণ আবহে মনে পড়তেই পারে দুই অগ্রজ জসীম উদ্দীন আর আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর কথা।
(রচনাকাল: ২০১৫)