কবিতা যাকে আয় আয় বলে ডাকবে চিরদিন


বাংলা কবিতায় আল মাহমুদ যে শক্তি নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন, তা রীতিমতো বিস্ময়-জাগানিয়া। রবীন্দ্রবলয় ভেঙে তিরিশের কবিরা বাংলা কবিতার মাস্তুল পশ্চিমের দিকে ঘুরিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন। আল মাহমুদ আধুনিক বাংলা কবিতাকে বাংলার ঐতিহ্যে প্রোথিত করেছেন মৌলিক কাব্যভাষার সহযোগে। তাঁর সহযাত্রী শামসুর রাহমান, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখের তুলনায় এইখানে তিনি ব্যতিক্রমী ও প্রাগ্রসর, বাংলাদেশের সোনালি সংস্কৃতি-পানকৌড়ির রক্তমাখা।

আল মাহমুদ মাটিঘেঁষা অনুভূতিতে নিজের অভিজ্ঞতাজাত গ্রামীণ শব্দপুঞ্জ, উপমা-উৎপ্রেক্ষা এবং চিত্রকল্প সংশ্লেষ করে আধুনিক বাংলা কবিতার নতুন দিগন্তরেখা টেনেছিলেন। একই সঙ্গে তিনি কথাসাহিত্যে তাঁর মৌলিকশৈলীর স্বাক্ষর রেখেছেন।

আল মাহমুদ মানেই তো ‘আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে যাওয়া’র গল্প দিয়ে কবিতার শুরু। আল মাহমুদ মানেই তো ‘কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার’ কিংবা ‘ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ দুপুরবেলায় অক্ত/বৃষ্টি নামে বৃষ্টি কোথায় বরকতের রক্ত/ হাজার যুগের সূর্যতাপে জ্বলবে এমন লাল যে, সেই লোহিতেই লাল হয়েছে কৃষ্ণচূড়ার ডাল যে।’

আল মাহমুদের প্রেমের কবিতার জুড়ি মেলা ভার ‘আমার ঘরের পাশে ফুটেছে কি কার্পাশের ফল?/গলায় গৃঞ্জার মালা পরো বালা, প্রাণের শবরী,/ কোথায় রেখেছো বলো মহুয়ার মাটির বোতল/ নিয়ে এসো চন্দ্রালোকে তৃপ্ত হয়ে আচমন করি।/ ব্যাধের আদিম সাজে কে বলে যে তোমাকে চিনবো না/ নিষাদ কি কোনদিন পক্ষিণীর গোত্র ভুল করে?’ এমন শব্দ জাদুময়তার ভেতর দিয়ে আল মাহমুদ তাঁর পাঠকদের চমকিত করে গেছেন গত পঞ্চাশ বছর ধরে। ‘সোনার দিনার নেই, দেনমোহর চেয়ো না হরিণী’র ‘সোনালি কাবিন’ আল মাহমুদকে এনে দিয়েছে তুমুল কবিখ্যাতি। আল মাহমুদের কবিতা ভিন্ন বাঁক নেয় মূলত ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’র ভেতর দিয়ে। আল মাহমুদের আদর্শগত চেতনারও পরিবর্তন হয় এ সময়। ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’ ও ‘আমি, দূরগামী’তে তিনি মোহামেডানিজম বা ইসলামের প্রতি গভীরভাবে অনুরক্ত হয়ে পড়েন। সেই চেতনারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে এ কাব্যে। পরবর্তীকালে ‘প্রহরান্তের পাশ ফেরা’, ‘আরব্য রজনীর রাজহাঁস’, ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ প্রভৃতি কাব্যেও তিনি এ চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটান।

১৯৭১-এ বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের পর তিনি দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। নব্বই দশক থেকে ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে ইসলামের অনুবর্তী হয়ে তিনি দেশের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীমহলের তীব্র সমালোচনা সহ্য করছেন, মৃত্যুর পরও করছেন।

তবে কী করে অস্বীকার করা যাবে তাঁর কবিতায়-কবিতায় হরফে হরফ ঘষে জ্বালিয়ে-রাখা তাঁর প্রাণের, প্রেমের, এমনকি সংগ্রামের আগুন, যা আমাদের পরিচিত জনপদের ইতিহাসেই জ্বলতে থাকে, কেবল জ্বলতে থাকে। তাঁর অসাধারণ নান্দনিক গুণসমৃদ্ধ, অতি পরিচিত, মুখে-মুখে-ফেরা কবিতাগুলোর বাইরে গিয়েও তাঁর অনন্য কবিতা বাংলা কবিতার পাঠক ভুলবে না। ‘ধ্বংস যদি করবে তবে, শোনো, তুফান/ ধ্বংস করো বিভেদকারী পরগাছাদের;/পরের শ্রমে গড়ছে যারা মস্ত দালান/ বাড়তি তাদের বাহাদুরী গুঁড়িয়ে ফ্যালো।’ (বোশেখ, সোনালি কাবিন)

স্পন্দমান আবেগের ভূগোল, দেশজ চেতনা, লোককাহিনি ও ঐতিহাসিক ঘটনাবলির সৌন্দর্যে আপ্লুত আল মাহমুদ একজন মিথলজিক্যাল রোমান্টিক কবি। যেমন তিনি তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতাকর্ম ‘সোনালি কাবিন’-এ মাতৃভূমির ইতিহাস খনন করে তুলে এনেছেন ঐশ্বর্যময় ও বীর্যবান অনুষঙ্গসমূহ। তিনি এখানে শক্তিমত্তার সঙ্গে রোমান্টিসিজম প্রবেশ করিয়েছেন যা ‘সোনালি কাবিন’ সনেটগুচ্ছকে করেছে মহিমান্বিত।

‘সোনার দিনার নেই, দেনমোহর চেয়ো না হরিণী/ যদি নাও, দিতে পারি কাবিনহীন হাত দুটি/ আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণ কোনকালে সঞ্চয় করিনি/ আহত বিক্ষত করে চারদিকে চতুর ভ্রুকুটি;/ ছলনা জানি না বলে আর কোন ব্যবসা শিখিনি।’ ‘সোনালি কাবিন’ সনেটগুচ্ছে কবি উপমা-রূপকের চর্চার কুশলতার যে নিদর্শন রেখেছেন, আমাদের কবিতার ক্ষেত্রে তা নতুন এবং আন্তরিক সততায় উজ্জ্বল। গ্রামের মাটি থেকে বিচিত্র আকুল আগ্রহকে কবি উন্মোচন করেছেন, নদীর চরের প্রতি কৃষাণীর পতির অধিকার প্রতিষ্ঠার রূপকল্পে প্রমাণিত হয়েছে নারীর প্রতি পুরুষের আকাক্সক্ষার ক্ষুধার্ত নদীর উপমায় নর-নারীর কামনার চিত্র ফুটে উঠেছে। এই তো আমাদের আল মাহমুদ এবং তাঁর গ্রামীণ প্রান্তরের উপঢৌকন যেখানে যৌনতার আন্তরিক অভিব্যক্তি ঘটেছে ‘ক্ষুধার্ত নদীর মতো তীব্র দুটি জলের আওয়াজ/তুলে মিশে যাই চলো অকর্ষিত উপত্যকায়।’

বাংলাদেশের কবিতার মেজাজ ও মন বুঝতে হলে আল মাহমুদের কবিতার দরজায় কড়া নাড়তেই হবে। কামের প্রকাশে আল মাহমুদ প্রেমিক ‘তারপর তুলতে চাও কামের প্রসঙ্গ যদি নারী/ খেতের আড়ালে এসে নগ্ন করো যৌবন জরদ/ শস্যের সপক্ষে থেকে যতটুকু অনুরাগ পারি/ তারো বেশি ঢেলে দেবো আন্তরিক রতির দরদ।’ (সনেট ১০)

একজন কবির বড়ত্ব তাঁর কাব্যভাষা, চিত্রকল্প এবং ছন্দের নতুনত্বে। আল মাহমুদের বড়ত্ব তাঁর নিজস্ব বাকরীতি প্রবর্তনে এবং অদ্ভুত সুন্দর চিত্রকল্প নির্মাণে। সৌন্দর্য বিভায় উদ্ভাসিত তাঁর কবি হৃদয় সর্বদা সুন্দরের পূজারি। তিনি তাঁর কাব্যে বহু বিচিত্র বিষয়ের চিত্রকল্প নির্মাণ করেছেন আল মাহমুদের নারী অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক, কামোদ্দীপক ও সৌন্দর্যময়; মাটি তাঁর কাছে সেই নারী যে জলসিক্ত সুখদ লজ্জায় নিজেকে উদাম করে। তিনি শুনতে পান মেঘনার জলের কামড়ে ফসলের আদিগন্ত সবুজ চিৎকার। অভাবের অজগর তার টোটেম। যে কিসিমে শিষ্ট ঢেউয়ের পাল রাতের নদীতে ভাসা পানকৌড়ি পাখির ছতরে ছলছল ভাঙে সে কিসিমেই তিনি তার বানুর গতরে ঢালেন চুমো। আল মাহমুদ নারী স্তনের সৌন্দর্য কল্পনা করেন, ‘শঙ্খমাজা স্তন দুটি মনে হবে শ্বেতপদ্ম কলি’ (সিম্ফোনি : লোক লোকান্তর) কিংবা মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো তে তিনি লেখেন ‘তার দুটি মাংসের গোলাপ থেকে নুনের হাল্কা গন্ধ আমার’। যৌনতাকে আল মাহমুদ কবিতায় প্রতীকের মতো জঘন, গহরফলক, উষ্ণ কালসাপ, নরম গুল্মের কৃষ্ণ সানুদেশ, চরের মাটির মতো শরীরের ভাঁজ, ত্রিকোণ কর্দম, গূঢ় রাত, ত্রিকোণ মৃণ¥য়ী, মূত্রভেজা যোনির দেয়াল, যৌবন জরদ এমন সব দারুণ উপমায় সুশোভিত করেছেন।

যৌনতায়, ভালোবাসায় জীবনচর্চায়, বাংলা কবিতার পাঠককে তাই আল মাহমুদকে না পড়ে উপায় নেই। জন্মদিনে কবি আল মাহমুদের প্রতি তাই সেই ভালোবাসারই খণ্ডাংশ, যা তিনি জীবদ্দশায় পেয়েছেন। কিভাবে একজন কবি শুধু তার কবিতার জন্য কতদূর প্রেম পেতে পারেন, একজন কবি কত অনায়াসে ম্যাজিক তৈরি করতে পারেন, একজন কবি কত সহজে তার কৌমসমাজকে স্পষ্ট করতে পারেন একটি মাত্র জীবদ্দশায়, তাঁকে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। বাংলা কবিতার যে পাঠক-লেখকরা তাঁকে জীবনে পড়েছেন ও দেখেছেন, সাহচর্য পেয়েছেন তারা ভাগ্যবান, ভাবতে ভালো লাগে তাদের একজন হিসেবে আমারও আছে সেই শ্লাঘা।