-ধরো, যদি একবার আইসতো শেখের বেটি। যদি একবার নিজা চউখে দেহ বার (দেখবার)পারতো আমি তরে বাজি ধইরে বইলবার পারি রে বেটি হ্যায় ঠিক এই বিরিজটা করবার নাগি হুকুম দ্যাতো৷ কিন্তু তারে পাবো ক’নে ক’ দেহি ?
সালমা চুপচাপ বাজানের কথা শোনে। উত্তর দেয়া বৃথা । কারন সালমা এখন যাই বলুক বাবার কানে পৌঁছুবে না। তাঁরে ক’নে পাওয়া যাবে এই চিন্তা বাবাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। টালা মরিচের মচমচে ভাবটা বোঝার জন্যে চুলার মুখ থেকে একটা মরিচ পট করে ভেঙে চুলায় বসানো সিদ্ধ কচুপাতার মধ্যে ছেড়ে দেয় সালমা। পাটখড়ি ঠেলতে গিয়ে একটা মরিচ প্রায় পড়ে যাচ্ছিলো চুলার গনগনে আগুনে। আগুন উপেক্ষা করেই মরিচটাকে বাঁচায়। দেখে অদূরে বসা বাপ তার হইহই করে ওঠে।
– কী যে করস না। এহনি হাতটা পুইড়ে যাতো ! মরিচ বড় না হাত ?
সালমা শূন্য দৃষ্টি নিয়ে তাকায়। কচু শাকের কড়াইটা আঁচল দিয়ে উঠিয়ে নিয়ে যেতে যেতে বলে, ‘এহেজনের কাছি এহেটটা বাজান। এই যেমন তোমার কাছে হাত বড় আমার কাছে মরিচ।‘
জয়নাল মিয়া মেয়ের চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে থাকে। মেয়ের কথার খোঁচা বুঝবার সামর্থ্য না থাকায় কোন তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে পারে না। পারবেই বা কেমন করে? ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার বিষয়গুলো তাকে ছেড়ে গেছে বহু আগে।
মা মরা মেয়েটা এই বাপের দিকে তাকিয়ে ঘর-সংসার করার চিন্তাও মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছে। আর ঝেড়ে ফেলারও কিছু নেই। কেউ তো তার বিয়ে বা ঘরসংসার নিয়ে চিন্তা করে বিশ্বসংসার উল্টিয়ে ফেলছে না। সালমার সই মনোয়ারার ছোটমেয়ে এখন স্কুলে পড়ে ক্লাস টেন এ। আরেক সই তিন বাচ্চার মা। অথচ সালমা বাপের ঘানি টানতে গিয়ে…।
– বুঝলি রে মা। কাইল রাইতে শেখ সাব আইছিলো। আমারে একটা দায়িত্ব দিয়া গেছে।
বাজান বন্ধ করো তো তোমার দিগদারি। শেখ সাব চলি গ্যাছে তাও দুই কুড়ি বচ্ছর হতি লাইগলো। আর তুমি আছো… হ্যায় তো নাই বাজন।
– মা রে এই কথা আর কবি না। আর না। বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তক্কে বহুদূর। একবার মাতার মদ্যে যদি ঢুকোয় নিস সে মরে নাই, তবে দেখবি তাই অয়েছে। মা রে সে তো মরে নাই। আছে তো। আমি দেইছি তারে। বিশ্বাস যা বেটি। আমি সত্যি কচ্ছি।
– আর যদি কতা কয়েছো তো মেজাজ ঠিক রাখবার পারবো না নে কলাম।
জয়নাল মিয়া উদাস ভঙ্গিতে গান ধরে, তার গানের গলা ভালো না। তবু যাপিত জীবনের এই একটা স্মৃতি তার মনে গেঁথে আছে ৷সালমার মা রাগ করলেও হেড়ে গলায় এই গান শোনাতেন আর এখন মেয়ে রেগে গেলেও এই গান শোনান। অনেকদিন রাগ করবার মত কিছু খুঁজে না পেলে সালমা মাঝেমধ্যে কপট রাগের ভান করে। তাদের ছোট্ট সংসারের স্মৃতি বলতে এটুকুই মনে আছে বাবার ; এটা ভেবেই সান্ত্বনা পায় সে।
‘বান্দিয়া পিরিতের ঘর, ভালবাসার খুটির প’র
আদরে দিলেন ঘড়ের চাল…
ও মন রে সুখেতে রবেন চিরকাল।’
দুই
দৈর্ঘ্যেপ্রস্থে গ্রামটা বর্গাকৃতির। নালতাপুর বাজার থেকে ভ্যানে বড়জোর বিশ মিনিট লাগে। চৈত্র-বৈশাখ সবই ঠিক আছে, সমস্যা হয় ভাদ্রমাসে। অবশ্য ভাদ্র না বলে পুরো বর্ষা জুড়ে বলাই ভালো। পানিতে মাটি ধুয়ে রাস্তার অবস্থা এতটাই ভচকানো থাকে যে শুকনো মৌসুমেও মানুষ দু’চারটা উষ্ঠা না খেয়ে এ রাস্তা দিয়ে চলতে পারে না। এই রাস্তার শেষ মাথায় একটা কালভার্টের পরই আদমদিঘী গ্রাম। জয়নাল মিয়ার কাছে ওটাই বিরিজ । একবার গ্রামের যুব সমবায় সমিতি বন বিভাগের কাছে আবেদন করে দশ হাজার গাছ লাগিয়েছিলো রাস্তার দুই পাশে। মূল উদ্দেশ্য রাস্তার মাটিটা যেন ধুয়ে না যায়। অই দশ হাজার তালগাছের শেষ গাছটার গোড়া থেকে দু’টো ধানি জমি আর ছোট্ট ডোবাটা পেরোলেই জয়নাল মিয়ার বাড়িটার ভাঙা ছাউনিটা চোখে পড়ে। ডোবা মূলত জমির আইল বাঁধার জন্যে মাটি কেটে কেটে তৈরি হওয়া। সালমার জন্যে অবশ্য একদিক থেকে ভালোই হয়েছে। অন্তত বর্ষার দিন ক’টা খাল পাড় অব্দি যেতে হয় না। এখানেই বাসনকোসন হাড়ি পাতিল ধুয়ে ফেলতে পারে। বাড়ির পিছনে মরা খেজুর গাছ ছিলো। সেকান্দর কাকার কাছ থেকে কোদাল এনে মাটি কেটে গাছটি ফেলে একটা ঘটলা মতন বানিয়ে নিয়েছে সালমা। আপন মনে কিছু ঢোল কলমিও গজিয়ে উঠেছে ডোবাটার চারপাশ ঘিরে। সন্ধ্যে নামার আগটায় এখানটায় দাঁড়ালে মনটা কোন কারণ ছাড়াই হুহু করে ওঠে।
সেই থেকে অইটুকুন মেয়ের ঘাড়ে এসে পড়ে আধপাগলা বাবার দেখভাল, সংসার সামলানোর মত কঠিন সব কাজ।
জয়লাল শেখ একজন শিল্পী। দেয়ালে ফুল, লতাপাতা নানারকম নকসা আর ছোটখাটো ভাস্কর্যের কাজ করেন। এর বাইরে কিছু শেখেনওনি। সেই দশ বছর বয়স থেকে বাপের সাথে গ্রাম, গঞ্জ, মহকুমা ঘুরে ঘুরে বাপের কাজ দেখেছেন। বাপের কাজে হাত লাগিয়েছেন। জয়নাল শেখ ধান বুনতে শেখেননি কিন্তু দেয়ালে নকসা বুনতে শিখেছেন, মাছ ধরতে শেখেননি, তুলি ধরতে শিখেছেন , ট্রাক্টর চালাতে শেখেননি কিন্তু আঙুল চালিয়ে ভাস্কর্যের নিখুঁত নির্মাণ শিখেছেন। আর দশটা গাঁয়ের ছেলের মত সে নয়। সিমেন্ট বালুর কতটুকু মিশ্রণে কতটুকু আঠা মেশালে নকশা নিখুঁত হবে তার হিসেব মেলানো জয়নাল শেখের কাছে জলভাত। তার হাতে এক নিমিষে এক তাল বালুসিমেন্ট নানারকম পাখি, ফুল, শাপলা, দোয়েল, কবুতর, আম, ব্যাঙেরছাতা, মাছ আরো কত কী হয়ে যায়। তবে তার হাতের দু’টো কাজের ভয়ানক কদর। এক বাংলাদেশের মানচিত্র আর দুই বঙ্গবন্ধুর তর্জনী তোলা ছবি। দেখলে এত জীবন্ত মনে হয়, যেন এখনি বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেয়া শুরু করবে। এ জন্যে মনে মনে কিছুটা অহংকার তার এখনো আছে। ‘জয়নাল মিয়ার মত দেয়ালে অইরাম পষ্ট কইরে বঙ্গবন্ধুরে আর কেউ-ই আঁইকবার পারবো না নে’ এই কথায় মাথা আউলানো জয়নাল মিয়ার চোখ এখনো চকচক করে। একাত্তরে একুশ বছর বয়সী জয়নাল মিয়া আর তার বাবা বঙ্গবন্ধুর এক ডাকে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন। যাবার সময় দু’জনেই দৃপ্ত পায়ে হেঁটে গিয়েছেন কিন্তু আসবার সময় পুত্র ফিরেছে বাবার লাশ কাঁধে নিয়ে। কথা দিয়ে গিয়েছিলেন সায়রা বানুকে। যদি ঠিকঠাক ফিরতে পারেন তবে গাঁটছড়া বাঁধবেন তার সাথে। কথা রেখেছেন জয়নাল মিয়া। বছর ঘুরতেই কোল আলো করে এলো সালমা।
তিন
ঠাঁ ঠাঁ দুপুর। বঙ্গবন্ধু হত্যার খবরটা তখনই পেলো জয়নাল মিয়া। খবর শুনে মানুষটা হনহন করে সেই যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলো । পুরো একটা সপ্তাহ তার কোন খবর কোথাও পাওয়া গেল না। সায়রা বানু যখন প্রায় দিশেহারা হয়ে সিদ্ধান্ত নিলো গ্রাম সম্পর্কিত চাচা মতিন বেপারির কাছে যাবে সালমার বাবার খোঁজখবর নেবার জন্যে, ঠিক তখনই মানুষটা ফিরে এলো। ডান হাতে ছোট্ট একটা বোচকা আর বা হাতে একটা সিমেন্টের বস্তায় কিছু খুটিনাটি জিনিসপত্র। সায়রা বানু দৌঁড়ে কাছে গেলেন বটে কিন্তু জয়নাল মিয়ার যেন কোন দিকেই ভ্রুক্ষেপ নেই। কোলের বাচ্চাটার দিকেও তাকালো না। সোজা নয়াবাড়ির পাশ কাটিয়ে অদূরে পুরানো ভাঙা ভিটায় ঢুকে পড়লো। হাতের মালসামানা নামিয়ে রেখে নয়াবাড়ির মাচান থেকে পুরানো টিনের বাক্সটা টান মেরে নামিয়ে নিলো। যাবার সময় উঠানের কোণে রাখা ঝাড়ুটাও নিয়ে গেল। সারাদিন ভাঙা ভিটা ঝাড়পোঁছ করে মাটিতেই একটা ইটের বালিশ বানিয়ে লম্বা ঘুম দিলো। সায়রা বানু কাঁদে, হাসে, কত কথা জিজ্ঞাসা করে, পাড়াপ্রতিবেশি ভিড় করে এটা সেটা জিজ্ঞেস করে, কোন উত্তর নেই। খেতে দিলে খায়। না দিলেও জিজ্ঞেস করে না কেন তাকে খেতে দেয়া হচ্ছে না। ফিরে এসেছে মানুষটা এই আবেগপর্ব থেকে সায়রা বানুও একসময় বেড়িয়ে আসে। সংসার বড় অদ্ভুত খাদক। আবেগ, শোক, স্বস্তি কোন কিছুই বেশিদিন ফেলে রাখে না। নিয়মমাফিক খেয়ে নেয়। জোয়ানমর্দ মানুষটা ঘরে বসে ঘুমাবে আর খাবে আর ওদিকে তরতাজা বউ তার বাচ্চা মেয়েটারে নিয়ে একা একা সংসারের ঘানি টানবে এটা মেনে নেয়া কষ্টকর। এদিকে মানুষের মুখ ভর্তি আগুন। কোথাও সামান্য কিছু জ্বলতে দেখলে তাকে যে পানি দিয়ে নেভাবে তার চেষ্টা নেই। বরং ফু দিয়ে তাকে উস্কে দিতে কণামাত্র দেরি করে না এরা।
টানা তিন বছর পরে এক সকালে আচমকাই ঘুম থেকে খুব ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে উঠলো জয়নাল মিয়া। ‘ও সালমার মা, কডা ভাত দিবার পারো? দেখি খায়া বাইর হই। কামকাজের একটা গতি করোন লাগে যে। মাইয়াডা বড় হতিছে। আমগো দিন না হয় শ্যাষ, মাইয়ার ভবিষ্যতের কতা চিন্তা না করলি হবি?’ সায়রা বানু বোধহয় ক্ষনিকের জন্য ভাষা হারিয়ে ফেলেছিল। মানুষটার এত স্বাভাবিক কথোপকথন শুনে সালমার মা-ই কিছুক্ষণের জন্য অস্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল। পরে ধাতস্থ হতে হতে আনন্দে কেঁদে ফেলেছিল । যাক, মানুষটা বোধহয় আগের মত স্বাভাবিক হয়েছে । কী অসহ্য কষ্টটাই না সে করেছে এতদিন কোলের মেয়েটাকে নিয়ে। খেয়ে না খেয়ে, মেয়ে কোলে নিয়ে এ বাড়ি ও বাড়ি ধান ভেনে, ঢেকি পার দিয়ে। যাক এতকিছুর পরও সে যে আগের মানুষটাকে ফিরে পেয়েছে এটাই আনন্দের।
কাজে ডুবে গেলে জয়নাল মিয়ার আর কিছুই মাথায় থাকতো না। দিনের পর দিন একটা পাতার নিখুঁত নির্মানের জন্যে কাটিয়ে দিতে পারতেন। নৌকার লগি, বৈঠা, পাল, নদীর ঢেউ এত সুনিপুণ করে দেয়ালে ফুটিয়ে তুলতেন যে দেখে অবাক হত দু’দশ গ্রামের লোকজন। আস্তে আস্তে তার সুনামও ছড়িয়ে পড়েছিল খানিকটা। নতুন বাড়ি করলে লোকজন তাকে নিয়ে যেত। কাজ থেকে আট-দশ দিন পর বাড়ি ফিরতো। যে দক্ষতায় সে কাজ করতো সে অনুপাতে ন্যায্য মজুরি পেত না। সালমার মা প্রথমটায় কষ্ট পেলেও পরে অতি সরল এই মানুষটাকেই নিজের ইহকাল, পরকাল ভেবে কাঁটিয়ে দিয়েছেন। দু’দিন, পাঁচদিন, দশদিন পর হলেও মানুষটা ঘরে তো ফেরে। যে টুকু যা আয় করে এনে বৌ এর হাতেই দেয় ৷ বিড়ি সিগারেটের নেশা নাই, পরনারীর আকর্ষণ নাই। নেশা বলতে একটাই। কয়দিন পরপর একটা করে ৫৭০ সাবান কেনা। রোজ অই ছোট্ট ডোবা পুকুরে গিয়ে আধাঘন্টা ধরে সারাগায়ে ৫৭০ মেখে, লুঙ্গি গামছা গায়ের গেঞ্জি তক সাবান দিয়ে আচ্ছামত কেঁচে ধুয়ে পুকুরের মধ্যে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে বসে থাকতো। একটা সাবান তিন-চার দিনের বেশি যেতো না। আবার আরেকটা সাবান কিনে আনতো। শুরুতে ব্যাপারটা আমলে নেয়নি সায়রা বানু। প্রথম যেদিন দোকানে সাবান না পেয়ে রাগে ক্রোধে বাড়ি ফিরে আবার সেই পুরানো ভিটায় গিয়ে দরজা আটকে দিলো সেদিনই তার খটকা লাগলো। বিকেলে গ্রামের মাতবর জয়নাল মিয়াকে ডেকে পাঠালো তার বাড়িতে । দোকান ভাঙচুর এর বিষয়টা তখনই জানলো সায়রা বানু। শুধু ভাঙচুরে শেষ হলেও একটা কথা ছিলো। আধলা একটা ইট দোকানী জব্বার মিয়ার মাথা বরাবর ছুড়ে মেরেছিল। অল্পের জন্য বেঁচে গেছে সে।
‘কামডা কী ঠিক করিছো জয়নাল মিয়া? তুমি শিল্পী মানুষ। জ্ঞানবুদ্ধিঅলা। তুমি যদি এম্বা করো তালি পরে বেবুঝ মানুষ কী কইরবে?’ মাতবর সাব তারে নরম স্বরে জিজ্ঞেস করে। জয়নাল মিয়া মাথা নিচু করে থাকে। বসে বসে মাটিতে আঁকিবুঁকি কাটে। মাতবরের কোন কথাতেই সে রেগে যায় না বা উল্টোপাল্টা কিছু বলে না । বরং বুঝিয়ে বলার এক পর্যায়ে মাতবরকে কথা দেয় সে আর কখনোই এমন করবে না। সবই ঠিক চলছিলো। বিষয়টা তাতিয়ে তুললো জব্বার মিয়ার ছোট বোনের জামাই। জয়নাল মিয়াকে জব্বার মিয়ার পা ধরে ক্ষমা চাইতে হবে। মাতবর দু’পক্ষের কাউকেই বোঝাতে পারলেন না। পক্ষে-বিপক্ষে নানান জনরব। হঠাৎই কী হল জয়নাল মিয়ার। ফোসফোস করে নিঃশ্বাস নিতে লাগলো, চোয়াল শক্ত হয়ে দাঁতে দাঁত এমন চেপে ধরলো যেন দাঁত খুলে পরে যাবে, চোখ দিয়ে যেন আগুন বেরুতে লাগল। ছুটে গিয়ে হাতের শক্ত মুঠিতে জব্বার মিয়ার গলা চেপে ধরে বলতে লাগলো, ‘ হারামির বাচ্চা রাজাকার, তগো মতন জানোয়াররা ক্ষেমা পাইছিলো বইলাই বঙ্গবন্ধুরে আইজ জেবন দিয়া তার মূল্য শোধ করতি হল। কী ভাবিছিস? সে মইরে গেছে? না সে মরে নাই। আমি আজও তারে দেখতি পাই। দ্যাশ অখনেও শত্রুমুক্ত হয় নাই। যুদ্ধ অখনেও শ্যাষ হয় নাই। কোণা কাঞ্চিতে তোর মতন কিছু আবর্জনা রয়া গেছে। এইগুলারে ঝাটায়ে বিদায় করতি না পারলে এই দ্যাশ শান্তিতে ঘুমাতি পারবি না নে। আইজ তরে মাইরা দরকার পড়লে জেলে যামু। ‘ মাতবর এর লোকজন উভয় পক্ষকে সেদিনের মত শান্ত করলেও বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়নি। জল অনেক দূর গড়িয়েছিলো। জব্বার মুন্সির বোনের জামাই তখন নব্য চলমান রাজনীতির ক্ষ্যাপা পাতি নেতা। এক সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথে জয়নাল মিয়াকে তারা তিন-চারজন মিলে প্রচণ্ড মার মেরে ধান ক্ষেতে ফেলে যায়। পরের দিন গ্রামবাসী তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয় বটে কিন্তু পুরোপুরি সুস্থ সে আর হতে পারে না। তীব্র মাথার যন্ত্রণায় পাগলের মতো করতে থাকে। একেক সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। সবাই বোঝে, সবাই জানে এসব কার কাজ, কাদের কাজ কিন্তু মুখ খোলার সাহস পায় না। সামান্য সুস্থ হয়েই সে আবার পুরানো ভিটায় ফিরে যায়। দরজা আটকে সারাদিন কী করে কে জানে। এক গভীর রাতে সায়রা বানুকে ডাকে সে। চোখ কচলে বাইরে এসে যা দেখে সে তাতে তার চোখ ছানাবড়া। পনেরো বিশটা ৫৭০ সাবান হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জয়নাল মিয়া।
-নে সালমার মা। এডিন গুছোয়ে রাখ। পরে কাজে দিবিনে।
সালমা কথা বাড়ায় না। সাবানগুলো হাতে নিয়ে টের পায় সাধারণ সাবানের চেয়ে অনেক ওজন। অথচ দেখে একবারও টের পায়নি যে সাবানগুলো বালু আর সিমেন্ট দিয়ে বানিয়ে রং করা। আঁচল পেতে সাবানগুলো নিতে নিতে সায়রা বানু আরো শুনতে পায়…
-শোন রে বউ আমি মইরে গেলে সাবানের জইন্যে তোর য্যান ছুইটে বেড়াতি না হয় তাই এগুন বানায়ে রাখলাম। এরপর ধর কাফনের কাপড়ডা যদি বানায়ে রাইখে যাতি পারি তাহলে পরে আর চিন্তা নাই। ঘরের পেছনের খালি জায়গায় আমার কব্বরখানও খুইড়ে রাখি যাবো। তালি পরে তোমাগের আর কোন পেরেশানিতে পড়তি হবে না নে। লাশ যেম্বা পাস, যেইখানে পাস আনি গোসলডা করায়ে শোয়াই দিবি৷
সায়রা বানু ধপাস করে বসে পড়ে৷ মানুষটা কী তবে আবার পাগল হয়ে গেল! শীতের রাতে দরদর করে ঘামতে থাকা সায়রা বানুর চোখের সামনে টিমটিম করে জ্বলতে থাকা হারিকেনের আলোটাও যেনো হারিয়ে গেল। এ ঘটনার বছর পাঁচেক পরে সেই খুড়ে রাখা কবরে জয়নাল মিয়াকেই নিজ হাতে শুইয়ে দিতে হল সালমার মা কে। সেই থেকে অইটুকুন মেয়ের ঘাড়ে এসে পড়ে আধপাগলা বাবার দেখভাল, সংসার সামলানোর মত কঠিন সব কাজ।
চার
‘আজকে ইউনো (ইউ এন ও)সাব আইসছিলো রে মা। কয়েছে যত তরা কইরে সম্ভব কাজডা উডোয় দিতে হবে। কন্ডাকটর বাবু এইবেলা বুইজবে কত ধানে কত চাল। আমাগের কতা তো গা ই মাখে না। কিছু ক’লি পরেই ধমক মারে। কত করে কলাম নকশা দেইখে জায়গাডা কয়ে দ্যান। দালান উইঠবার নগে নগে বেদীখানও দাঁড়ায়ে যাক৷ আর আমারে রড সিমেট দিই দিলি পরে আমি আমার মত কইরে রড কাইটে গুছোয় নিতি পারতাম। না, কে শোনে কার কতা। চিকন রডের কাজ এ কি এত সোজা?’
‘আজকে ইউনো (ইউ এন ও)সাব আইসছিলো রে মা। কয়েছে যত তরা কইরে সম্ভব কাজডা উডোয় দিতে হবে। কন্ডাকটর বাবু এইবেলা বুইজবে কত ধানে কত চাল। আমাগের কতা তো গা ই মাখে না। কিছু ক’লি পরেই ধমক মারে। কত করে কলাম নকশা দেইখে জায়গাডা কয়ে দ্যান। দালান উইঠবার নগে নগে বেদীখানও দাঁড়ায়ে যাক৷ আর আমারে রড সিমেট দিই দিলি পরে আমি আমার মত কইরে রড কাইটে গুছোয় নিতি পারতাম। না, কে শোনে কার কতা। চিকন রডের কাজ এ কি এত সোজা?’
আর আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করে তার হাত দু’টিও বজ্রমুষ্টি হয়ে গেছে নিজের অজান্তে , যে বজ্রমুষ্টি বাবার, যে বজ্রমুষ্টি বঙ্গবন্ধুর।
রোজ রোজ জয়নাল শেখ কাজে যায় আর মুখচোখ লাল করে বাড়ি ফেরে। গত পঁচিশ-তিরিশ বছর ধরে এই দেখছে সালমা। পূব পাশের তালগাছ অব্দি এলেই বাড়ি থেকে বাপকে দেখতে পায় তার কল্পিত ইউনো সাব, কন্ডাকটর বাবুকে উদ্দেশ্যে করে বকাবাদ্যিও করতে করতে হনহনিয়ে হেঁটে বাড়ির দিকে আসছে । উঠোনে এসে দাড়ালেই সালমা আর দেরি করে না। গরম ভাত আর সেদ্ধ লতাপাতা যা যখন রান্না করা থাকে সামনে বেড়ে দেয়৷ এতে মনের জ্বালা না মিটলেও পেটের জ্বালা মেটে জয়নাল মিয়ার। আর পেটের জ্বালা অন্য সব জ্বালা মেটানোর জন্যে পুরোপুরি না হলেও বেশ খানিকটাই দাওয়াই বলা যেতে পারে। আর সালমাও কিছুটা শান্তি পায় বাপের মুখ বন্ধ রাখতে পেরে। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান লোকটা জনদরদী। না, লোক দেখানো দরদী না। সত্যিকারের দরদী। এলাকার মানুষজন সন্তুষ্ট তার উপরে। সালমার বাপের জন্যে মুক্তিযোদ্ধা ভাতার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন নিজে থেকেই। পাগলামি বেড়ে যাওয়ায় মাঝখানে সালমারে বলেছিলো সদরে কোন এক মেন্টাল হসপিটাল আছে সেখানে দেখাতে। প্রয়োজনে ভর্তি করার ব্যবস্থাও করে দেবার আশ্বাসও দিয়েছে । সালমা বাপকে দেখিয়েছে ঠিকই কিন্তু ডাক্তারের কথা শোনেনি। বাপের উপরে যতই রাগ অভিমান করুক বাপকে ছেড়ে তার পক্ষে থাকা একদিনও সম্ভব না। দিনশেষে এটুকু আশ্রয়ই তো আছে মাথার উপরে। চেয়ারম্যান ভালো মানুষ মানে তো এটা নয় যে তার চ্যালারাও সব ভালো মানুষ। জামাল মেম্বারের চোখ দুইটার একটা সে সালমার দিকে তাক করেই রাখে। সে জয়নাল মিয়ার মেয়ে, এই ভাবনাটা আর চেয়ারম্যান এর কঠিন দৃষ্টিকে এখনো কিছুটা ভয় করে। জামাল মেম্বার এর বড় ভাই জব্বার মুন্সিকে অপমানের ক্ষোভ এখনো যায়নি ছোট ভাইয়ের মন থেকে। অপমান তেমন কিছুই না। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে একদিন গঞ্জের বাজার ভরা মানুষের সামনে জব্বার মুন্সির মুখে একদলা থুতু ছিটিয়ে জয়নাল মিয়া বলেছিলো,’ তোর মতন রাজাকারের কামই হইলো রাইতের আন্ধারে পিছন থিকা আক্রমণ করা। সামনে দাঁড়ায়া থুতু ছিটাইতে কলিজা লাগে।’ ধূর্ত জব্বার মুন্সি দ্রুতই বুঝে ফেলেছিল গঞ্জের বাজারের বাতাস এখন জয়নাল মিয়ার দিকে। সাথের চ্যালাদের তাই আর এগোতে দেয়নি। দিন কয়েক পরে জয়নাল মিয়া মানসিক ভারসাম্য হারালে তার প্রচার করতে সুবিধা হয় যে পাগলের কাজ এসব।৷ তাই সে আমলে নেয়নি। কিন্তু সেদিনের এক চ্যালা জব্বার মুন্সির ছোট ভাই, আজকের জামাল মেম্বার এর মন থেকে এই ঘটনা একেবারেই মুছে যায়নি।
যতই পাগল হোক গ্রামের মানুষজন তাকে শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে। এটা ভাবলেই এক অন্যরকম স্বস্তি কাজ করে সালমার ভিতরে। হোক সে পাগল, হোক সে অকর্মণ্য। সালমা এ বাড়ি ও বাড়ি কাজ করে যা পায় আর সরকারি ভাতা মিলিয়ে বাপবেটির সংসার কষ্টে সৃষ্টে চলে যায়। শুধু দুটো পেট বাঁচানোর চিন্তা হলে সমস্যা ছিলো না। কিন্তু প্রতি মাসে বেশ কিছু নগদ টাকা লাগে বাপের ওষুধ আর ইনজেকশন এর পেছনে। হাজার কষ্টেও সালমা বাবার ওষুধ এর যোগান বন্ধ করেনি। যতদিন মা ছিলো দু’জন মিলে সামলিয়েছে। মা বেঁচে থাকতে তবু কিছুটা হুশ জ্ঞান ছিলো। মাঝেমধ্যে কাজও করেছে৷ এখন তো জয়নাল মিয়ার একটাই কাজ। সকাল হলেই হনহন করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়া আর কল্পিত লোজনকে বকাবাদ্য করতে করতে দুপুরে বাড়ি ফিরে ক’টা ভাত মুখে দিয়েই পুরানো ভিটায় ঢুকে বসে বসে ৫৭০ সাবান বানানো ।
ঠিক যেমন করে এক মধ্যরাতে জয়নাল মিয়া তার স্ত্রী সায়রা বানুকে ডেকে তুলে ৫৭০ সাবান হাতে তুলে দিয়েছিলেন তেমনি এক মধ্যরাতে মেয়েকে ডেকে তুললেন। প্রায় দুই বস্তা ৫৭০ সাবান মেয়ের হাতে দিয়ে বললেন, ‘রাইখা দে রে মা। কাজে লাগবো।’ বাবার পাগলামির সাথে পরিচিত সালমা আর সব দিনের মতই পাগলামি ভেবে কথা না বাড়িয়ে ঘুমাতে গেল। সকাল বেলা সেই ছোট্ট ডোবাতেই লাশ মিললো জয়নাল মিয়ার। ডোবার অল্প পানি সাদা হয়ে আছে সাবান গলে গলে। হাতে ধরা একটা ৫৭০ সাবান । না, সত্যিকারের সাবান নয়, সিমেন্ট বালু দিয়ে বানানো সাবান । লাশ উপরে তুলে আনলে সালমা বাপজানের হাত থেকে সাবানটা সরিয়ে নিতে গেলে টের পায় কী শক্ত সেই হাতের মুঠো । তার ভেতরে যেন বিদ্যুৎ খেলে যায়। বিড়বিড় করে সালমা , ‘আছে তো বাজান আছে। আমাগের বঙ্গবন্ধু আছে। তুমি ঠিক কয়েছো।‘ গ্রামবাসী বাড়ির পিছনে কবর খুঁড়তে গিয়ে টের পায় সেখানে সদ্য একটি কবর খোঁড়া রয়েছে।
দিন দশেক বাদে সালমা গভীর রাতে বাড়ির পেছনে পায়ের শব্দ শুনতে পায়। সালমা ভয় পায় না । ভয় পাবার জন্য দেশটা স্বাধীন করেনি তার বাপ দাদারা। সালমা একটা সাবানের বস্তা কাছে টেনে সেখান থেকে বাপজানের বানানো দু’টি ৫৭০ সাবান দু’হাতে তুলে নেয়। আর আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করে তার হাত দু’টিও বজ্রমুষ্টি হয়ে গেছে নিজের অজান্তে , যে বজ্রমুষ্টি বাবার, যে বজ্রমুষ্টি বঙ্গবন্ধুর।