মামুন রশীদের কবিতা: নতুনত্বের সন্ধানে


কবিতায় শিল্পকে ভুল নির্মাণ বলে অভিহিত করেছেন কবি। তবে এ সিদ্ধান্ত তার ব্যক্তিগত হলেও স্থির ছিলেন কি না—বলা মুশকিল। কবি বলেছেন, ‘শিল্প কেবলি ভুল নির্মাণ’। শিল্প মানেই নকল। শিল্প মানেই অনুকরণ। তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাহলে শিল্প ভুল নির্মাণ বলেও আমরা মেনে নিতে পারি। যদি তা প্রমাণসাপেক্ষ হয়। এ কেবল কবির ব্যক্তিগত উপলব্ধি।

শিল্পীর বিদগ্ধ মন-চক্ষু কিছুই এড়িয়ে যায়নি সমকালীন সভ্যতা, বাস্তবতা কিংবা লাম্পট্যের আখড়া। কবি জীবনকে উপভোগ করেছেন কবিতায়। কেননা কবি মানুষের ভিড়েও একা হয়ে যান।

কখনো কখনো তাঁর কবিতাকে মনে হয়, কিছু অনুভূতি বা টুকে রাখা কথামালা। যখন দেখি তিনি লিখেছেন—‘কেউ কোথাও চলে যাবে জানলে বুকের ভেতর রেল ইঞ্চিন টানা/ বাতাসের একটানা শব্দ হতে থাকে। শো শো বাতাস হঠাৎ বদ্ধ কুঠুরিতে/ আটকে ছটফট করতে থাকে। একটানা ছটফটানি রেল ইঞ্জিনের নিঃসঙ্গ/ আর্তি সয়ে যেতে হয়। অথচ আমি চাই প্রিয় মুখ কাছে এসে বেদনা/ দেখুক।’ একে কি কেবল একখণ্ড অনুভূতিই মনে হয় না?

আবার কবিতা সম্পর্কে কবির অভিব্যক্তি পাওয়া যায় তার ‘কবিতা কিছুই বলে না’ শিরোনামের কবিতায়। কবি বলেছেন—

এভাবে জন্ম নিতে পারে একটি কবিতা
শষ্যভূমি ভরে যেতে পারে শব্দে-ছন্দে-অলঙ্কারে
যদি প্রশ্ন ছুড়ে দাও কিভাবে?
বলব না, কেননা—
কবিতা কিছুই বলে না, হয়ে ওঠে—’

কবি অন্যত্র বলতে চেয়েছেন—

বাঞ্ছা ছিল, প্রকাশিব জলের স্বভাবে!
কী ছিল তোমার মনে, কব না সে কথা আজি এ বাদলদিনে, ভ্রমণে।
ভূতে ও ভবিষ্যে সেই প্রত্নছায়া এক উপচ্ছায়া হয়ে জাগ্রত পরাণে।

তিনি কবিতায় বগুড়া ও সিরাজগঞ্জের স্মৃতিচারণ করেছেন। তাঁর কবিতায় উঠে এসেছে জমিদার বাড়ির প্রসঙ্গ। অতীতের হারানো অনেক স্মৃতি। তবে একটা ব্যাপার লক্ষণীয়, তাঁর কোনো কোনো কবিতা শিরোনাম ছাড়াই শুধু নম্বরাঙ্কিত রয়েছে। সে ভিন্ন কথা—তবে তার কবিতায় অন্য এক আবেশ ফুটে ওঠে। খুব সহজেই তিনি বলতে পারেন অনেক না বলা কথা। তিনি বলতে পারেন—

আচমকা কোনোদিন
মরচে ধরা মন ঝাত করে উড়ে গেলে
দিকবিদ্বিক, ধরে রাখা দায়।

ভালোবাসা কবিকে অনেক কিছুই শিখিয়েছে। আবার অপেক্ষার যন্ত্রণাও কবিকে তাড়িয়ে বেড়ায়। প্রিয়তমার পাশে বসে কত বাহানার কথা বলেছেন কবি অবলীলায়—

চুমুতেই পরিতৃপ্তি। তবু কেন যেন
কাছে এসে হাত ধরে পাশাপাশি বসে
দীর্ঘক্ষণ শুধু বাহানা করে করে গড়িয়ে দিয়েছি জল।

ভালোবাসার উপলব্ধি হয়তো একেকজনের কাছে একেক রকম। কবি তার কবিতায় ভালোবাসার সঙ্গে ভূগোলেরও একটি যোগসূত্র আবিষ্কার করেছেন। উপমায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে ভালোবাসার ভূগোল, মানচিত্র, দেশ—সর্বোপরি সেখানকার সেই চেনা মুখ। তাই তো ‘একটি প্রেমের কবিতা’য় কবি বলেছেন—

ভূগোল না জানলে চেনা পথও অচেনা মনে হয়
অথচ বহুদিন গমনে ধীরে ধীরে মুখস্ত হয়ে আসে পথের সীমানা
তখন ভূগোল সম্পর্কেও কিঞ্চিত জ্ঞান লাভ হয়।

তিনি কোনো কোনো কবিতায় পরিণত বাক্যালাপ, দৃশ্যকল্প নির্মাণ বা নতুন ভাবনার উন্মেষ ঘটাতে চেয়েছেন। ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ কবিতায় বলেছেন—

আমাদের আর্তনাদে, আমাদের ক্লান্তিহীন চলায়-
আমাদের অশ্রুস্রোতে, আমাদের জীর্ণ মলিনতায়-
আমাদের তৃষ্ণার্ত হৃদয়ে, বিরহের মরীচিকা দ্বীপে-
নির্ভার নেশাতুর আলো।

তিনিও চেয়েছেন মানুষ তাকে মনে রাখুক। ‘একটু একটু করে মানুষ আমায় মনে রাখুক’ কথাটা কবি হয়তো পাঠকের উদ্দেশেই বলেছেন। তার সৃষ্টিকর্ম, সাধনা, কর্মপ্রচেষ্টা তাকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। তার কবিতার মাঝে তাই মানুষের দুঃখ, কান্না, তৃষ্ণা ফুটে ওঠে চিরাচরিত নিয়মেই। তিনি দেখেছেন, ভেবেছেন, বুঝেছেন, অনুভব করেছেন—তারপর প্রকাশ করেছেন। তিনি হুট করেই পাঠকের সামনে হাজির হননি। পাশাপাশি নিয়মিত লেখালেখি করেছেন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়। নিয়মিত চর্চার ফসল ঘরে তুলেছেন ধৈর্য আর অভিজ্ঞতার আলোকে।

কবি আবার বলেছেন ‘স্মৃতির শহরে ফিরে যেতে নেই’। কিন্তু কেন? জবাব তিনি কবিতার ভাষাতেই দিয়েছেন। পরক্ষণেই বলেছেন—

বাঁশবনে, নিবিড় করে, ক্রমশ নির্জন হয়ে ওঠা
দুপুরে, কোন না কোন কিছু অনন্ত অতীত
থেকে ক্ষিপ্র চিৎকার তুলে মাথা চাড়া দেয়-
ভবিষ্যতে-ভীষণ অতীত থেকে।

কখনো কখনো তার কবিতায় খাঁটি করুণ বাস্তবতা ধরা দিয়েছে অকপটে। শিল্পীর বিদগ্ধ মন-চক্ষু কিছুই এড়িয়ে যায়নি সমকালীন সভ্যতা, বাস্তবতা কিংবা লাম্পট্যের আখড়া। কবি জীবনকে উপভোগ করেছেন কবিতায়। কেননা কবি মানুষের ভিড়েও একা হয়ে যান। নিজেকে একা একা উপভোগ করেন। কবিতার খাতায় গড়ে তোলেন ঘর-গেরস্থালি। তাই তো কবি বলেন—

মানুষের ভিড়ে দাঁড়িয়ে যখন
একা-একা হয়ে যাই, তখন গাছেদের
মত চোখ কান বন্ধ করে দেই।’

কবি ও প্রাবন্ধিক বীরেন মুখার্জী ‘মামুন রশীদের কবিতা: কল্পনার প্রাচুর্য’ প্রবন্ধে বলেন, ‘কবি মাত্রই দার্শনিক, মানুষ রশীদের ক্ষেত্রেও কথাটি প্রযোজ্য। তিনি কবিতার কেন্দ্রে নিজেকে স্থাপন করে মানুষের সুখ-দুঃখের ইতিহাস তুলে ধরেন। কবিতা সৃষ্টিতে তিনি শুধু বিষয়বস্তুর সন্ধানে ব্রতী না হয়ে নিজের মতো করে দৃশ্য সৃষ্টিতে নিমগ্ন থাকেন। তিনি যাপিত জীবনের আর্থ-সামাজিক অবস্থারও চিত্রায়ন করেন কখনো কখনো। সমাজের অবক্ষয় ও অসাম্যের জায়গাটিও তিনি চিহ্নিত করেন।’

তার মানে এই দাঁড়ালো যে, তিনি দেখেছেন, ভেবেছেন, বুঝেছেন, অনুভব করেছেন—তারপর প্রকাশ করেছেন। তিনি হুট করেই পাঠকের সামনে হাজির হননি। পাশাপাশি নিয়মিত লেখালেখি করছেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়।

মামুন রশীদ হয়তো বোঝাতে চেয়েছেন, ভাবনার বা কল্পনার বা স্বপ্নের কোনো শিরোনাম হয় না। তবে দিনক্ষণ উল্লেখ থাকতে পারে। মনে হতে পারে এটা অমুক দিন ভেবেছিলাম। অথবা এই স্বপ্নটা ঈদের রাতে দেখেছিলাম। দিন-মাস-বছরই তবে যথেষ্ট। তাই তো তিনি শিরোনামের পরিবর্তে শুধু তারিখ উল্লেখ করেছেন। এটাও নতুন একটা আউডিয়া বা স্টাইল। উদাহরণ স্বরূপ এই কবিতাটাই দেখুন—

২৫.০৯.২০১৩
বুনো অজগর পড়ে আছে বহু বাঁক পেরিয়ে নিঃসাড় ছায়াহীন মধ্যমাঠে। নিস্তরঙ্গ
মর্গে অশনাক্ত মৃতদেহ- গলায় ঝুলছে নম্বরপ্লেট। মানুষ বড় দুর্ধর্ষ, দুর্ধর্ষ তার
করতালি। জলতরঙ্গে সে খোঁজে মেয়েলি আঙুল। ঝড়াপাতায় ফাঁকে হিসহিস
শব্দ, হাটদরজায় দিব্যি আকাশ আর ওষ্ঠমায়ায় পরস্ত্রী।

কবি যা-ই বলতে চান, তা-ই যেন পাঠকের কথা হয়ে যায়। গণমানুষের কথা হয়ে যায়। জীবনকে অনেকটাই ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছেন তিনি। সেই ঘনিষ্ঠতার ছোঁয়া পাই আমরা তার কবিতায়। অন্তর্জালায় জ্বলে-পুড়েও কবি অবলীলায় বলে যান—

ভাঙছি, আমি যে আহত আর্তনাদে ভেঙ্গে যাচ্ছি—
এই শঙ্কার সমগ্রতা তোমাকে ভয় পাইয়ে দেয় না।

তার কাব্যগ্রন্থে নতুনত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। শব্দের চমৎকার গাঁথুনি, উপমার সাবলীল ব্যবহার, অলঙ্কারের যথাযথ নির্মিতি আমাকে মুগ্ধই করেছে বটে। কবি শব্দে শব্দে স্বপ্নময়তার আবহ তৈরি করেছেন। তীব্র আলিঙ্গনের মতোই কেঁপে উঠেছে অনুভূতির স্বর্গোদ্যান। কী যেন এক আবেশ ছড়িয়ে দিয়ে যান চরণে চরণে। তার কবিতার কথাগুলোই কাছে টানে। টেনে নেয় পরবর্তী রসা আস্বাদনের আসরে। কবি বলেন—

পরস্পরের গাঢ় ভাপে ভিজে
ওঠা চোখের আদ্রতায় ম্লান হয়ে উঠছে কুয়াশার
সারি। দূরের কথা থাক, যে তীব্র আলিঙ্গনে
আমরা জড়িয়ে ধরেছি- স্বপ্নবিন্দুর মতো মনে
হয়। রূপকথা? পরাবাস্তব স্বপ্ন? এতো স্পষ্ট হয়?

কবি ও প্রাবন্ধিক মোহাম্মদ নূরুল হক ‘মামুন রশীদের কবিতা: সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘মামুন রশীদের কবিতায় প্রেম, প্রকৃতি, ইতিহাস, ভূগোল একইসূত্রে গাঁথা। রাজনৈতিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিক বিষয়গুলোকে তিনি অভিন্নসূত্রে বিবেচনা করেন। অর্থাৎ তার বিবেচনায় এসবই ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট। ফলে এসবই আবর্তিত হবে ব্যক্তির সুখভোগের উপকরণ হিসেবে। ব্যক্তিই নিজের মর্জিমতো সাজায় এসবের ঘূর্ণন চক্র। তিনি এসব বিষয়কে আঁকতে গিয়ে প্রায় চিত্রকল্প ও প্রবাবধর্মী পঙ্‌ক্তি সৃষ্টি করেন। এটিই তার কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য। প্রবাদপ্রবণ পঙ্‌ক্তি সৃষ্টির ক্ষেত্রে তার মুন্সিয়ানা রয়েছে।’

মামুন রশীদের কাব্যগ্রন্থ পাঠে একটি জিনিস হয়তো আপনার মনে হবে, তিনি পরিবর্তন আনতে চেষ্টা করেছেন। প্রথম কাব্যগ্রন্থ থেকে সপ্তম কাব্যগ্রন্থ পর্যন্ত কোনো না কোনোভাবে নতুনত্বের সন্ধান করেছেন। ভিন্নভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন। সে হোক শিরোনামে, উপস্থাপনে, নির্মাণে কিংবা ছন্দে-অলঙ্কারে। লেখালেখির দীর্ঘ সময়ে তিনি মাত্র সাতটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। লেখালেখি তো শুরু করেছেন তারো অনেক আগে। তার মানে এই দাঁড়ালো যে, তিনি দেখেছেন, ভেবেছেন, বুঝেছেন, অনুভব করেছেন—তারপর প্রকাশ করেছেন। তিনি হুট করেই পাঠকের সামনে হাজির হননি। পাশাপাশি নিয়মিত লেখালেখি করছেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। নিয়মিত চর্চার ফসল ঘরে তুলছেন ধৈর্য আর অভিজ্ঞতার আলোকে।