এক: ব্যক্তিগত স্মৃতি
আধুনিক বাংলা কবিতার প্রধান কবির মুকুটে যিনি শোভিত ছিলেন সর্বক্ষণ, সেই অগ্রজ,প্রায় প্রত্যেক অনুজ কবির কাছে প্রিয় রাহমান ভাই হিসেবে অধিক পরিচিত ও ততোধিক আপনজন। সুস্মিত সেই অনাবিল হাসির কাছে যেন অবলীলায় সব আবদার পেশ করা যেতো অনায়াসে।
দৈনিক বাংলার অফিসে কিংবা তার শ্যামলীর বাড়িতে গেলে প্রথমেই দেখতে পেতাম হাসিমাখা নরম কোমল তুলনাহীন সেই মুখাবয়ব।যার দিকে তাকালে অপার আনন্দে মিশে যেতো চারপাশ। কবিতার গন্ধে বিভোর হতো অনাবিল আড্ডার সময়।এভাবেই বহুদিন দেখেছি তাকে।
সেই রাহমান ভাই, প্রথম আমাদের ধানমণ্ডির বাসায় এসেছিলেন কবি রফিক আজাদের জন্মদিন উপলক্ষে।হাতে করে তিনি নিয়ে এসেছিলেন পুরোনো ঢাকার এক ঠোঙ্গা জিলেপি।আমার হাতে জিলেপির সেই ঠোঙ্গা তুলে দিতে দিতে মিস্টি হেসে বলেছিলেন যে, রফিকের মনটা তো জিলেপির মতো পেঁচানো, তাই ওর জন্মদিনে জিলেপি নিয়ে এলাম…।
কাব্য সাহিত্যের এত বড় মাপের কবির মুখে এমন একটি কথা শুনে প্রথমে খুব ধাক্কা খেলাম। পরক্ষণেই মনে হলো পরস্ত্রীর প্রতি এটা একটি চিমটি নয় তো? নাহ, কিছুতেই হতে পারে না।
কেননা, নেহাইত দু’দিন আগেই তো সাহিত্যের পাতায় রফিক আজাদের দুটি কবিতা পড়ে সপ্রশংস টেলিফোনে রফিক আজাদের সঙ্গে কথা বলেছেন প্রায় আধা ঘণ্টার মতো।তার প্রশংসা শুনে আমার ঘরের কবিও তো সেদিন হাওয়া মে উড়তা হায়…। কাজেই আমার মতো তরুণ কবির প্রতি নিশ্চয় নেহাইত ঠাট্টা, মশকরা ব্যতীত অন্য কিছু নয়। বিশেষভাবে আমরা যারা রাহমান ভাইকে কাছ থেকে চিনি এবং জানি।
সে বছর রফিক আজাদের শরীরটা বিশেষ ভালো ছিলো না বলে তার জন্মদিনটি একটু ঘটা করে পালন করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমি নিজেই। সেই একই সময়ে যেহেতু কলকাতা থেকে ঢাকার কোনো এক উৎসব উপলক্ষে আগত আমাদের প্রিয় কবি ও সাহিত্যিক বন্ধুরা এসেছিলেন তাই তাদেরকেও ডেকে নিয়েছিলাম জন্মদিনের এই আয়োজনে। ১লা ফাল্গুন,রফিক আজাদের ৫৮তম জন্মদিন উপলক্ষে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শঙ্ঘ ঘোষ,দেশ সাপ্তাহিক পত্রিকার বাদল বসু, আবৃত্তিলোকের কর্ণধার সৌমিত্র মিত্র ও মালবিকা মিত্র, কলকাতার আজকাল পত্রিকার সাংবাদিক বাহার উদ্দিনসহ সেদিন অনেকেই আমার আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে কবিকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে এসেছিলেন আমাদের গরীবিখানায়।
সেদিন সন্ধ্যার পর পরেই সকলেই এলেন আমাদের ধানমণ্ডির বাসায়। ফুলে ফুলে ভরে গেলো আমাদের ছোট্ট বারান্দা। বাংলাদেশ থেকে রফিক আজাদের প্রিয় শিক্ষক ড.আনিসুজ্জামান, প্রিয় কবি শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, সায়ীদ আতিকুল্লাহ,বেলাল চৌধুরী, রবিউল হুসাইন, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, পীযুষ বন্দোপাধ্যায়,আবু হাসান শাহরিয়ার,ফারুক মাহমুদ ড.সামাদ,তারিক সুজাতসহ বাংলাদেশের অধিকাংশ কবি সেদিন উপস্থিত হয়েছিলেন।নাম মাত্র খাবার খেয়েছেন সকলে। শিশিরজলে ভেজা সেই আড্ডার জল থই থই করছিলো কবিদের কথার কোলাহলে।সুনীলদা তো এক পর্যায়ে গান ধরলেন—তুই লাল পাহাড়ের দেশে যা…রাঙামাটির দেশে যা, ইখান তোরে মানাইছে নারে—ইক্কেবারে মানাইছে না রে।
সুনীলদার সঙ্গে মুনমুনসহ তখন অনেকেই কণ্ঠ মেলাচ্ছেন। পাশের আসন থেকে মিটিমিটি হাসছেন রাহমান ভাই। আরো এক পেগ চাই বলে রফিক আজাদের দিকে গ্লাসটি বাড়িয়ে দিলেন। নিজের বাড়িতে কাউকে ডাকলে, রফিক আজাদ খুব সাবধানে থাকেন। খেলেও খুব স্বল্প পরিমানে খান—নিজের পাগলামী চেপে রেখে যেন অন্যদের পাগলামী সামলাতে পারেন—সেই প্রচেষ্টা সচেতনভাবেই তিনি অব্যাহত রাখেন—এসব দিনে তাকে কোনো শাসন-বারণ না করলেও চলে। সারাক্ষণ সে নিজেই সচেতন।
বেলালভাইও এক পর্যায়ে নিঃশব্দে ঘুমিয়ে পড়েন। সকলের শেষে তাকে তার বাড়িতে পৌঁছানোর ভার সতত কবি ও স্থপতি রবিউল হোসাইন ভাইয়ের কাঁধে থাকে।তিনি অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে দায়িত্বটি নিজেই আগ্রহভরে পালন করেন। এমন হয়েছে বহু বহুদিন। কবি বলে কথা! ঢাকা কলকাতার সাহিত্য আসর যেন আমাদের ধানমণ্ডির পরাবাস্তব গৃহেই সম্পন্ন হয়েছিলো স্মরণীয় সেই জন্মদিনের রাতের ক্যানভাসে।
এরপর ১৯৯৬ সালের ভরা বর্ষাকাল তখন।কবি-শিল্পী সাহিত্যিক দম্পতিদের নিয়ে চমৎকার একটি নৌভ্রমণের ব্যবস্থা করেছিলো খসরু চৌধুরী ও তপতী চক্রবর্তী।তপতী ছিলো শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের আত্মীয়া। বাংলাদেশের জাহাজ ব্যবসায়ী হাসান মনসুর মিলনকে বিবাহসূত্রে বাংলাদেশেই স্থায়ী হয়েছিলেন তপতী। অসাধারণ নির্মল মনের মানুষ ছিলেন তিনি।তপতী-মিলন অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রী মিলেই এই গাইড ট্যুরের ব্যবসাটি পরিচালনা করতেন তারা।
নদীপথে দেশের দর্শনীয়স্থান পরিভ্রমণে ‘গাইড ট্যুর লিমিটেড’ এর অধীনে দুটো জাহাজ নিয়ে তাদের ব্যবসা সবে শুরু হয়েছিলো তখন।রফিক আজাদের প্রিয়জন সাপ্তাহিক রোববারের নিয়মিত লেখক এবং হাসান মনসুর মিলনের ঘণিষ্ঠ বন্ধু খসরু চৌধুরীর উদ্যোগেই মূলত বাংলাদেশে প্রথম সপরিবারে কবি সাহিত্যিকদের নিয়ে এমন একটি ব্যতিক্রমী ভ্রমণের ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। খসরু তখন সুন্দর বনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার নিয়ে রীতিমত গবেষণামূলক লেখা লিখে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ইতোমধ্যে তার রচিত গবেষণামূলক গ্রন্থ’সুন্দর বনের বাঘ’ প্রকাশিত হয়েছে।
তারই পরিকল্পনায় রূপালি বাতাস ওড়া এক শান্ত বিকেলে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষার ঘাট থেকে নৌকায় চেপে গাইড ট্যুর লিমিটেডের ‘অবসর’ নামের জাহাজে মেঘনা নদীতে ভেসে ভেসে বেড়িয়েছিলাম।ভাসতে ভাসতে সে যাত্রায় আমাদের ‘অবসর’নোঙ্গর ফেলেছিলো চাঁদপুর গিয়ে।
চাঁদপুরে নোঙ্গর ফেলে আমাদের স্নানের সময় দেয়া হলো।মেয়েদের মধ্যে আমি আর সেলিনা আপা সাঁতার কাটতে নেমেছিলাম সেই মেঘনার স্বচ্ছজলে।লায়লা হাসান এবং রাহমান ভাইয়ের স্ত্রী জোহরা ভাবী পাক্কা রোদের মধ্যে মাথায় একটি হ্যাট পরে আমাদের সাঁতার উপভোগ করছিলেন। মেঘনার জল স্পর্শ করতেই কবি আহসান হাবীবের বিখ্যাত কবিতা’মেঘনা পাড়ের ছেলে’এর কয়েকটি চরণ মনে পড়লো আমার।
‘আমি মেঘনা পাড়ের ছেলে
আমি মেঘনা নদীর নেয়ে।
মেঘনা নদীর ঢেউয়ের বুকে
তালের নৌকা বেয়ে
আমি বেড়াই হেসে খেলে-
আমি মেঘনা পাড়ের ছেলে।
মেঘনা নদীর নেয়ে আমি মেঘনা পাড়ে বাড়ি
ইচ্ছে হ’লেই এপার থেকে ওপারে দেই পাড়ি।
যতটুকু মনে পড়ে ছেলেদের মধ্যে আমাদের গাইড ও লেখক খসরু চৌধুরী এবং একমাত্র পেইন্টার কালিদাস কর্মকার সেদিন জলে নেমেছিলো। মেঘনা নদীর এপার ওপার করতে না পারলেও সাঁতার কেটেছিলো প্রায় ঝানু সাঁতারুর মতো।
স্নান শেষে মেঘনা নদীর টাটকা ইলিশ মাছ রান্না, করলা ভাজি আর ‘বিলম্ব’এর টক দিয়ে অসাধারণ ডাল মেখে ভাত খেয়েছিলাম—সেই প্রথম আমি বিলম্ব-ডাল খেয়েছিলাম। স্মৃতি উসকে দিলে এখনো সেই টাটকা ইলিশ আর টক-ডালের স্বাদ অনুভব করি যেন।
জাহাজেই আহার-বিহার ও পানাহারসহ জম্পেস আড্ডার ব্যবস্থা ছিলো।কবিতা পড়া, গান, গল্প সবই ছিলো।সেখানেই অন্যান্য কবি-স্ত্রীদের সঙ্গে ঘণিষ্ঠ পরিচয় আমার। রাহমান ভাইয়ের স্ত্রী জোহরা ভাবী কি যে অসাধারণ স্নেহময়ী মানুষ ছিলেন,সেটি জানতেই পারতাম না এই ভ্রমণের সঙ্গী সেদিন না হলে।আনোয়ারা সৈয়দ হকের পরিচয় হিসেবে জানতাম তিনি ডাক্তার। তার লেখক পরিচিতি তখনো খুব বেশি উজ্জ্বল নয়। হক ভাইয়ের খ্যাতির আড়ালে কোনো রকম টিকে আছেন।
আমার অবস্থা তো আরো তথৈবচ। বটবৃক্ষের মতো এক কবির পাশে আমি সামান্য এক তৃণসম।তিনটি কবিতার বইয়ের মালিক হয়েছি সবে। তারও প্রচার নেই, হাক-ডাক কিচ্ছুটি নেই। অন্যদের দৃষ্টিতে বৈষ্ণব পদকর্তা বিদ্যাপতির পদাবলির সেই নায়িকার মতো আমার অবস্থা।
তোমার গরবে গরবিনী হাম
রূপসী তোমার রূপে’।
আমার কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। অপর দিকে হক ভাইয়ের স্ত্রী আনোয়ারা সৈয়দ হকভাবী পেশায় ডাক্তার, নারী লেখক অতপর এমত নয়নকাড়া—সৌন্দর্যের আধার তিনি,সেদিনের যুথবদ্ধ ভ্রমণে না এলে ঘনিষ্ঠভাবে জানাই হতো না তাঁকেও!
আরো পেছনে ফেলে এলাম কবির কাতর দুই নয়ন এবং আমার সিংহাসনতুল্য কবির হৃদয়। গ্রাসাচ্ছাদনের দায় ও দায়িত্ব নিয়ে যে হৃদয়খানি বিরিশিরি পর্বে নির্বাসিত ছিলো প্রায় ছয়টি বছর।
এই ভ্রমণ যাত্রার সঙ্গী হয়ে আরো এসেছিলেন কবি ও সব্যসাচী লেখক এবং রাহমান ভাইয়ের বন্ধু সৈয়দ শামসুল হক, বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, কবি নির্মলেন্দু গুণ,নৃত্যশিল্পী লায়লা হাসান,পেইন্টার কালিদাস কর্মকার, দৈনিক বাংলা বাজার পত্রিকার মালিক ইয়াহিয়া খান, সাংবাদিক মিজানুর রহমান সস্ত্রীক এবং প্রকাশক মজিবুর রহমান খোকা।
সাপ্তাহিক রোববার পত্রিকার সম্পাদক, বীরমুক্তিযোদ্ধা ও কবি রফিক আজাদ এবং আমি কবি দিলারা হাফিজ, কবি রফিক আজাদের স্ত্রী ও কবি হিসেবে এই নৌভ্রমণে আসতে টিকেট পেয়েছিলাম। তবে এতকাল পরেও এই লেখাটি কালি ও কলমের সম্পাদক আশফাক খানের অনুরোধে লিখতে গিয়ে মনে হলো আসলেই নদীবক্ষে ভ্রমণের সেই সময়টা ছিলো সোনার ফ্রেমে বাঁধানো শৈল্পিক সময়’।
আমরা দু’জনেই এক রাত দুটোদিন—প্রকৃতি এবং শিল্পের মানুষদের সান্নিধ্যে—নদীবক্ষের অলৌকিক নির্জন এক পরিবেশে—জ্যোৎস্নাস্নাত গভীর রাতের কানন—সব কিছু মিলে বহুদিন পরে বড় বেশি বিস্ময়ানন্দে কেটেছিলো আমাদের দু’জনের স্বপ্নের প্রহরগুলো।
বাংলা কাব্য সাহিত্যের দুই দিকপাল বাংলাদেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমান ভাই,সব্যসাচী লেখক ও কবি সৈয়দ শামসুল হক ভাইয়ের সেই হৃদয় উজার করা সিক্ত স্নেহাদর-ভালোবাসায় সেইসব দিনগুলো এত সমৃদ্ধ আর মাতোয়ারা ছিলো যে,তাদের কথা মনে হলেই চোখ ভিজে আসে। আনোয়ারা ভাবীর সঙ্গে সেদিন পরিচিত হয়েও খুব সমৃদ্ধ হয়েছিলাম নানাভাবে।
২০১৬ সাল থেকে রফিক আজাদ ও হক ভাই দুজনেই চলে গেলেন। যখন দুজনেই একাকী জীবনের সারথি হয়েছি—বয়সের সামান্য ব্যবধান সত্ত্বেও আমাদের দুজনার বন্ধুত্ব এখন একলা জীবনের পরমসঙ্গী হয়ে উঠেছে।
একজন মেধাবী ও পরিশ্রমী লেখক হিসেবে আনোয়ারা সৈয়দ হক বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন সত্তর বছর বয়সে।ভাবা যায়! অথচ একই পুরস্কার তার স্বামী পেয়েছেন ৩১ বছর বয়সে।ধারণা করি লেখক বা কবির স্ত্রী হিসেবে এক ঘরে দু’জন লেখক বা কবি হলে এভাবেই বোধ হয় খেসারত দিতে হয় নারী-লেখক সত্তাকে।তবে আশার কথা যে ইতোমধ্যে তিনি একুশে পদকও পেয়েছেন সাহিত্যে অবদানের জন্যে।
একাকী জীবনে আনোয়ারা সৈয়দ হকের সঙ্গে আমার অনেক বেশি বন্ধুত্ব, আমি তার লেখারও ভক্ত। যেমন সেলিনা হোসেনের লেখায় খুঁজে পাই একক মানবসত্তাকে।যিনি জগত ও জীবনকে দেখেছেন নির্মোহ এক উদার দৃষ্টিতে।জীবনের সমগ্রতাকে তিনি ধারণ করেছেন উপন্যাসের বৃহত কলেবরে। বিশেষভাবে তাঁর অনেকগুলো উপন্যাস বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়েছে। চলচ্চিত্র হয়েছে। কথাসাহিত্যে দুই বাংলায় সেলিনা হোসেনের নাম অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়।
এরপরে ২০০০ সালের কথা। রফিক আজাদ তখন বিরিশিরি উপজাতীয় কালচারাল একাডেমির পরিচালক। আমার ‘পরে তিনি দায়িত্ব দিলেন কবি শামসুর রাহমান ভাইকে সস্ত্রীক ঢাকা থেকে বিরিশিরি নিয়ে আসতে হবে। তথাস্তু বলে আমিও কলেজ থেকে ছুটি নিলাম দু’দিনের জন্যে। রাহমান ভাই, জোহরা ভাবী, সঙ্গে তাদের নাতনী নয়নাকে নিয়ে ঢাকা থেকে সকালে রওয়ানা হয়ে পৌঁছুলাম সন্ধ্যার একটু আগে আগে। একাডেমির শিল্পী গারো ছেলে-মেয়েরা হাতে গোলাপফুলের পাপড়ি নিয়ে তোরণের দুইধারে দাঁড়িয়ে অধীরভাবে অপেক্ষা করছিলো বাংলা ভাষার একজন প্রধান কবিকে দেখবে বলে। কবি যখন পৌঁছুলেন একাডেমির সমুখভাগে,তখন গারো মেয়েরা পুষ্প বর্ষণের পাশাপাশি নেচে গেয়ে কবিকে অভ্যর্থনা জানালো তাদের আদিবাসী রীতি অনুযায়ী। এরপর চা-নাস্তা শেষে কবির সঙ্গে চোখের দেখা দেখতে দলে দলে এলো স্থানীয় তরুণ কবির দল। তারা চলে গেলে রাতের খাবার শেষে দুই কবি বসে গেলেন অপার্থিব এক রাত্রিকে পাহারা দিতে।
প্রায় সারারাত দু’জনের সপ্রাণ আড্ডা সোনালি শিশিরজলে ভিজে ভিজে হিরন্ময় এক আলোর চাতাল সৃষ্টি করছিলো যেন। জোহরা ভাবী ও আমি কিছুক্ষণ তাদের সঙ্গী হয়ে পাশে বসি। গ্লাসে ঠোঁট রাখি কিছুক্ষণ। বাকী সময় আমি আর ভাবী পাশের কক্ষে গারো মেয়েদের ড্রেস পরে ওদের মতো নাচের রিহার্সেল দিচ্ছি আর নানা মুদ্রায়,ভঙ্গিমায় ছবি তুলছি দু’জনে মিলে।মাঝে মধ্যে দুই কবিকে যুক্ত করছি সেই সব অতুলনীয় ছবির স্মৃতি-মজ্জায়।এভাবেই ভোরের আভা চোখে-মুখে জড়িয়ে ঘুমাতে গেলাম কিছুক্ষণের জন্যে।আমাদের পাশেই সেদিন শুয়ে ছিলো প্রাণচঞ্চল পাহাড়ি নদী শান্তির সোমেশ্বরী—সে এক বিবসনা, মনোহারী রাত ছিলো আমাদের জন্যে।
পরেরদিন স্থানীয় এমপি জালাল তালুকদারের সভাপতিত্বে একাডেমির মূল মঞ্চে কবিকে সংবর্ধনা দেয়া হলো গারো টুপি ও উত্তরীয় পরিয়ে। নেত্রকোণা, দুর্গাপুর ও বিরিশিরি গ্রামের গারো, হাজং, বাঙালি—সকলেই উপস্থিত ছিলো সেই অনুষ্ঠানে। পরে একাডেমির শিল্পীরা কবির কবিতা থেকে আবৃত্তি করলো এবং নাচ-গানে শেষ হলো তিন ঘণ্টাব্যাপী কবির সংবর্ধনা অনুষ্ঠান।
পরেরদিন স্থানীয় তরুণ কবিরা কবিকে নিয়ে যেমন আলাদা একটি কবিতা পাঠের আয়োজন করছিলো।তেমনি সোমেশ্বরী তীরবর্তী দুর্গাপুরের ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থানগুলো কবিকে ঘুরিয়ে দেখিয়েছিলো তারা। বিরিশিরি গ্রামের দুর্গাপুর উপজেলায় ১৯৪২-৪৩ সালে কমরেড মণি সিংহর নেতৃত্বে সংঘটিত হয়েছিলো টঙ্ক আন্দোলন। ১৯৪৬-৪৭ সালে তার নেতৃত্বে তেভাগা আন্দোলন শুরু হয়ে পরে সে আন্দোলন সারা পশ্চিমবঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছিলো।
বলা বাহুল্য যে,বাংলার কৃষকদের অধিকার আদায়ের একটি অন্যতম আন্দোলন ছিলো এই টঙ্ক আন্দোলন। এই আন্দোলনে শহীদ হয়েছিলেন বিপ্লবী নেত্রী,হাজং মাতা রশিমনি হাজং। তার মহান এই আত্মত্যাগে নির্মিত স্মৃতিসৌধ দেখে রাহমান ভাই সেদিন একাডেমিতে ফিরেছিলেন সন্ধ্যা নাগাদ।অতপর আড্ডা, আড্ডা, যে আড্ডা ছিলো কবিদের রক্তে ও হৃদয়ে।
পরেরদিন ফেরার পালা।
সোমেশ্বরী নদীর বিখ্যাত মহাশৈল মাছ বহু কষ্টে সংগ্রহ করালেন রফিক আজাদ। সঙ্গে গোলবেগুন ভাজা, সবজি-ডাল এবং রাহমান ভাইয়ের প্রিয় মহিষের দুধের দই, নেত্রকোণার বালিশ মিষ্টি আর মুক্তাগাছার মণ্ডার স্বাদ জিহবায় জড়িয়ে দিনাদিন আমি পুনরায় রাহমান ভাই-ভাবী এবং নয়নাকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা হলাম। পেছনে পড়ে রইলেন কবি রফিক আজাদ,আমার অস্তিত্বের সারাংশ। আরো পেছনে ফেলে এলাম কবির কাতর দুই নয়ন এবং আমার সিংহাসনতুল্য কবির হৃদয়। গ্রাসাচ্ছাদনের দায় ও দায়িত্ব নিয়ে যে হৃদয়খানি বিরিশিরি পর্বে নির্বাসিত ছিলো প্রায় ছয়টি বছর।
দুই: কাব্য মূল্যায়ণ
বাংলা ভাষা ও কাব্য সাহিত্যের ধারায় বাংলাদেশের কবিতায় নতুন এক নাগরিক রুচি ও কাব্য-উন্মাদনা সৃষ্টি করেছিলেন কবি শামসুর রাহমান( ১৯২৯—২০০৬)। ১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবরে জন্মেছিলেন তিনি বৃটিশ ভারতীয় নাগরিক হিসেবে। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট, জাতীয় শোকাবহ মাসে।
মৃত্যুকালে তিনি পাকিস্তানের নাগরিকত্ব অতিক্রম করে সদ্য ভূমিষ্ট অনন্য এক দেশ বাংলাদেশের সম্মানিত একজন নাগরিক। শুধু তাই নয়,ইতোমধ্যে বাংলা কবিতার সমকালীন পাঠক হৃদয়ে কাব্যবিজয়ী প্রধান কবি হিসেবে তিনি তুমুল জনপ্রিয়তার শীর্ষেও ছিলেন।বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রধান কবি হিসেবে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা লাভ করেছিলেন তিনি দুই বাংলাতেই। বিভাগোত্তর রাজনৈতিক সংগ্রাম ও আধুনিক শিল্প-সাহিত্যের ইতিহাস তাকে নির্মান করেছিলো বাংলা কবিতার বাঁক বদলের নতুন এক বিন্যাসে।সেখানে তিনি কবিতার রাজপুত্র হিসেবে নন্দিত ছিলেন।
তিরিশোত্তর বাংলা কবিতার পরবর্তী ধারাবাহিকতা বিবেচনায় বাংলাদেশের কবিতায় চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশক—দুটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। চল্লিশ দশকের কবি আবুল হোসেন, সিকান্দার আবু জাফর,আবদুল গণী হাজারী,ফররুখ আহমদ,সৈয়দ আলী আহসান, তালিম হোসেন এবং সর্বোপরি কবি আহসান হাবীবও কাব্যানুশীলনে যথাযথ সক্রিয়।এই পর্বে কবি আহসান হাবীব ছিলেন প্রগতিশীল ধারার অন্যতম আধুনিক কবি।
অর্ধেক নারী এবং অর্ধেক ঈশ্বরের দেখা পান যখন তিনি, তখনই হয়ে ওঠেন অলৌকিক এক অর্ধনারীশ্বর। যাকে আমরা বলি কবি ও দ্রষ্টা। কবি শামসুর রাহমান ছিলেন কবি ও দ্রষ্টা।
পঞ্চাশ দশকের সময়পর্বে আমরা পেয়েছি বেশ ক’জন কবি।এদের মধ্যে উল্লেখ্য কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ,আবদুস সাত্তার,আল মাহমুদ, আলাউদ্দিন আল আজাদ,ওমর আলী,ফজল শাহাবুদ্দিন,শহীদ কাদরী,শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং হাসান হাফিজ।এরা প্রত্যেকেই অবিভক্ত বাংলায় কলকাতা কেন্দ্রিক পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেছিলেন প্রথমে। আধুনিক কবিতার অনন্য পৃষ্ঠপোষক বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকায় ‘রূপালি স্নান’ কবিতাটি প্রকাশিত হলে কবি হিসেবে শামসুর রাহমান সুধীজনের দৃষ্টিলাভ করেন।
তবে একথা বলা যায় যে,পঞ্চাশ দশকের শামসুর রাহমানের সতীর্থ কবিদের মধ্যে আল মাহমুদ,কবি শহীদ কাদরী এবং সব্যসাচী লেখক ও কবি সৈয়দ শামসুল হককে পেয়েছি আমরা কবিতার বিষয় ভাবনা ও প্রকরণের অভিনব বিন্যাসে। এই কবি ত্রয় বিষয় ভাবনা,ও প্রকরণ তথা শব্দ-ছন্দ গুণে কবিতায় নিজস্ব একটি পৃথক কণ্ঠস্বর সৃষ্টি করেছেন—যা সারস্বত পাঠক হৃদয়কে আলোড়িত করেছে নিবিড়ভাবে।
বাংলাদেশের কবিতায় প্রথম নাগরিক কবি হিসেবে শামসুর রাহমান খ্যাতিমান হলেও প্রকৃতি ও নিসর্গের নির্মল সৌন্দর্যের কথা অবলীলায় উঠে এসেছে তার কবিতায় ব্যবহৃত ভাষা-ছন্দ ও অলংকারে।বিশেষভাবে উপমা,উৎপ্রেক্ষা ও চিত্রকল্প অলংকার ব্যবহারে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন প্রকৃতি ও নিসর্গের শাশ্বত সৌন্দর্যের অপরূপ কিছু ছবি।
একজন সমাজ সচেতন কবি হিসেবে তার সমকালের জীবন-সংগ্রাম, রাজনীতি, অর্থনীতি,ভাষা ও শিল্প-সংস্কৃতির প্রতিটি পর্যায়ে সংঘটিত ঘটনা পরম্পরা ইতিহাসকে তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন প্রায় সত্যনিষ্ঠ, ন্যায়পরায়ণ ইতিহাসবিদের মতো।পার্থক্য শুধু গদ্যের পরিবর্তে তিনি মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন কাব্যভাষাকে। এজন্যে তাকে ঐতিহাসিক কবিও বলা চলে।
বিভাগোত্তর(১৯৪৭)পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ হয়ে ওঠার প্রতিটি ঐতিহাসিক স্মরণীয় ঘটনাকে কেন্দ্র করে তিনি কবিতা রচনা করেছেন—যা তার সমসাময়িক অন্য কোনো কবির ক্ষেত্রে কবিতায় এমন ধারাবাহিক রচনা আমরা পাইনি।এমন নয় যে, তা শুধুই বিবৃতিমূলক। এজাতীয় অধিকাংশ কবিতাই রসোত্তীর্ণ বা কালোত্তীর্ণ বলে যে কোনো কাব্য-সমালোচক রায় দেবেন বলেই বিশ্বাস করি বাংলা সাহিত্যের একজন ছাত্রী ও শিক্ষক হিসেবে। বাহান্নোর ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে বাংলাভাষাকে যখন রোমান হরফে লেখার প্রস্তাব আসে,ক্ষোভে দুঃখে তিনি রচনা করেন ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’নামের কালজয়ী সেই কবিতা।
বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান যখন কারাগারে তখন তাকে উদ্দেশ্য করে রচনা করেন অসাধারণ কবিতা ‘টেলেমেকাস’ যা তিনি লিখেছিলেন ১৯৬৬ কিংবা ১৯৬৭ সালের দিকে। ১৯৬৯ সালে বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে শহীদ হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে অধ্যয়নরত ছাত্রনেতা আসাদ।
আসাদের গায়ের সেই রক্তমাখা শার্টকে পতাকায় রূপান্তর করে যে উত্তাল মিছিল প্রদক্ষিণ করেছিলো রাজপথ,তার ফলে দেশব্যাপী সংঘটিত হয়ে উঠেছিল তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড়।গণঅভ্যুত্থানের এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করেই কবি লিখলেন ‘আসাদের শার্ট’নামের সেই কালজয়ী কবিতা। শহীদ আসাদের মৃত্যুর পরই প্রতিবাদী মানুষের বাঁধভাঙা জোয়ার নামে ঢাকাসহ সারা বাংলার রাজপথে। সংঘটিত হয় উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সংঘটিত হলো নয়মাস ব্যাপী মহান মুক্তিযুদ্ধ।
মহান একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে বিপন্ন কবি শামসুর রাহমান ‘মজলুম আদিব’ ছদ্মনামে কলকাতার বিখ্যাত দেশ ও অন্যান্য পত্রিকায় কবিতা লিখেছেন।এই সময়ে তার ‘বন্দী শিবির থেকে’কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে কলকাতা থেকে। যে কাব্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ওপর রচিত তাঁর দুটি কবিতা জনচিত্তকে গভীরভাবে আলোড়িত করেছে এবং জয় করে নিয়েছে আপামর জনতার হৃদয়।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিবার নিয়ে চলে যান নরসিংদীর পাড়াতলী গ্রামে। এপ্রিলের প্রথম দিকে তিনি লেখেন যুদ্ধের ধ্বংসলীলায় আক্রান্ত ও বেদনামথিত কবিতা ‘স্বাধীনতা তুমি’ ও ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’।
একটি দেশ ও জাতির সর্বস্তরের জনগণ যখন তার স্বাধীন ভূখণ্ডের জন্যে জীবন বাজী রেখে অস্ত্র হাতে লড়ে যাচ্ছে রণাঙ্গনে,সেই পরাক্রান্ত পটভূমিকায় সময়োপযোগী এই কবিতা দুটি মূলত সাধারণ মানুষ আগ্রহভরে গ্রহণ করেছে।কবির হৃদয়ের সঙ্গে সর্বস্তরের মানুষের হৃদয়ে মেলবন্ধন যেন ঘটে গেছে এই সেই মুহূর্ত থেকে।
কবি যে মুহূর্তে বলেন,
‘তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা,
সকিনা বিবির কপাল ভাঙলো,
সিঁথির সিঁদুর মুছে গেল হরিদাসীর’,
তখন আর বুঝতে বাকি থাকে না যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি ছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনা।সেই অসাম্প্রদায়িক চেতনার জয়গানে মথিত হয়ে আছে যেন এই কবিতা।
একইভাবে ছয় মাত্রার মাত্রাবৃত্তে রচিত ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতাটিতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও অস্তিত্বের ডাক যেন শুনতে পাই আমরা অনায়াসে।
‘স্বাধীনতা তুমি
রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান।
স্বাধীনতা তুমি
কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো
মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা-
স্বাধীনতা তুমি
শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল সভা
স্বাধীনতা তুমি
পতাকা-শোভিত শ্লোগান-মুখর ঝাঁঝালো মিছিল।
স্বাধীনতা তুমি
ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি।
স্বাধীনতা তুমি
রোদেলা দুপুরে মধ্যপুকুরে গ্রাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতার।
স্বাধীনতা তুমি
মজুর যুবার রোদে ঝলসিত দক্ষ বাহুর গ্রন্থিল পেশী।
স্বাধীনতা তুমি
অন্ধকারের খাঁ খাঁ সীমান্তে মুক্তিসেনার চোখের ঝিলিক।’
এমনকি স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে শামসুর রাহমান ১৯৮৭ সালে এরশাদের স্বৈরশাসনের প্রতিবাদে দৈনিক বাংলার প্রধান সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৮৭ থেকে পরবর্তী চার বছরের তিনি প্রথম বছরে ‘শৃঙ্খল মুক্তির কবিতা’, দ্বিতীয় বছরে ‘স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কবিতা’, তৃতীয় বছরে ‘সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কবিতা’ এবং চতুর্থ বছরে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কবিতা’ রচনা করেন। কেন?
জাতীয় চেতনার উন্মেষকালে কোনো কবি কি নীরব থাকতে পারেন? পারেন না বলেই ১৯৯১ সালে এরশাদের পতনের পর লেখেন ‘গণতন্ত্রের পক্ষে কবিতা’। অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও জনমানুষের প্রতি অপরিসীম মানবতাবোধ সর্বদা তার চেতনায় প্রবাহিত ছিলো, যে মানবতাবোধের উজ্জীবনে একজন মানুষ প্রকৃত অর্থে মানুষ হয়ে ওঠেন,দেশ হয়ে জন্মান নতুন করে। তখন তিনি দেশ,জাতি,সমাজ ও গণমানুষের প্রতি দায়বদ্ধ হয়ে পড়েন না চাইলেও। অর্ধেক নারী এবং অর্ধেক ঈশ্বরের দেখা পান যখন তিনি, তখনই হয়ে ওঠেন অলৌকিক এক অর্ধনারীশ্বর। যাকে আমরা বলি কবি ও দ্রষ্টা। কবি শামসুর রাহমান ছিলেন কবি ও দ্রষ্টা।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য যতদিন টিকে থাকবে, কবি শামসুর রাহমানও উপস্থিত থাকবেন তার কালজয়ী পঙ্ক্তিমালায়।