রহস্যেঘেরা অ্যাডামস ব্রিজ


অ্যাডামস ব্রিজ। আদম সেতু। নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে বিষয়টি। আদম (আ.)-কে শ্রীলঙ্কার সামান্থাকুটায় নামানো হয়েছিল। পরে ওই পাহাড়ের নাম হয়ে যায় ‘অ্যাডামস হিল’। চূড়ার নাম ‘অ্যাডামস পিক’। প্রশ্ন হলো, সৃষ্টির আদিতে কোনো নৌযান ছিল না। ছিল না নৌকা। ধর্মীয় মতবাদনির্বিশেষে আদম বা অ্যাডাম, সেন্ট থমাস, শিব, হনুমান, গৌতম বুদ্ধ যিনিই ওই পাহাড়ের চূড়ায় নামুন না কেন; তিনি শ্রীলঙ্কার বাইরে কিভাবে গিয়েছিলেন? দেশটির চারপাশে সমুদ্র। কিভাবে এই সমুদ্র পাড়ি দিয়েছিলেন?

ধারণা করা হয়, শ্রীলঙ্কা থেকে তিনি প্রথমে গিয়েছিলেন ভারত। অ্যাডাম হেঁটে চলে গিয়েছিলেন জেরুজালেম; পশ্চিমে এশিয়ার শেষপ্রান্তে। আদম (আ.) গিয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যে কিংবা দূরপ্রাচ্যে। গৌতম বুদ্ধ ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশে বা এর আশপাশে। শিব, হনুমান বা রামের রাজত্ব সেও তো ভারতেই।

সুতরাং ধারণা করা যায়, তিনি হেঁটে পাড়ি দিয়েছিলেন সমুদ্র, তথা ভারতমহাসাগর। শ্রীলঙ্কা এবং ভারতের মানচিত্র দেখলে সবাই অনুধাবন করতে পারবেন, একটা জায়গায় এসে দুই দেশের দূরত্ব একেবারেই কমে গিয়েছে।

একদিকে ভারতের তামিলনাডুর রামেশ্বরাম দ্বীপ। তবে রামেশ্বরাম থেকে আরও খানিকটা দক্ষিণে পাম্বান দ্বীপ। অবশ্য কেউ কেউ রামেশ্বরামকেই ‘পাম্বান দ্বীপ’ বলেন।

অন্যদিকে শ্রীলঙ্কার উত্তরের শেষ ভূখণ্ড মান্নার উপকূল। পাম্বান থেকে মান্নার উপকূলের মধ্যে জলপথের দৈর্ঘ্য মাত্র ৩০ মাইল বা ৪৮ কিলোমিটার (কোথাও উল্লেখ আছে ৩০ কিলোমিটার)। কথিত আছে, রামেশ্বরাম দ্বীপ এক লাখ ২৫ হাজার বছর আগে সৃষ্টি হয়েছিল।

মানুষের স্বাভাবিক অনুমান হলো, আদম (আ.) ওই জায়গা দিয়েই সাগর পাড়ি দিয়েছিলেন। বছরের পর বছর সময় নিয়ে পাথর, সিলিকা ইত্যাদি ফেলে একটা পথ বা ব্রিজ তৈরি করেছিলেন। সেই ব্রিজ দিয়েই তিনি শ্রীলঙ্কা থেকে ভারত পৌঁছেছিলেন। এখনো পানির নিচে ওই ব্রিজের অস্তিত্ব রয়েছে। চুনাপাথরের তৈরি বলে পানির নিচে ওই পথ বা ব্রিজ জ্বলজ্বল করে। এ নিয়ে চলছে বিস্তর গবেষণা। বিজ্ঞানীরা খোঁজার চেষ্টা করছেন বৈজ্ঞানিক সমাধান। যদিও অনেক ভারতীয় ওই ব্রিজকে রামের ব্রিজ বা ‘রাম সেতু’ বলেন। স্মরণ করে মন্দির বলেই হয়তো এমন নামকরণ।

মঙ্গোলিলদস্তাবেজ বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা থেকে ভারত রামকে পর্যন্ত সাগরের তলদেশ দিয়ে একটি সংযোগ সেতুরূপী ভূমি দেখা যায়।বিজ আদম সেতু’ নামে পরিচিত। ইংরেজিতে ‘অ্যাডামস ব্রিজ’ এবং এই সেতুই হলো ‘রাম সেতু’। একে ‘নালা সেতু’ বা ‘সেতুবন্ধ’ নামেও অভিহিত করা হয়েছে।

নাম যাহোক-না কেন, বলা হয়ে থাকে, শ্রীলঙ্কায় মানব বসতির প্রাচীন ইতিহাস দশ থেকে বিশ লাখ বছরের পুরোনো! সেতুটিও সেরকম অতি পুরোনো।

ভৌগোলিক প্রমাণে দেখা যায়, সেতুটি জিও-রুটের সঙ্গে স্থলপথে ভারত ও শ্রীলঙ্কাকে সংযুক্ত করেছে। সেতুর উত্তরে পক্ প্রণালি। দক্ষিণে

মান্নার উপসাগর। সেতুটির সবচেয়ে অগভীর জায়গায় চুনাপাথরের গভীরতা ১ মিটারের বেশি নয়। তবে অন্য জায়গায় গভীরতা রয়েছে ৩০ ফুট পর্যন্ত। ব্রিজটির কিছু অংশে দেখা যায় শুকনো বালি। কিছু অংশে সমুদ্র খুব অগভীর।

যাহোক, আমার দীর্ঘদিনের অভ্যেস হলো বিমানে জানালার পাশে বসা। সবাই যখন ঘুমায় বা বিশ্রাম নেয়, আমি তখন জানালা দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকি। কলম্বো থেকে ঢাকা ফেরার পথে দেখছিলাম- অ্যাডামস ব্রিজের ঠিক ওপর দিয়েই বিমানের রুট। অর্থাৎ ঢাকা-শ্রীলঙ্কা আকাশপথে চলাচল এই ব্রিজের ওপর দিয়ে। মেঘ না থাকলে ওপর থেকে উজ্জ্বল লালচে মাটির অসংখ্য ঢিবি চোখে পড়ে। ওই লালচে বালির রাস্তা খুব পরিষ্কার দেখা যায়। সাগরের দিকে একটা দ্বীপে বাঁকানো লাইন ধরে লালচে মাটির পথ বা ছোটো ছোটো দ্বীপমালা গিয়ে শেষ হয়েছে জলসীমা বরাবর। আবার জলের অগভীর অংশেও পাথরের উপস্থিতি লক্ষণীয়। দ্বীপের উত্তর অংশে অবশ্য তেমন কিছু দেখা যায় না, শুধু নীল জল।

রামেশ্বরাম থেকে পাম্বান দ্বীপে বিশাল সেতুর ওপর দিয়ে যেতে হয়। আগে শুধু রেল সেতু ছিল। এখান এর সমান্তরালে সড়ক সেতুও তৈরি হয়েছে। ওই পথে গেলে দেখা যাবে, স্বচ্ছ জলের নিচে ছোটো-বড়ো অসংখ্য পাথর বিছানো। বড়ো বড়ো পাথরের অগভীর পথ জলের নিচ দিয়ে। অর্থাৎএই ব্রিজের অস্তিত্ব আপনার চোখে পড়বেই।

বাল্মীকির ‘রামায়ণ’-এ উল্লেখ আছে, রামের সেনাবাহিনী ছিল বানরদের নিয়ে। তাদের সহযোগিতায় এই সেতু বানানো হয়েছিল। রামের স্ত্রী সীতাকে রাবণের কবল থেকে উদ্ধার করতে এই সেতু দিয়েই তারা শ্রীলঙ্কা গিয়েছিলেন।

সেতুটি বানানো হয়েছিল সমুদ্রে পাথর ফেলে। যে কারণে কিছু রামভক্ত ওই সেতুর ওপর দিয়ে জাহাজ চলাচলের রাস্তা তৈরির বিরোধিতা করেন। এ নিয়ে আন্দোলনও হয়েছে। ‘রাম কর্মভূমি’ আন্দোলন। আন্দোলনকারীরা নাসার একটি উপগ্রহ চিত্রের সাহায্যে প্রমাণ করতে চেয়েছেন, রাম সেতুর ভগ্নাংশ এখনো বিদ্যমান। হিন্দুরা বিশ্বাস করেন, রাম সেতু পবিত্র স্থান। এ কারণে এর ওপর দিয়ে জাহাজ চলাচলের রাস্তা করা উচিত নয়।

এই ব্রিজ নিয়ে বিভিন্ন মিথ রয়েছে। বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও কম নেই। বিভিন্ন ভিডিয়ো বা স্যাটেলাইট ইমেজে দেখা যায়, কিংবদন্তি ব্রিজটি আসলে প্রবাল এবং বেলে পাথরের তৈরি একটা মালার মতো। সমুদ্রতটে এটি দৃশ্যমান। বাকিটা জলের নিচে ডুবে আছে।

নাসার স্থির চিত্র গবেষণা বলছে, ভারত ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে ১৭ লাখ ৫০ হাজার বছরের পুরোনো মানব-তৈরি সেতুর অস্তিত্ব রয়েছে। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় বলা হয়েছে, পাথরগুলো প্রাকৃতিক, কিন্তু মানুষের দ্বারা সৃষ্ট! মানে কী? প্রাকৃতিক হলে মানুষের দ্বারা সৃষ্ট হয় কীভাবে?

হতেও পারে। যেমন মানব সন্তান। প্রাকৃতিক কিন্তু মনুষ্য সৃষ্ট। নাসা বলছে, এই সেতুটির আবিষ্কার কেবল প্রত্নতাত্ত্বিকদের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নামা বিশ্বকে একটি পুরাণ ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে।

১৪৮০ সালের আগপর্যন্ত শ্রীলঙ্কা এবং ভারত অ্যাডামস ব্রিজ দ্বারা সংযুক্ত ছিল, যার ওপর দিয়ে একদেশ থেকে অন্যদেশে সহজেই যাওয়া সম্ভব ছিল। জানা যায়, ১৪৮০ সালে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে ব্রিজটি ভেঙে যায়।

উইকিপিডিয়া ও এনসাইক্লোপিডিয়া অনুসারে, অ্যাডামস ব্রিজ বা আদম সেতু কথাটি রাম সেতুর অনেক পরে চালু হয়। বাইবেলের সূত্র উল্লেখ করে একটি উপকথায় বলা হয়েছে, অ্যাডাম যখন পৃথিবীতে আসেন তারপর অ্যাডামস ব্রিজ নির্মিত হয়।

আবার সনাতনী উপকথায় বলা হয়েছে, ভগবান রাম শিবের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন এমন একটি সেতুর জন্য। এরপর তিনি সেতুর নির্মাণকাজে হাত দেন।

ভারতের ভূতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগের সাবেক পরিচালক ড. বদরিনারায়ণ সেতুটির ওপর একটি সমীক্ষা চালিয়েছিলেন। এটি মানুষের তৈরি কাঠামো বলে মতামত দিয়েছেন তিনি। তার নেতৃত্বে ব্রিজের সারিবদ্ধ গর্তগুলো খোঁড়া হয়েছিল। তারা দেখেছেন, মাটির প্রায় ২০ ফুট নিচে বুনো পাথর, প্রবাল এবং বোল্ডার। তারা বালির একটি স্তর খুঁজে পেয়েছিলেন প্রায় ৪-৫ মিটার নিচে এবং তার নিচেই ছিল ওই শক্ত শিলা স্তর।

ড. বদরিনারায়ণের মতে, বালির স্তরের উপস্থিতির কারণে অ্যাডামস ব্রিজের প্রাকৃতিক গঠন হওয়া অসম্ভব। প্রবাল সাধারণত শিলার ওপরে তৈরি হয়। সুতরাং এটি মনুষ্যনির্মিত নাকি প্রাকৃতিকভাবে তৈরি- এসব নিয়ে বিতর্ক থেকেই যাবে।

ড. বদরিনারায়ণ আরো বলেন, তারা সেতু সম্পর্কে যা পেয়েছেন তা প্রাকৃতিক শক্তি সীমার বাইরে বুদ্ধিদীপ্ত নকশার পরিচয় বহন করে। আরো বিস্তারিত জানতে তিনি ডাইভার দল পাঠিয়েছিলেন। যাদের বলা হয় স্কুব ডাইভার। তারা অক্সিজেন নিয়ে পানির নিচে ঘুরে বেড়ান, ভ্রমণ করেন পর্যবেক্ষণ করেন, ছবি তোলেন, নমুনা সংগ্রহ করেন। ডাইভাররা জলের নিজে অসংখ্য পাথরের বোল্ডার দেখতে পান। বিস্তারিত গবেষণার জন্য সেসব নমুনা সংগ্রহ করা হয়। গবেষকরা বলেন, বোল্ডারগুলো কোনো সাধারণ সামুদ্রিক গঠনের সমন্বয়ে তৈরি হয়নি।

বিজ্ঞানীরা লক্ষ করেছেন, ওই সেতুর বোল্ডারের ওজন ও আকার বেশি হওয়া সত্ত্বেও সেগুলো বালির ওপরে বসে ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সাউদার্ন ওরেগন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত প্রত্নতাত্ত্বিক চেলসিয়া রোজ যুক্তি দেখিয়েছেন, এর অর্থ পাথরগুলো অবশ্যই কৃত্রিমভাবে বালির ওপরে রাখা হয়েছিল। যদিও অন্যরা বলেছেন, এই ঘটনাটি কিছু নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে হয়ে থাকতে পারে। বিশেষ করে প্রাকৃতিক তরঙ্গ ক্রিয়া এবং পলি জমার কারণে এমন হতে পারে।

Thanjauvr Saraswathi Mahal Library-তে একজন ডাচ মানচিত্র জাতার ম্যাপ পাওয়া যায়। যেখানে তিনি ১৭৪৭ সালে একে Ramancoil এম অভিহিত করেছেন। শব্দটি তামিল Raman Kovil থেকে এসেছে, যার রাম মন্দির। একই গ্রন্থাগারে পাওয়া যায় মুঘল আমলে J. Rennel এর মানচিত্র। ১৭৮৮ সালের সেই মানচিত্রে এই এলাকাকে তিনি ‘রাম দূর এলাকা’ নামে চিহ্নিত করেছেন। পরিব্রাজক মার্কো পোলোর কাহিনিতে ওই জায়গাকে সেতুবন্ধ রামেশ্বরাম হিসেবে দেখানো হয়েছে। মার্কো পোলো একে আদম সেতু বলেও উল্লেখ করেছেন।

ভারত সরকার Sethusamudram Shipping Channel Project নামে একটি মাল্টিমিলিয়ন ডলার প্রজেক্ট হাতে নেয় ২০০৫ সালে। যার উদ্দেশ্য ছিল জাহাজ যাতায়াতের সুবিধার জন্য ধনুশকাড়ির জলের নিচে ড্রেজিং করে নৌ চ্যানেল বানানো। যাতে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার নৌপথ ঘুরে যাওয়ার দরকার হবে না। কিন্তু সেটি করতে হলে আদম সেতু বা রাম সেতুর বেশ বড়ো অংশের ক্ষতি হবে। তখন বিজেপি-সহ ভারতের নানা রাজনৈতিক ও সেই ‘রাম কর্মভূমি’ আন্দোলনের কথা।

হয়েছে “ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক সমীক্ষার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, সেতুটি মনুষ্যনির্মিত হওয়ার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ২০০৭ সালের একটি হলফনামায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছিল, সেতুটি যে রামের নির্মিত এরকম কোনো দালিলিক প্রমাণ নেই। ২০০৭ সালে ভারতের ন্যাশনাল রিমোট সেন্সিং এজেন্সির একটি প্রকাশনাতেও বলা হয়, সেতুটি মনুষ্যনির্মিত হতে পারে। তবে Archaeological Survey of India থেকে এর প্রমাণ মেলেনি।

ডিসকভারি কমিউনিকেশন্স-এর সায়েন্স চ্যানেলের What on Earth অনুষ্ঠানে (Ancient Land Bridge) রাম সেতুর উৎপত্তি নিয়ে একটি ভিডিয়ো প্রদর্শিত হয়। সেখানে নাসার স্যাটেলাইট ইমেজ ও প্রত্নতত্ত্ববিদদের গবেষণার সূত্র ধরে বলা হয়, রাম বা আদম সেতুর বালি ৪ হাজার বছর পুরোনো হলেও ওপরের পাথর ৭ হাজার বছরের পুরনো। তার মানে পাথর আগেই ছিল, পরে তার নিচে বালি জমেছে। সেখানে প্রত্নতত্ত্ববিদ চেলসি রোজ, ভূতত্ত্ববিদ ড. অ্যালান লেস্টারের বক্তব্য স্থান পেয়েছে। তাঁদের মতে, সেতুটি ৫ হাজার বছর আগে নির্মিত।

বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী জে. ভি. নরলিক বলেন, তিনি পৌরাণিক কাহিনির এই সেতু সম্পর্কে অনেক প্রতিবেদন দেখেছেন। তবে ‘রামায়ণ’-এ উল্লিখিত সেতুর সঙ্গে এই সেতুর সম্পর্ক রয়েছে এমন কোনো অকাট্য তথ্যপ্রমাণ নেই। তবে এক ব্রিটিশ মানচিত্রকার সেতুটিকে ‘অ্যাডামস ব্রিজ’ বলেছেন। এরপরেই তিনি উল্লেখ করেছেন, প্রথম মানব অ্যাডাম ঈশ্বরের কাছে অনুতাপ করার জন্য একটি পর্বতে গিয়েছিলেন। তিনি এক বছর ওই অনুতাপ প্রার্থনায় ছিলেন। তখন তিনি এই ব্রিজ ব্যবহার করেন।

ভারতের ইতিহাসবিদ আর এস. শর্মা জানান, আদম ব্রিজই যে রাম সেতু এই দাবিকে সমর্থন করার মতো কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক বা সাহিত্যিক প্রমাণ নেই। এটি প্রমাণ করা সহজও নয়। তারা এও বলেছেন, আদম ব্রিজসংলগ্ন জল সম্পর্কে যা জানা গেছে, তাতে সেতুটি মানুষ বানিয়েছে বলে কোনো তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এটি দেখতে সাধারণ স্যান্ডব্যাংকের (বালির বাঁধ। মতো।

ভাবজ্ঞানবিষয়ক চ্যানেল ‘হোয়াট অন আর্থ?’ ধারাবাহিকের একটি পর্বে অ্যাডামস ব্রিজ প্রসঙ্গ ছিল। এই চ্যানেলে দাবি করা হয়, সেতুটির নির্মাণ নির্বে আমের প্রাচীন হিন্দু পুরাণ সত্য হতে পারে। আবার একইসঙ্গে বলা হয়, রামের দ্বারা সেতু নির্মাণ ধারণা বা কল্পনা ছাড়া কিছুই নয়।

জার্মান সংবাদ সংস্থা ডয়েচে ভেলে দাবি করেছে, এসব তথ্য অস্পষ্ট অনুমান এবং কল্পনার মাধ্যমে প্রস্তুত করা। অনেক ভূতাত্ত্বিক গঠনের সাথে এর গঠনের বিবরণও নীরবচ্ছিন্নভাবে নিষ্পত্তি হয়নি এখনো।

আবার ভারতীয় ভূতাত্ত্বিক সি. পি. রাজেন্দ্রন বলেছেন, রাম সেতুসম্পর্কিত যুক্তি বা ধারণাগুলোতে বাস্তবের চেয়ে আবেগ বেশি গুরুত্ব পেয়েছে।

নাসার স্যাটেলাইটের মাধ্যমে এই সেতুর কয়েকটি ছবি তোলা হয়েছিল। সেখানে পানির নিচে কিছু বস্তুর উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। যেটি ভারত এবং শ্রীলঙ্কাকে যুক্ত করেছে। স্যাটেলাইট ইমেজ বিশ্লেষণে মনে হয়, ব্রিজটির গঠনগত দিকটি মোটেই প্রাকৃতিক নয় বরং মানুষের তৈরি। ধারণা করা হয় ব্রিজের পাথরগুলো দূর থেকে এনে ওখানে বসানো হয়েছে।

প্রেত্নতাত্ত্বিক চেলসিয়া রোজ বলেন, কীভাবে এখানে এই পাথরের টুকরোগুলো এলো এবং ব্রিজের মতো কিছুতে পরিণত হলো সেটি একটি রহস্য। যত দিন যাচ্ছে, রহস্য ঘনীভূত হচ্ছে।

তার মানে- গল্প এখানেই শেষ নয়। গল্পের অনেক ডালপালা আছে। অন্যদিকে, শ্রীলঙ্কান প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এক বিবৃতিতে বলেছে, অ্যাডামস ব্রিজের বয়স ১০ লাখ থেকে ২০ লাখ বছর হতে পারে। তবে এই সেতুটি প্রাকৃতিকভাবে তৈরি, নাকি মানুষ তৈরি করেছে তারা সেই ব্যাখ্যা দেয়নি।

এ বিষয়ে অবাক করার মতো বিপরীত তথ্যও পাওয়া গেছে। শ্রীলঙ্কানরা বিশ্বাস করেন, ওই সেতু রাবণ তৈরি করেছিলেন। রাবণের সেনাবাহিনী ওজনহীন প্রবাল দিয়ে তৈরি শিলার সাহায্যে ব্রিজ তৈরি করেছিল। তারা এটা তৈরি করেছিল ভারত পৌঁছানোর জন্য। প্রয়োজনশেষে তারাই এটি ভেঙে ফেলেছে অথবা ভেঙে যাওয়ার পর আর মেরামত করা হয়নি।

কারো কারো মতে, দীর্ঘদেহী হজরত আদম (আ.) যখন দুনিয়াতে আসেন, তখন তিনি শ্রীলঙ্কায় পতিত হন। তিনি অনুতপ্ত হয়ে এই পর্বতচূড়ায় টানা এক হাজার বছর প্রার্থনা করেন এক পায়ে দাঁড়িয়ে। তাঁর পায়ের ছাপ সংরিক্ষত আছে।

তিনি এই চূড়া থেকে নেমে স্থলপথে এ সেতু অতিক্রম করে চলে যান ভারতে এবং এক সময় আরাফাতের ময়দানে পৌছান। সেখানে জেদ্দায় বিবি হাওয়ার সঙ্গে তাঁর পুনর্মিলন হয়।

তবে অপ্রচলিত একটি মতবাদ আছে, আদম (আ.) ভারত থেকে এই সেতু পেরিয়ে ওই পর্বতের চূড়ায় গিয়েছিলেন। যদিও এগুলোর প্রামাণ্য কোনো রেফারেন্স মেলেনি। কোনো কাহিনিতে এরও উল্লেখ নেই, সেতুটি সেখানে আগে থেকেই কীভাবে ছিল, বা কীভাবে বানানো হয়েছিল।

কেউ কেউ বলেন, ধীরে ধীরে সমুদ্রের বুকে চর জেগে এই সেতু তৈরি হয়েছে। আবার কেউ বলেন, শ্রীলঙ্কা যখন ভারতের স্থলভাগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দূরে চলে যাচ্ছিল, তখনই এ সেতুর সৃষ্টি। যে চারকোনা পাথরগুলো দেখা যায়, সেগুলো সময়ের সাথে সাথে তৈরি হয়েছে প্রাকৃতিকভাবে।

সরাসরি সেতু পরীক্ষা না করে স্যাটেলাইট রিমোট সেন্সিং ডেটা ব্যবহার করে Indian Space Research Organisation (ISRO) এর Marine and Water Resources Group of the Space Application Centre (SAC) জানায় সেতুটি ১০৩টি অংশ বা ‘প্যাঁচ রিফে’ বিভক্ত। Geological Survey of India (GSI) ‘প্রজেক্ট রামেশ্বরাম’ নামে একটি গবেষণা চালায়। তাদের মতে, কার্বন ডেটিং অনুযায়ী, রামেশ্বরাম ও তালাইমান্নারের মাঝের অংশটি সমুদ্র থেকে উঠতে শুরু করে ৭ হাজার থেকে ১৮ হাজার বছর আগের কোনে এক সময়।

পশ্চিমাবিশ্ব প্রথম এ সেতুর কথা জানতে পারে ইবনে খোরদাদবেহের লেখা ‘Book of Roads and Kingdoms’ বই থেকে। বইটি আনুমানিক ৮৫০ সালে প্রকাশিত হয়। সেই নবম শতকে এ সেতু তিনি ‘সেতুবান্ধাই (সমুদ্রের সেতু) নামে লিপিবদ্ধ করেছেন। পরবর্তী সময়ে আল-বিরুনিওর সেতুর কথা বর্ণনা করেন। ১৮০৪ সালে একজন ব্রিটিশ মানচিত্রবিদ একে ‘আদম সেতু’ বলে উল্লেখ করেন।

নাবিকদের মতে, অগভীর জলের কারণে আদম সেতু পক্ প্রণালির মধ্য দিয়ে চলাচলের ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করে। এসব কারণে ভারত-শ্রীলঙ্কা বা অত্র এলাকায় বাণিজ্য প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছিল। পশ্চিম থেকে সমুদ্রগামী বড়ো জাহাজ ভারতীয় উপকূলে পৌছাতে শ্রীলঙ্কার চারপাশ ঘুরে যেতে হচ্ছিল।

ব্রিটিশ ভূগোলবিদ মেজর জেমস রেনেল, যিনি আঠারো শতকের শেষের দিকে একজন তরুণ অফিসার হিসেবে অঞ্চলটি জরিপ করেছিলেন, তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন, রামেশ্বরাম দ্বীপটি খনন করে নৌচলাচল অব্যাহত রাখা পারে। প্রস্তাবটি তখন কেউ গ্রাহ্য ৬০ বছর পরে আবার সামনে এসেছিল।

ব্রিটিশ আমলে, ১৮২৩ সালে স্যার আর্থার কটন ‘পাম্বান চ্যানেল’ সমীক্ষার জন্য নিযুক্ত হয়েছিলেন। তাকে বলা হয়েছিল, ভারতীয় মূল ভূখণ্ডকে রামেশ্বরাম দ্বীপ থেকে পৃথক করে আদম সেতুর প্রথম লিঙ্ক তৈরি করতে। ভূতাত্ত্বিক প্রমাণগুলো ইঙ্গিত দেয় যে, অতীতে সেতুর মাধ্যমে ভূমি সংযোগ ছিল। স্থানীয় মন্দিরের রেকর্ড থেকে দেখা যায়, ঝড়-বন্যা এবং জলোচ্ছ্বাসের কারণে সংযোগটি ১৪৮০ সালে ভেঙে গিয়েছিল। আর্থার কটন পরামর্শ দিয়েছিলেন, চ্যানেলটি জাহাজ চলাচলে সক্ষম করার জন্য ড্রেজিং করা যেতে পারে। তবে ১৮২৮ সাল পর্যন্ত তেমন কিছুই করা সম্ভব হয়নি। এ সময় মেজর সিম সেতুটির কিছু পাথর বিস্ফোরণ এবং অপসারণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তবে উনিশ শতকের এসব প্রচেষ্টা সফলতার মুখ দেখেনি।

আদম সেতু নিয়ে যত বিতর্কই থাকুক না কেন, এটা সত্য যে, সেখানে একটি ব্রিজের অস্তিত্ব ছিল। যার চিহ্ন এখনো রয়েছে। যতটুকু সাক্ষ্যপ্রমাণ মিলেছে তাতে সেটি যে ‘আদম সেতু’ বা ‘অ্যাডামস ব্রিজ’ সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তারপরও অ্যাডামস ব্রিজ নিয়ে রহস্যের শেষ নেই। সম্ভবত পৃথিবী ধ্বংসের আগপর্যন্ত এই রহস্য থেকেই যাবে।