নাহিদা আশরাফী; কবি, গল্পকার , প্রাবন্ধিক, সম্পাদক ও প্রকাশক। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো, এপিটাফ(কাব্যগ্রন্থ , ২০১৫), শুক্লা দ্বাদশী (যৌথ কবিতাগ্রন্থ,২০১৬), দীপাঞ্জলি (যৌথ কবিতাগ্রন্থ,২০১৬), মায়াবৃক্ষ (গল্পগ্রন্থ, ২০১৬), প্রেম নিয়ে পাখিরা যা ভাবে (কাব্যগ্রন্থ-২০১৮) এবং জাদুর ট্র্যাঙ্ক ও বিবর্ণ বিষাদেরা (গল্পগ্রন্থ- ২০২০ জলধি সংস্করণ)। লাদেশে জন্ম এই লেখক, কবি, সম্পাদক ও গল্পকার হিসেবে দেশে ও দেশের বাইরে সম্মানিত ও পুরস্কৃত হয়েছেন বহুবার। এরমধ্যে অপরাজিত সাহিত্য পুরস্কার,উদ্ভাস সাহিত্য সম্মাননা, সমতটের কাগজ সাহিত্য সম্মাননা, আলোক সাহিত্য পুরস্কার, সাহিত্য দিগন্ত লেখক পুরস্কার, অনুষা সাহিত্য সহযাত্রী সম্মাননা (কলকাতা), বঙ্গবন্ধু স্মারক সম্মাননা (আগরতলা), যুগসাগ্নিক বর্ষসেরা সম্পাদক (কলকাতা), পিস অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার সম্মাননা (আসানসোল),ওয়ার্ল্ড পোয়েট্রি ফর পিস সম্মাননা(চেন্নাই) উল্ল্যেখযোগ্য। এবার ছোটকাগজ ‘জলধি’ সম্পাদনার জন্য পাচ্ছেন ‘বগুড়া লেখক চক্র পুরস্কার-২০২১’। লেখালেখি, ছোটকাগজ সম্পাদনা ও পুরস্কারপ্রাপ্তি নিয়ে কমল ঠাকুরের মুখোমুখি হয়েছেন তিনি।
কমল ঠাকুর: লিটলম্যাগ সম্পাদনার জন্য এবার পাচ্ছেন ‘বগুড়া লেখক চক্র-২০২১’ পুরস্কার। কেমন লাগছে আপনার? সাহিত্য পুরস্কার কি লেখককে যথার্থভাবে মূল্যায়ন করে?
নাহিদা আশরাফী: ভালো না লাগার যেমন কোনো কারণ নেই, তেমনি অতিশয়োক্তিও করতে চাই না। যেকোনো পুরস্কারই আমার কর্মস্পৃহা বাড়ায়, সেই সঙ্গে কাজের প্রতি দায়বদ্ধতাও তৈরি করে। কাজের প্রতি এই যে ভালো লাগা তৈরি করা, দায়িত্ব বাড়িয়ে দেওয়া, এভাবে ভাবলে পুরস্কারের ইতিবাচক দিকটা অবশ্যই আনন্দের। আর পুরস্কার পেয়ে পা যদি মাটি ছেড়ে ওপরে উঠে যায়, তাহলে ক্ষতিটা তারই। সাহিত্য পুরস্কার লেখককে মূল্যায়ন করে। তবে যথার্থ শব্দটা যেহেতু আপেক্ষিক এবং ব্যক্তিভাবনাকেন্দ্রিক, সেহেতু এ নিয়ে বহুমত রয়েছে। বগুড়া লেখক চক্র দীর্ঘদিন তাদের সাহিত্য যাত্রা জারি রেখেছে। এটা খুব সহজ কাজ নয়। সাহিত্যে নিবেদিত না হলে এটা এক প্রকার অসম্ভব। নিরপেক্ষ নির্বাচনেও তাদের সুনাম রয়েছে, যা প্রাক্তন পুরস্কার প্রাপ্তদের তালিকা থেকেই অনুমেয়। সেই তালিকায় নিজের নাম যুক্ত হচ্ছে, নিজের ও জলধির পক্ষ থেকে তাদের আন্তরিক ধন্যবাদ ।
কমল ঠাকুর: বাংলা একাডেমির সাহিত্য পুরস্কার নিয়ে সম্প্রতি সাহিত্যপ্রেমীদের মধ্যে নেতিবাচক ধারণার জন্ম হয়েছে। এজন্য আপনি কাকে দায়ী করবেন?
নাহিদা আশরাফী: আপনার প্রশ্নেই কিন্তু উত্তর লুকিয়ে আছে। সত্যিকারের সাহিত্যপ্রেমীদের মধ্যে যদি নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়, তাহলে বাংলা একাডেমি কেন যেকোনো সংগঠন-প্রতিষ্ঠানকেই তার দায় নিতে হবে। তবে ‘অমুককে পুরস্কার দেওয়া হলো কেন? তমুককে দিলে ভালো হতো’, ‘আমি-আমার দল-গোষ্ঠীর সমর্থক পাইনি-পায়নি; তাই পুরস্কার ভালো হয়নি’ অথবা স্রেফ ব্যক্তিগত ঈর্ষা থেকে কাদা ছোড়াছুড়ি টাইপ কিছু সাহিত্যমোদীও আছেন। বলতে দ্বিধা নেই, সে তালিকায় আমাদের বেশ কিছু স্বনামখ্যাত কবি-সাহিত্যিকও রয়েছেন। যাকেই পুরস্কার দেওয়া হোক না কেন, তা নিয়ে নেতিবাচক দু’কথা না বললে তারা ঠিক আমোদ পান না। খেয়াল করলে দেখবেন, নোবেল থেকে শুরু করে যেকোনো দেশি কিংবা আন্তর্জাতিক পুরস্কারই প্রশ্নবিদ্ধ। তবে প্রতিষ্ঠান যদি নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে পারে, তবে এই বিতর্ককে পাশ কাটিয়ে সৎ ও নির্মোহ বিশ্লেষণের অধিকারী লেখকরা সেই পুরস্কারকে সানন্দেই গ্রহণ করেন বলে বিশ্বাস করি।
কমল ঠাকুর : আপনি দীর্ঘদিন ধরে লিখছেন। ছোটকাগজ সম্পাদনা করছেন, একটি সার্থক ছোটকাগজের বৈশিষ্ট্য কী হওয়া উচিত বলে মনে করেন?
নাহিদা আশরাফী: পুঁজিবাদী সভ্যতার একটা নির্মম আর নিষ্ঠুর চেহারা রয়েছে। তার বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে লিটল ম্যাগাজিন বা ছোটকাগজের নিত্যযুদ্ধ। ছোটকাগজ সংকটে ও সম্ভাবনায় কতটা পিঠ সোজা রেখে , নৈতিকতা বিসর্জন না দিয়ে চলতে পারে; তা ভাবার সময় পেরিয়ে গেছে। এ কথার মানে এমন নয় যে লিটল ম্যাগের বৈশিষ্ট্য বা এর সক্ষমতা-অক্ষমতা নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই। তবে তার টিকে থাকার প্রাণান্তকর লড়াই যে সব যুগেই ছিল, আছে ও থাকবে। তাকে এই অগ্নিপরীক্ষায় সর্বকালেই উত্তীর্ণ হতে হবে, তা নিয়ে বোধ করি দ্বিমত করার অবকাশ নেই।
সাহিত্যের সৃজনশীলতাকে দ্বিধাহীন চিত্তে গ্রহণ, নব চিন্তা ও চেতনায় অগ্নিস্ফূলিঙ্গের সঞ্চার, ব্যক্তি ও সামগ্রিক মূল্যবোধের মূল্যায়ন, তারুণ্যের চিৎকারকে স্বাগত জানানো, রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক বৈষম্য ও শোষণের বিরুদ্ধশক্তি হিসেবে নিজের অবস্থানকে পরিষ্কার উপস্থাপনই ছোটকাগজকে আলাদা করে অন্য সব কিছু থেকে ৷ সংঘাতে ও সংগ্রামে লিটল ম্যাগকে সাহিত্যের অস্ত্রাগার বলেই ভাবি আমি। জন্মেই যে সুতীব্র চিৎকারে জানান দেয়, আজন্মের ক্রোধ, শিশুকাল অতিক্রম করতে করতেই যে ঘোষণা দেয় নবতর জীবনবোধের, কৈশোরে যে প্রতিবাদী আর দুর্দান্ত আঠারোয় যে বুর্জোয়া মানসিকতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে মোহ আর মাৎসর্যের থোড়াই কেয়ার করে সত্য ও সৃজনের গান গায়। যাকে ক্রফোর ‘প্ল্যানড ভায়োলেন্স’-এর সঙ্গে তুলনা করা চলে। চর্বচূষ্যপেয় করপোরেট বা ভোগবাদী পত্রিকা যখন তালিয়া বাজানো লেখক তৈরি করে, তখন লিটল ম্যাগ সাহস, সময় ও স্বাতন্ত্র্য তৈরি করে। আবদুল মান্না সৈয়দের মতো করেই বলতে হয়, ‘লিটল ম্যাগাজিন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে একটি ব্যাক্তিগত সুঁড়িপথ’। এই সুঁড়িপথ দিয়েই স্বরচিত সুরের আলো ও স্বরের গাম্ভীর্য চোখে পড়ে। আর বারুদ ভরা লিটল ম্যাগের এসবই প্রধানতম বৈশিষ্ট্য বলে মনে করি।
কমল ঠাকুর: এই সময়ের কবিদের মতে, সমকালীন সমালোচনা সাহিত্য অনেকটাই দুর্বল, বেশিরভাগই লেখকের গুণগান আর সম্পর্কের চর্চা। এ সম্পর্কে আপনি কী বলবেন?
নাহিদা আশরাফী: সমকালীন সমালোচনা সাহিত্য কেন দুর্বল, এই প্রশ্নের উত্তরটা একজন ছোটকাগজের কর্মী হিসেবে নিজের মতো খুঁজে নিয়েছি। হয়তো এর সঙ্গে আর কিছু যোগ হতে পারে। আমার মতে কয়েকটি কারণ খুবই সুস্পষ্ট।
১- পাঠ বিশ্লেষণী জ্ঞান ও দক্ষতার অভাব
২-পাঠ অভিজ্ঞতার সুচারু ও সাবলীল প্রকাশের অক্ষমতা
৩- পাঠ পর্যালোচনার উপযোগী ও প্রয়োজনীয় ভাষাজ্ঞানের অভাব
৪-বিশ্ব সাহিত্যের প্রতি পাঠ পর্যালোচকদের উদাসীনতা ও সীমাবদ্ধতা যা তার পঠিত গ্রন্থের মান ও সৌসাম্য বিচারে যথাযথ ভূমিকা গ্রহণে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় ।
এবার আসছি গুণগান আর সম্পর্কচর্চায়। আমি যখনই লেখকদের মধ্যে সম্পর্কের দলীয় সংগীতচর্চা দেখি তখনই নরম্যান ভিনসেন্ট পিলের একটা উক্তি খুব মনে পড়ে, ‘আমাদের বেশিরভাগের সমস্যা হলো আমরা বরং সমালোচনা দ্বারা বাঁচার চেয়ে প্রশংসার দ্বারা নষ্ট হয়ে যাবো।’ আমার মনে হয় এই একটি উক্তিই আমাদের বর্তমান সাহিত্য চর্চায় যে তেলবাদ, স্বজনপ্রীতি, দলকানা মনোভাবের বিস্তার, তার চিত্র পরিষ্কার ফুটে উঠেছে।
কমল ঠাকুর: বর্তমান ফেসবুক ও অনলাইন পোর্টালের কল্যাণে সাহিত্যচর্চা যেমন বেড়েছে; তেমন সাহিত্যের চৌর্যবৃত্তিও বেড়েছে। এর থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় আছে?
নাহিদা আশরাফী: না নেই। দরজা খোলা রেখে চোর ঠেকানোর উপায় আছে কী? বিশ্বায়নীভবনে সব কিছুই উন্মুক্ত। খোলা বাজারে মাছি তাড়ানোর পথ নেই। তাই সাবধান নিজেকেই হতে হয়। নতুন বা অপ্রকাশিত লেখা আপনি সামাজিক মাধ্যমে ছেড়ে দেবেন আর দু’চার লাইন বা পুরো লেখাই গায়েব করে দেবে না, এমন সৎ চোর আপনি একটিও পাবেন না। চৌর্যবৃত্তি কালে কালে ছিলো, আছে এবং থাকবে। বরং বলতে পারেন আগে এত ধরা পড়তো না। এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে ধরা পড়ছে। ইংরেজিতে এহেন চৌর্যবৃত্তির দারুণ একটা নাম আছে, Plagiarism। আর সাহিত্য চৌর্যবৃত্তির সঙ্গে জড়িতকে বলা হয় Plagiarist, যার বাংলা হচ্ছে ‘কুম্ভীলক’। খোদ রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধেও এ অভিযোগ রয়েছে। আমাদের প্রধানতম সমস্যা হচ্ছে বিশ্বায়নের এই সময়ে এসেও আমরা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের যথাযথ ব্যবহার করতে পারছি না। আমি শুধু বিশ্বাস করি চুরি করা বা ধার করা বিদ্যায় আর যাই হোক সাহিত্য চর্চা হয় না। তাকে একদিন না একদিন ধরা পড়তেই হয়। তবু মেধা চুরির ব্যাপারে ডিজিটাল আইনের আরও সুস্পষ্ট ও কার্যকর আইন থাকা জরুরি।
কমল ঠাকুর : আপনি কি সাহিত্যে দশক বিভাজনে বিশ্বাস করেন? সাহিত্যে দশক বিভাজন কি খুবই গুরুত্বপূর্ণ? যদি বিশ্বাস করেন, তবে নিজেকে কোন দশকের বলে দাবি করেন? ছোটকাগজ সম্পাদক হিসেবে আপনি বিষয়টি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
নাহিদা আশরাফী: না, সাহিত্যে দশক বিভাজনে আমি আস্থা রাখি না। গোলমেলে বিষয় কখনোই গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে না। দশক দিয়ে সাহিত্য বা সাহিত্যিককে বিচার করা মানে তাকে একটা গণ্ডির মধ্যে বেঁধে ফেলা। কয়েকটি প্রশ্ন অবধারিতভাবে আমার মনে মাঝেমধ্যেই ঘাই তোলে। দশকের কবি বা লেখক বাছাই করেন কে? লেখক নিজে, পাঠক, প্রকাশক না কি অন্য কেউ? আমি ঠিক জানি না দশকওয়ারি এই বিতর্ক কবে থেকে শুরু হয়েছিল। আমার জানা নেই রবীন্দ্রনাথ কোন দশকের? জীবনানন্দ , জসীমউদ্দীন কোন দশকের? শেকল ভাঙার বিশ্বাসে বিশ্বাসী মানুষ আমি । তাই দশকের বন্দিদশায় সাহিত্যকে দেখলেই আমি হাসফাঁসিয়ে উঠি, আমার মর্মমূলে আঘাত লাগে। খোন্দকার আশরাফ হোসেন যাকে সবাই আশির দশকের কবি হিসেবেই চেনেন তিনি নিজেই তার দশকওয়ারি অবস্থানকে বেশ রসে ভিজিয়ে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। তার বয়ানটুকু তুলে ধরছি সঙ্গত কারণেই।
‘ষাট দশকের বাসেই উঠব উঠব করে ভাবছিলাম, দেখি খুব ভিড়, ঠেলাঠেলি, বাসের ভেতরে, ছাদে, পাদানিতে অসংখ্য কবি; বাস ছেড়ে যেতে যেতে দরজায় দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, জায়গা নেই। আমার ওঠা হলো না।… তারপর সত্তর দশকের বাস গেলো, সেখানেও প্রচুর ভিড়, হৈ চৈ, স্লোগান, উঠব উঠব করে ওঠা হলো না। আশির দশকের বাস দেখি হেলেদুলে আসছে, ফাঁকা, ভিড়-ভাট্টা নেই। উঠে পড়লাম।’একজন লেখক টিকে থাকেন তার মেধার জোরে, মননের শক্তিতে আর চিন্তার আধুনিকতায়। দশক তাকে কেমন করে ছুঁতে পারে। জানেন তো,
‘এক দশকে সংঘ ভেঙে যায়
সংঘ তবু পায়না সত্যকে’