নিজেই নিজের অন্ধকার


নদীর বুক ভরা পানি না থাকলে, তার যৌবন থাকে না। দুকূল উপচানো ঢেউ থাকে না। যৌবনের গান থাকে না। পলিমাটির স্বপ্নও থাকে না। ফসলের গান তখন বহু দূরের হয়ে যায়। স্বপ্নরা তখন খরার রোদে পোড়ে। সম্পর্কের গভীরে এখন টাকা নদীর বুকভরা পানির মতো। টাকা না থাকলে সম্পর্ক এখন সম্পর্ক থাকে না, প্রেম থাকে না, পরিবার থাকে না, রক্তের বন্ধন থাকে না, স্বপ্ন থাকে না, বন্ধুত্ব; ওসব কিছুই থাকে না। নদীর বুকে ভরা পানি যেমন নদীর যৌবন; দিগন্তবিস্তারি স্বপ্নবুননের গল্প, পুরুষের যৌবন মানে টাকা। টাকা না থাকলে গভীর সম্পর্ক গভীর থাকে না, বাতাসে ছেঁড়া কাগজের মতো উড়ে যায় সম্পর্কের সাত-সুতো সব।

ডেকো কখনো ভাবেনি জোহার সঙ্গে তার গভীর বন্ধুত্ব একসময় অব্যবহারযোগ্য ময়লা কাগজ হয়ে যাবে। ডেকো হিসাবটা মেলাতে পারে না। চাকরি না-থাকা, টাকা না-থাকার সঙ্গে বন্ধুত্বেও বন্ধুত্বহীনতার কী সম্পর্ক! তার মাথার ভেতর ঘুরপাক খায় এসব চিন্তা।

আকস্মিকভাবে ডেকোর চাকরিটা চলে যায়। কেন তাকে চাকরিচ্যুত করা হলো সে নিজেও জানে না। কওয়া নেই বলা নেই একদিন হুট করেই চাকরি হাওয়া হয়ে গেলো। চাকরির বাজার এখন কঠিন। দক্ষ কত লোকজন এসে দরজায় বসে থাকে চাকরির আশায়। ফলে ডেকোর জন্যও যে চাকরি নতুন করে পাওয়া কঠিন হবে, এটা সে নিজেও বোঝে। দুশ্চিন্তাটা ওখানেই বেশি। ডেকো বেশ কয়েকমাস পরিবারে কারও সঙ্গেই ব্যাপারটি আলোচনা করেনি। নিজের স্ত্রীর সঙ্গেও নয়। মেয়ে জারিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, তাকেও কোনোভাবেই বুঝতে দেয়নি। এমনকি বন্ধু জোহাকেও নয়। সবাই জানে ডেকোর চাকরিটা ঠিকঠাক মতোই চলছে। পরিবারে ডেকো সে-রকমই আচরণ করে। বোঝার কোনো উপায় নেই, সে কঠিন একটা অবস্থার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। মানসিকভাবে সে যে বিধ্বস্ত, তাও বোঝা যায় না, বুঝতে দেয়ও না। নিজের সঙ্গে নিজেই দারুণ এক অভিনেতা। নিখুঁত অভিনয় করে চলে প্রতিদিন।

কিন্তু একদিন জারিয়া বুঝতে পারে তার বাবার চাকরিটা নেই। অনেক আগে থেকেই নেই। তার বাবা যে অফিসে চাকরি করতেন, সেই অফিসেই তার বন্ধু জাহিয়ার বাবা জয়েন করেছে, তারই বাবার পোস্টে। জাহিয়া যখন উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে তাকে, তার বাবার অফিস সিঅ্যান্ডসি ইন্টারন্যাশন্যাল কোম্পানি থেকে তাদের সিঙ্গাপুরে বেড়াতে নিয়ে যাবে। একসপ্তাহের ট্যুর। জারিয়া তখন বিষয়টি নিজের সঙ্গে মেলাতে পারে না। প্রথমত সে জানতো জাহিয়ার বাবা অন্য একটা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। এ প্রতিষ্ঠানে কবে যোগ দিয়েছেন, সে জানে না। আর একটা বিষয় হলো, এই একই অফিসে তার বাবাও চাকরি করেন। প্রতিবছরই কোনো না কোনো দেশে অফিস থেকে তাদের ঘুরতে যাওয়ার ব্যবস্থা করে। কিন্তু এবার বাবা এখনো তাদের এ ব্যাপারে কিছুই বলেননি। ব্যাপারটি তার মাথার ভেতর ঘুরপাক খেতে থাকে। জাহিয়াকে সে কিছুই বলে না। কিন্তু একটা খারাপ লাগা তার মধ্যে তৈরি হয়, কিছু প্রশ্ন চলে আসে মাথার ভেতর। তার মধ্যে একরকম মানসিক অস্থিরতা তৈরি হয়।

ব্যাপারটা বাবাকে বলবে বলবে করেও বলতে পারে না জারিয়া। বাবাকে জিজ্ঞেস না করে হুট করে একদিন জোহা সাহেবকে ফোন করে, আংকেল, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো। ঠিকঠাক বলবে তো! বাবার সঙ্গে কিন্তু ব্যাপারটা শেয়ার করা যাবে না। কোনোভাবেই শেয়ার করবে না। যদি প্রমিজ করো, তাহলে বলতে পারি।
জারিয়া বলার আগেই জোহা বুঝতে পারে সে কী বলতে চায়! যদিও ডেকো নিজেও সে কথা তাকে নিজের থেকে কখনোই বলেনি। কিন্তু সে সবই জানে। ডেকো চাকরিহীন হয়ে, চাকরি করছে এরকম একটা অভিনয় করে পরিবারের সঙ্গে চলছে। কিন্তু এই কয় মাসে তার চেহারায় দুশ্চিন্তা মাকড়সার জালের মতো জড়িয়ে গেছে। সংসারেও কেমন খিটমিটে স্বভাবের হয়ে গেছে। একটুতেই অশান্তি করে। চিৎকার চেঁচামেচি করে। যা তার স্বভাবে কখনোই ছিল না। কিন্তু কেউই কিছু বুঝে উঠতে পারে না, ডেকো কেন এরকম করছে! ডেকো কিন্তু কিছুই বুঝতে পারে না, সে যে দিন দিন অস্বাভাবিক হয়ে উঠছে!
আংকেল চুপ করে আছো যে! কিছু বলছো না যে!
ও হ্যাঁ, বলো।
আংকেল তুমি মনে হয় অনেক ব্যস্ত। আমি না হয় পরে কথা বলি!
নারে ব্যাটা, ওরকম কিছু নয়। তুমি কী বলবা, বলো।

মন খারাপ করে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইলো সে, তুমি তো জানো বাবার চাকরিটা আছে কি নেই? বাবার পোস্টে তো অন্য একজন চাকরি করেন! এটা ঠিক কি না, বলো।
ঠিক তো।

কেমন যেন মুহূর্তে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে জারিয়া। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বললো, আংকেল, তোমার অফিসে এখন একটু আসতে চাই।
আমার অফিসে আসার জন্য তোমাকে অনুমতি নিতে হবে কেন! আগে তো কখনো এরকম করে বলোনি। হুটহাট করে কতই এসেছ।
বাবার চাকরি নেই জেনে মনটা কেমন যেন দুর্বল হয়ে গেছে আংকেল। আচ্ছা আংকেল আমি আসতেছি। এসে কথা বলি।
জারিয়াকে অনেক স্নেহ আদর করে জোহা। একেবারের আপন ভাতিজির মতো। এই ধারণা নিয়েই সে বড় হয়েছে। বড় হচ্ছে। আপন কাকা বলতে জোহাকেই বোঝে সে। যে কারণে এরকম বিপদের কথা শুনে সে মায়ের সঙ্গেও শেয়ার করেনি। জোহার কথাই তার প্রথম মনে হয়েছে। তার কাছেই ছুটে গেছে। জোহার কথায় ব্যবহারে আন্তরিকতার কোনো অভাব নেই। কী খেয়েছে, না খেয়েছে, এসব জিজ্ঞেস না করেই তার জন্য খাবার রেডি করে।

জারিয়া বললো, আংকেল তুমি তো বাবার শুধু বন্ধুই নও, ভাইও তো। তুমি কত বড় ব্যবসা করো। বাবাকে তোমার অফিসেই তো রাখতে পারো। ভাইয়ে ভাইয়েও তো একসঙ্গে কাজ করে।

জারিয়ার কথায় জোহা দ্বিমত করে না। জারিয়াকে বললো, আমার তো তাতে কোনো আপত্তি নেই। ডেকো নিজেই আমার থেকে দূরত্ব রেখে চলে। ওর চাকরিটা নেই আমি আগে থেকেই জানি। কিন্তু ও আমাকে কিছু বলেনি, সে কারণে আমিও নিজের থেকে ওর কাছে কিছু জানতে চাইনি। ওর তো আবার ঘাড়ত্যাড়া স্বভাব। যে-কোনো কিছুতে অল্পতেই মাইন্ড করে। এই যুগে কি ওরকম করে চলা যায়! কত কিছুতে আপস করতে হয়। পছন্দ না হলেও মানতে হয়। ওর কাছে এসব কথার পাঁচ পয়সা দামও নেই।
কিন্তু আমিও তো বাবাকে বলতে পারবো না। আমি বললে তো বাসায় আগুন ধরিয়ে দেবে। চাকরি নেই নিজের থেকেই তা বলেনি, এখনো বলে

না। কয়েকদিন ধরেই শুনছি, চাকরি আর করবে না। বাড়ি চলে যাবে। খুলনায় গিয়ে কাপড়ের ব্যবসা করবে। কিন্তু মূল কারণটা তো আমি এখন জানলাম।

ওই যে বললাম। ঘাড়ত্যাড়া স্বভাব। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরি তো এরকমই। এটা ওকে কে বোঝাবে! আমি যদি ওকে আমার এখানেও চাকরি করতে বলি, নিশ্চিত করবে না। ওকে তো চিনি।

জারিয়া একটা কথাও বললো না। বাবাকে নিয়ে এ-রকম কথা শুনতে তার একটুও ভালো লাগছে না, তবুও শুনছে। জারিয়া মন খারাপ করে সোফায় বসে থাকে। অত সুন্দর মুখটা ভারী মেঘের মতো লাগে। জোহা উঠে গিয়ে জারিয়ার পাশে বসে। বলে, তুমি যখন বলছ, তোমার বাবাকে বলবো, আমার অফিসে নিয়মিত বসতে।
সত্যি আংকেল তুমি বলবে?

বললাম তো বলবো। জারিয়ার মুখটা দুহাতে নিয়ে আদর করে বুকের কাছে নেয় জোহা সাহেব। জারিয়া ভাবে, জোহা আংকেল তার জীবনে বড় একটা আশ্রয়। দুশ্চিন্তা করো না; বলেই জারিয়ার ঠোঁটে আকস্মিকভাবে চুমু খায় সে। জারিয়া এটা কোনোদিনই কল্পনা করেনি। তার মাথার ভেতর যেন একটা পাহাড় ভেঙে পড়লো। তার নিচে যেন সে দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। বুকের ভেতর কেমন যেন কাঁপছে, নদী ভাঙনের মতো। কিন্তু জোহা এসবের কিছুই বুঝতে পারলো না। খুব স্বাভাবিকভাবে বললো, জারিয়া, তুমি এখন বাসায় যাও। তোমার বাবার ব্যাপারটা আমি দেখবো।
জারিয়ার পা দুটো যেন সেখানে মেঝের ভেতর গেঁথে গেছে। উঠতে পারছে না। জোহা এ রকমটা করবে তার সঙ্গে—এটা তার কল্পনারও বাইরে ছিল। মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। তারপরও স্বাভাবিকতার ভান করে বাসায় ফেরে। বাবা তখনো ফেরেনি। বাবা ফিরলে তার মুখের দিকে তাকাতে পারে না জারিয়া। জোহার সেই মুহূর্তের মুখটা ভেসে ওঠে। কিন্তু সে-কথা কাউকে বলতে পারে না। ডেকো নিজেই এগিয়ে গিয়ে জারিয়ার মুখটা আদর করে বুকের কাছে টেনে নিয়ে বলে, মা, কোনো সমস্যা?

বুক ভেঙে কান্না ঠেলে আসে। বাবা কতদিন এমন করে আদর করেনি! এমন করে আদর দিয়ে কথা বলেনি। কিন্তু সে জানে বাবা নিজের সঙ্গে অভিনয় করে চলছে। এ কষ্ট যেমন তাকে পোড়াচ্ছে, জোহা আদরের কৌশলে তার সঙ্গে যা করেছে, সেটাতেও নিজের ভেতর ঝড়ে ডানাভাঙা পাখির মতো যন্ত্রণায় আছড়াচ্ছে। কিন্তু সে কাউকেই কোনো কিছুই বলতে পারছে না। নিজেকেই নিজের পুরো যন্ত্রণার সঙ্গে যুদ্ধ করতে হচ্ছে। জারিয়া কেঁদে ফেলে। কান্না লুকাতে চেয়েও লুকাতে পারলো না।
মা কাঁদছো কেন তুমি? কী হয়েছে তোমার? কোনো সমস্যা?
না বাবা, কিছু হয়নি। চোখ মুছতে মুছতে ভেজা কণ্ঠে মিথ্যে করে বলে জারিয়া।
তোর মুখ দেখে আমি কিন্তু সব বুঝতে পারি মা।

শুধু বাবারাই বুঝি মেয়ের মুখ দেখে সব বুঝতে পারে, বাবা? মেয়েরা বুঝি বাবার মুখ দেখে বাবার কিছুই বুঝতে পারে না? আমিও সব বুঝি বাবা। তুমি নিজেকে আর কত লুকাবে!

ডেকোর বুকটা কেঁপে ওঠে। জারি কি বোঝাতে চাইছে! তাহলে ও কি সব জানে! জানে জানুক। কিন্তু এই সত্যটা জারিয়ার মুখ থেকে সে শুনতে চায় না। এ তার সহ্য হবে না। তার সব অভিনয় প্রকাশ পেয়ে যাবে, সবার কাছে ছোট হয়ে যাবে। হয়তো ভেতরে ভেতরে সবার কাছে সে ছোট হয়েও গেছে। তারপরও তা প্রকাশ না পাক। ভেতরে ভেতরেই থাকুক। না, তাকে কিছুই জিজ্ঞেস করে না ডেকো। সে যা বোঝার বুঝে নেয়। অর্ধমৃত যেন এক মানুষ বিবর্ণ চেহারায় নীরবে নিজের রুমে চলে যায়।

ডেকো যখন খুলনা চলে যাওয়ার জন্য একেবারেই তৈরি, পুরো সংসার নিয়েই চলে যাবে। শুধু জারিয়া ঢাকায় থাকবে পড়ালেখার জন্য। তাতে জারিয়া একটা অন্ধকার মেঘ অনুভব করে। সবাই চলে গেলে সে কিভাবে ঢাকায় থাকবে! আগে তো কখনো একা থাকেনি। এত টাকাই বা কে দেবে! বাবা কাপড়ের দোকান করে ব্যবসায় লাভবান হবে, না কি ফতুর হবে—কে জানে। মায়ের সঙ্গে কয়দিন ধরেই প্রতিদিন অশান্তি করছে। পুরো বাসাটা আগুনের বাতাসে ভাসছে। জারিয়া ঘুরেফিরে জোহাকেই বলে, বাবার জন্য কী করতে। জোহা সুন্দর করে মিথ্যে বলে, তোমার বাবা আমার কথা না শুনলে কী করবো বলো! কতবার বলেছি। এ-কারণে এত বছরের বন্ধুত্বটাই ভাঙতে বসেছে। এখন তো সে কথাই বলে না। দেখাও করে না।

আর কেউ নেই, যাকে জারিয়া বলতে পারে বাবার জন্য। বাবার বন্ধু হিসেবে জোহার সঙ্গেই তার সম্পর্ক। চেনাজানা সব। আপন চাচার মতোই ঘনিষ্ঠতা। নিজের লেখাপড়া নিয়েও অনিশ্চয়তা বোধ করে। না কি পড়ালেখা বাদ দিয়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে খুলনা চলে যেতে হবে, তার চোখেমুখে অন্ধকার নেমে আসে। ডেকোর চাকরি চলে যাওয়ার পরে জোহা তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করে না। যদি সে টাকা-পয়সা চায়! কিংবা অফিসে চেয়ার চায়! এসব ভেবে ডেকো থেকে বহু দূর দিয়ে চলে জোহা। কিন্তু জারিয়াকে সে কখনোই উপক্ষো করে না। মেয়েটা ঠিক তার অর্ধেক বয়সী। বাহ্যিকভাবে তাকে সন্তানের মতো করে দেখলেও ভেতরে ভেতরে তার প্রতি সে একটা আসক্তি অনুভব করে। কিন্তু বাইরে থেকে তা বোঝা যায় না। জারিয়া এত সুন্দর, তার কল্পনাও অত সুন্দর ভাবতে পারে না। জারিয়া তাকে আপন চাচার মতোই সম্মান করে। অধিকার খাটায়।

ডেকো শেষপর্যন্ত খুলনায় চলে যায় সপরিবারে, স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য। জারিয়া ঢাকায় থেকে যায় পড়ালেখার জন্য। কিন্তু বিষণ্নতা তাকে দিনদিন দখল করে নিতে থাকে। মেসে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে না। এ-রকমভাবে সে কখনো থাকেনি। বাবা যে তাকে কষ্ট করে টাকা পাঠায়, সে তা বোঝে। নিজেও টিউশনি করতে থাকে, তাতে যদি বাবার কষ্ট কিছুটা হলেও কমে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে কাড়িকাড়ি টাকা লাগে। জোহা নিয়মিত তার খোঁজ নেয়। জারিয়া নিজেও কখনো কখনো তার অফিসে যায়। বাবাকে জানায় না। জোহা নিজেও জানাতে নিষেধ করে। সে কখনোই জোহার খোঁজ নেয় না। ভুল করেও একটিবারের জন্যও ফোন করে না। অথচ জারিয়াকে এমন দিন নেই ফোন করে না। মাঝেমধ্যে জারিয়াকে টাকা দেয়। জারিয়া প্রথম প্রথম নিতে চাইতো না। এখন আর তাতে আপত্তি নেই। স্বাভাবিকভাবেই সে টাকা নেয়। বরং এখন খুশি মনেই নেয়। জোহা ও জারিয়ার সম্পর্কটা পলেস্তরার মতো খসে নতুন সম্পর্কের চারা গজাতে থাকে। তাদের কথার ভেতর দিয়ে সম্পর্কটা বাঁক নিতে থাকে। জোহা ইচ্ছে করেই বাঁক তৈরি করে কৌশলে। জারিয়া বুঝেও না বোঝার ভান করে, সে বাঁকে নিজেও মিশে যেতে থাকে। কথার স্রোত বাড়ে দুজনের, গতি বাড়ে, সময় বাড়ে, অন্য অধিকার বাড়ে। বাঁকখাওয়া নদীর মতো বদলে গেছে সম্পর্কের গতি। দুজনেই বুঝে নেয় তাদের সম্পর্কটা প্রতিদিনই একটু একটু করে ভেঙে পড়ছে। জোহা যে কৌশলে সম্পর্কটার ভেতর থেকে আর একটা সম্পর্কে জারিয়াকে নিজের সঙ্গে বাঁধতে চেয়েছিল, সেই কৌশলের ফাঁদে বুঝে হোক না-বুঝে হোক জারিয়া যে তার ইচ্ছেমতো হয়ে উঠছে, তা সে বুঝতে পারে। নিজের ভেতরে সে তৃপ্ত অনুভব করে। তার ভাবনার বহু জায়গা জুড়ে নেয় জারিয়া। বৃত্ত ভেঙে অন্য স্রোতে ভেসে যাচ্ছে জোহা, তাতে জারিয়াও ভাসে, ভাসতে থাকে, ভেসে যেতে থাকে। এর ভেতরেও আত্ম-ভাবনা তাকে প্রশ্নের বড়শিতে ঝুলিয়ে রাখে।

জারিয়া ভাবে, জোহার সংসার আছে। সন্তান আছে। কত বড় ব্যবসা। কত কোটি কোটি টাকা। কত সম্মান তার। কত লোক তার অফিসে চাকরি করে। এত বছর একটা পরিবারের মতো মিশে আছি। জোহা এখন আর আগের সেই আগের আংকেল নেই। আমিও যে সেই আগের আমি আছি, তাও নয়। প্রথম প্রথম কেমন ভয় ভয় লাগতো। নিতে চাইতাম না। জোহা আংকেল বলতেন, এটা টাকা না, এটা ভালোবাসা। এই ভালোবাসাটা প্রথমে মনে করতাম অনেকটা বাবা-মেয়ের মতো ভালোবাসা। জন্ম থেকেই তো তাকে চিনি। কিছুদিন যেতেই বুঝলাম, আমার ভাবনা পুরো ভুল। আমি যে জোহা আংকেলকে চিনি-জানি, এই জোহা আংকেল সেই জোহা আংকেল নয়। এই জোহা আংকেলও আমার মনের ভেতর শক্ত একটা জায়গা করে নেয়। আমার মাথার ভেতর মনের ভেতর সে পুরো ঢুকে যায়। প্রতিটা দিন তার সঙ্গে আমার জীবন হয়ে ওঠে। আমি নিজেও এখন তার জন্য অপেক্ষা করে থাকি।

অজস্র ভাবনার ভেতর ডুবে থাকে জারিয়া। ভাবনাগুলো তাকে মাকড়সার জালের মতো জড়িয়ে ফেলে। ম্যাসেঞ্জারে জোহাকে নক করে। জোহাও সাড়া দেয়। কথায় কথায় কত কথা হতে থাকে তাদের। কিছুক্ষণ আগে জারিয়া যা ভেবেছিল, সব হারিয়ে যায়, সবুজ স্বপ্নের মতো সে পাখা মেলে দেয়। জোহা বললো, জারি, অনেক রাত এখন। দুটোর বেশি বাজে। ঘুমাবো। তুমিও ঘুমাও। জারিয়া খুব অভিমানী কণ্ঠে বলে, তোমাকে ছাড়া ভালো লাগে না কিছুই। আমাকে পাগল বানিয়ে এখন কিভাবে ঘুম হয় তোমার?
সকালে জরুরি মিটিং আছে। কাল কথা বলবোনে। এখন রাখছি। ঘুমাবো।

তোমাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি, জোহা। এখন আর লুকোছাপা করে লাভ নেই। বাবার বন্ধু তুমি; ওভাবেই তোমাকে সারাজীবন তোমাকে সম্মান করে এসেছি। কিন্তু এই সাত-আট মাসে আমার সব হিসাব পাল্টে গেছে। একটা কথা ঠিক করে কও তো, তোমার হিসাব কি একটুও পাল্টায়নি?

আমারও পাল্টেছে। পাল্টেছে বলেই তো এত রাত তোমার সঙ্গে আছি। কথা বলছি। বলো, শুধু বন্ধুর মেয়ে হলে কি কেউ এত রাত জাগে? তোমার জন্য আমি যা করছি, বন্ধুর মেয়ের জন্য কেউ এত কিছু করে? করে না।

জানি তো। এখন আর তোমার কাছে আমি বন্ধুর মেয়ে নই। তুমি এখন আমার বন্ধু। জোহা, তুমি এই মাসেই একটা ফ্লাট কেনো। কেউ জানবে না। ওখানে শুধু আমি থাকবো। তুমি নিয়মিত আমার কাছে আসবে। ওটা তোমার আমার একান্ত বাসা হবে। আমি গোপন গহনে তোমার ছোট্ট বউটি হয়ে থাকতে চাই।

জোহা ভাবে, প্রায় নয় বছর আগে সেনাকুঞ্জে বিয়ের একটা অনুষ্ঠানে ডেকোর পরিবারের সঙ্গে যখন প্রথম পরিচয় হয়, তখন তার মনে এসবের কিছুই ছিল না। জারিয়ার প্রতি গোপন আসক্তি বাসনা তৈরি হয়েছে। আর এই বাসনা থেকেই তার বাবা ডেকোর বন্ধুত্ব বেড়েছে । এক পরিবারের মতো হয়ে উঠেছে দুই পরিবার। আবার জোহা কৌশলে ডেকোকে নিজের বন্ধুর প্রতিষ্ঠানের চাকরি থেকে সরিয়ে দিয়েছে। এসবের কিছুই জানে না ডেকো। চাকরি হারিয়ে হতাশ ডেকোর ঢাকা ছেড়ে যেতে হয়েছে। জোহা নিজেও মনে মনে এক ধরনের অপরাধবোধ অনুভব করে। কিন্তু তা শোধরানোর চেষ্টা করে না। জোহা নিজেকে বলে, এ সবের জন্য যে কতটা সাবধানে আমাকে খেলতে হয়েছে, তা শুধু ঈশ্বর জানেন। ঈশ্বরও হয়তো আমাকে ক্ষমা করবেন না। একালের জারিয়াকে পেলে পরকালের স্বর্গ আমার দরকার নেই। পাপ-পুণ্য ওসব গুনি না। হিসাবও করি না। জারি সত্যি অপ্সরী। সেই অপ্সরী নিজেই এখন নিজের ডানা ভেঙে আমার বুকের ভেতর পড়ার জন্য ব্যাকুল। কথাগুলো তার মনের ভেতর ভাবনা হয়েই ঢেউ খেলে ঢেউয়ে আবার মিশে গেলো। জারিয়া কিছুই বুঝতে পারলো না জোহার সেই ভাবনার। জোহা মোবাইফোনে জারিকে বললো, তোমার জন্য শুধু ফ্লাট কিনবো কেন, গাড়িও কিনবো। আর সেসঙ্গে তোমার অ্যাকাউন্ট ভরে টাকা দেবো। এখন যা দেই ও তো কোনো টাকাই না। দুই চার লাখ টাকা কোনো টাকা হলো? তুমি শুধু আমার ছোট্ট পুতুল বউ হয়ে থাকবা। কেউ জানবে না। শুধু তুমি আর আমি। দেখবা তুমি এ শহরের গোপন রাজরানি হয়ে আছ।
-এখুনি চলে আসো আমার কাছে। কুমারী মেয়ে হয়ে কি নির্লজ্জ হয়ে উঠেছি, বুঝতে পারো না তুমি? তুমি তো এখন বউয়ের সঙ্গে আনন্দ করবা। আমার কথা একবার ভাবো, আমার কেমন লাগছে!
-জারি, এত পাগল হলে হয় নাকি পাগলি! তোমাকে রাত পোহালেই গাজিপুরে ‘নীলমেঘ’ রিসোর্টে নিয়ে যাবো।
-আমি কিন্তু মন থেকে চাইতাম, তোমার পছন্দের কোনো জায়গায় আমাকে নিয়ে যাও। আবার কখনো ভেবেছি, তুমি আমাকে চেয়েও, কেন জানি একটু দূরত্ব রেখে চলো। তুমি খুব অদ্ভুত! কখনো আমার জন্য তুমি উন্মত্ত, আবার কখনো একদম শান্ত, রাতের নিস্তব্ধতার মতো নীরব। এর আগে যেদিন তুমি আমাকে গুলশানে নিয়ে গেলে, সেদিন তো ভেতরে ভেতরে এ-করকম ভয়ে ছিলাম। কিন্তু আশ্চর্যরকম নীরবতা দেখলাম তোমার। অনেক উপহার কিনে দিলে, আমার হাতটিও ধরলে না। সত্যি অবাক হয়েছিলাম! পুরুষ মানুষ এতটা পারে! অথচ তুমি তো নিজেও বুঝে ফেলেছ এতদিনে, তোমার কোনো কিছুতেই না-করার শক্তি আমার নেই। তোমার এই অনাসক্তিভাবই তোমার প্রতি আমাকে আরও বেশি দুর্বল করে ফেলেছে। যেন আমি নিজেই তোমাকে পাওয়ার জন্য কেমন এলোমেলো হয়ে গেছি।
-তা তো হতেই পারতো। তারপরও কেন যেন ইচ্ছে করেনি। অথচ আসার সময় ওরকম ইচ্ছে যে একদমই ছিল না, তাও নয়, ছিল।
আমার সবকিছুই কিন্তু তোমার জন্য অপেক্ষা করে ছিল। প্রথম দিকে ওরকম ভাবিনি কখনো, মনেও আসেনি। কিন্তু এই কয়মাসে যে কয়দিন তোমার কাছে গিয়েছি, আমার সবকিছু তোমার করেই নিয়ে গেছি। এক আধটু আদর ঠিকই করেছ। পুরোটাতেও আমার আপত্তি ছিল না।
তোমার ভাবনা ঠিকই আছে। আগামীকাল তোমার ভাবনাগুলো ফুল হয়ে ফুটবে। এখন ঘুমাও।

জোহা ম্যাসেঞ্জার থেকে বের হয়ে মোবাইলের সুইচ অফ করে দেয়। জোহা দুচোখ বন্ধ করে ভাবে, ডেকো, বন্ধু আমার, তুমি কখনোই আমার বন্ধু ছিলে না। আমি শুধু বন্ধুত্বের খোলস পরে অপেক্ষা করেছি, জারিকে পাওয়ার জন্য। জারি এখন নিজেই আমার জন্য তপ্ত রোদের মতো তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছে। জারিয়া কয়েকবার জোহাকে ফোন করে। বন্ধ মোবাইল। রাগ হয়। ক্ষোভ হয়। আবার ভাবে, জোহা তো আমাকে বলেই মোবাইল বন্ধ করেছে। তারপরও ওর ওপর আমার এত রাগ হচ্ছে কেন! কি অদ্ভুত সম্পর্ক! বাবার বন্ধু! সে এখন আমার প্রণয়ের কবিতা!

জারি ভাবে, রাতটা অনেক দীর্ঘ মনে হচ্ছে। আবার ভাবে, আচ্ছা, আমি জোহাকে ভালোবাসি না জোহার টাকা ভালোবাসি? জোহা যদি আমাকে অত অত টাকা না দেয়, আমি কি সত্যি ওকে ভালোবাসবো? আচমকা কেমন একটা প্রবল ঝাপটা এসে জারিয়ার মনে লাগে। চারপাশটা কেমন অন্ধকার হয়ে যায়। জারিয়া নিজেই নিজেকে আর দেখতে পায় না। মোবাইলের সুইচ অফ করে শুয়ে পড়ে জারিয়া। ভাবে, না, আগামীকাল জোহার সঙ্গে যাবো না, কখনোই যাবো না।